somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পিথাগোরাস-এর অন্ধকার দিক

১০ ই অক্টোবর, ২০০৮ সকাল ১০:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পিথাগোরাস ছিলেন, আমরা কমবেশি জানি, প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক ও গণিতবিদ। গণিত ও সঙ্গীতের ক্ষেত্রে অনেক গুরুর্ত্বপূর্ন আবিস্কারের কৃতিত্ব তারই। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেই তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে- এ গ্রহটি ঠিক চ্যাপ্টা নয়, বরং গোলাকার। পরবর্তীকালে তার শিষ্যদের (এরা পিথাগোরীয় নামে পরিচিত) "সত্যিকারের ও আপত গতি" সম্বন্ধে ধারনা পরবর্তীকালে কোপানিকাসের ধারণাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। পিথাগোরাসের শিষ্যরা ঠিকই অনুমান করেছিল যে- পৃথিবী নয়, বরং সূর্যই পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। কিন্তু পৃথিবী নিজেও যে এর অক্ষে ঘুরছে তা জানা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
সে যাই হোক। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে পিথাগোরাসের অবদান গভীর। খুলে বলছি কেন। যে কোনও একটা গান একটা স্কেলের স্বরগুলি নিয়ে তৈরি হয়। ওই গোটা স্কেলটার প্রতিনিধি করে কর্ড। যে কোনও স্কেলের সা- গা- পা; এই স্বর তিনটি নিয়ে তৈরি হয় কর্ড। একটা স্কেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন স্বর হচ্ছে সা, তারপর, পা তারপর গা। গানিতিক ভাবে এই সা গা পা-র দূরত্ব আবিস্কার করার কৃতিত্ব পিথাগোরাসের। আসলে ইউরোপের সঙ্গীত পদ্ধতিই পিথাগোরাসের এই আবিস্কারের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে।
গ্রিক দার্শনিক প্লেটোকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন পিথাগোরাস। পিথাগোরাস বলেছিল- “অল থিংক্স আর নাম্বারস।” সব বস্তুই আসলে সংখ্যা। কথাটি তুমুল মরমী। এই কারণেই কি প্লেটোকে আকর্ষন করেছিলেন পিথাগোরাস?
যা হোক। আমি কিন্তু পিথাগোরাসের গণিত কি সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করতে উৎসাহী নই। সম্প্রতি ঐতিহাসিক বিউরির "আ হিস্ট্রি অভ গ্রিস" বইটা পড়তে পড়তে পিথাগোরাসের জীবনে একটা অন্ধকার দিক আমার চোখে পড়েছে। সে সম্বন্ধে বলব। আমার মনে হয়েছে অন্ধকার। অনেকের মনে নাও হতে পারে।
পিথাগোরাসের জন্ম সামোস দ্বীপে ।
তা কোথায় সামোস দ্বীপ?
সামোস দ্বীপটি এজিয়ান সমুদ্রের দক্ষিণপূর্বে; বর্তমান তুরস্কের মেইনল্যান্ডের খুব কাছে । পিথাগোরাসের জন্ম ওই সামোস দ্বীপেই ।৫৮২ খ্রিস্টপূর্বে। ছেলেবেলায় কেমন ছিল বালক পিথাগোরাস? কিথারা বাজিয়ে খুব গান শুনত? সম্ভবত। তার সময়ের পন্ডিতরা ছিলেন সব বিখ্যাত আয়োনিয় দার্শনিক। থালেস-আনাক্সিমিন্দার-আনাক্সিমিনিস। কী ভাবতেন এঁরা- শৈশবেই সে সম্বন্ধে জেনেছিলে বালক পিথাগোরাস। স্বভাবতই জ্ঞান পিপাসু ছিলেন। স্পস্ট বক্তাও ছিলেন। তখন সামোস দ্বীপের শাসক ছিলেন পলিক্রাটেস। পলিক্রাটেস ছিলেন নব্বুয়ের দশকের আমাদের দেশের জেনারেল এরশাদের মতো একজন স্বৈরশাসক। পিথাগোরাস নাকি প্রকাশ্যেই পলিক্রাটেসের সমালোচনা করতেন।
কাজেই নির্বাসিত হলেন।
তো কই যান?
ক্রোটন জায়গাটা বর্তমান ইতালির দক্ষিণের একটা গ্রিক উপনিবেশ।
৫৩০ খ্রিস্টপূর্ব। পিথাগোরাস ক্রোটন নগরে বসবাস করতে শুরু করেন। ক্রোটনে তিনি সাধারণ মানুষ ও শাসকবর্গের কাছ থেকে বিপুল অভ্যর্থনা পেলেন।
সেখানেই একটি আধ্যাত্মিক ভ্রাতৃসংঘ গড়ে তোলেন পিথাগোরাস। যার পরিনাম ভালো হয়নি। যাইহোক। কি বিশ্বাস করতেন পিথাগোরাস?
পিথাগোরাস অর্ফিক রহস্যবাদ বিশ্বাস করতেন। অর্ফিক রহস্যবাদ কি? প্রাচীন গ্রিসের রহস্যবাদী ধর্ম। কিংবদন্তী কবি ও সঙ্গীতকার অর্ফিয়াসের লেখনীর ওপর নাকি অর্ফিক রহস্যবাদ গড়ে উঠেছিল। এককথায় অর্ফিক রহস্যবাদ হচ্ছে অন্ধ বিশ্বাস আর কুসংস্কারের কুন্ড। এরচে আর বেশি বলার প্রয়োজন নেই। পিথাগোরাস নিজে মৌন থাকতে পছন্দ করতেন। ভ্রাতৃসংঘের শিষ্যদের সেই রকম থাকতে বলতেন। নিজে মনে হয় বেশি খেতেটেতে পছন্দ করতেন না, সে কারণে খাদ্য গ্রহন থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিতেন শিষ্যদের। পিথাগোরাসের ভ্রাতৃসংঘের সদস্যদের আহারবিহার ও পোশাকে ছিল সাধারণ। তারা একত্রে বসে আত্মবিশ্লেষন করতেন।(পিথাগোরাসের আরও আরও অমূলক বিশ্বাস সমন্ধে পড়ুন বারট্রান্ড রাসেলের বিখ্যাত বই-হিস্ট্রি অভ ওয়েস্টার্ন ফিলসফি।) অমরত্মে ও আত্মার রুপান্তরে বিশ্বাস করতেন পিথাগোরাস। কাজেই তার শিষ্যরাও বিশ্বাস করত। তিনি নিজেকে মনে করতেন তিনি ইউফোরবাস। তা কে ইউফোরবাস? একজন ট্রোজান যোদ্ধা। বহু আগেই মরে ভূত হয়ে এখন পিথাগোরাসের কাঁধে চেপেছে। এবার বুঝুন তাহলে। পিথাগোরাসের ভ্রাতৃসংঘে নাকি নারীদেরও প্রবেষাধিকার ছিল। ঘটনা এবার তা হলে অন্যদিকে মোড় নিল। পিথাগোরাস কি ঠারেঠোরে নারীর রুপসুধা পান করতেন নাকি ওই মেয়েরা সবাই ছিল সিস্টার নিবেদিতা?
পিথাগোরাসের অর্ফিক মতবাদ ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ক্রোটন ও আশেপাশের নগররাষ্ট্রে। অভিজাতরা পিথাগোরাসের সংঘে যোগ দিত রাজনৈতিক ক্ষমতা বজায় রাখার উদ্দেশে। (দ্র: জে. বি বিউরি অ্যান্ড রাসেল মেইগস। আ হিস্ট্রি অভ গ্রিস। পৃষ্ঠা; ১৯৭-৯৮) পিথাগোরাসের কি সম্মতি ছিল? অবশ্যই। তিনি ছিলেন অভিজাত ক্রোটনবাসীর আধ্যাত্মিক গুরু। পিথাগোরাস কি দিনদিন ক্ষমতা লিপ্সু হয়ে উঠছিলে? তাইই। ধর্মীয় মতবাদ প্রচার ও প্রসারের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতার প্রয়োজন হয়ে পড়ছিল তার? তাইই।
এই পিথাগোরাসের অন্ধকার দিক।
কত লোক কত কথা (সত্য নাও হতে পারে) মনে মনে ভাবে। সে সব মনের ভাবনার প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিতে গেলেই বিপত্তি। "আমার মনের ভাবনাটাই সত্যি। আমার মতবাদ অনুসরণ করলে জগতের অসুখবিসুখ সেরে যাবে।" এরচে বড় হঠকারী ভাবনা আর নেই। পিথাগোরাস এমনই এক হঠকারী ভাবনায় ভুগছিলেন। তিনি রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে তার মতবাদ প্রচারের জন্য হয়ে উঠলেন অস্থির।
তার সামনে সুযোগ এল।
ঐতিহাসিক বিউরি লিখেছেন ক্রোটনের প্রতিবেশি নগররাষ্ট্র ছিল সাইবারিয়াস। সেই নগরটা শাসন করত এক স্বৈরাচারী; নাম- টেলেস। টেলেস কয়েকজন সাইবারিয়াসবাসীকে নির্বাসিত করল। ক্রোটন তাদের আশ্রয় দিল। পিথাগোরাসের নির্দেশে? অবশ্যই। কারণ, আধ্যাত্মিক গুরুরা মানুষের সঙ্কটের জন্য অপেক্ষা করে। যাক। ওদিকে টেলেস লোকগুলিকে ফিরিয়ে দিতে বলল। পিথাগোরাসের নির্দেশেই ক্রোটনের শাসকরা তাদের ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করল। পিথাগোরাস জানতে টেলেস এখন সসৈন্য অগ্রসর হবে; তাই হল। যুদ্ধ বাঁধল, টেলেস পরাজিত হল।
তারপর সাইবারিয়াসও পিথাগোরাসবাদী ক্রোটন শাসকবর্গের দ্বারা নিশ্চিহ্ন হল।
রাষ্ট্রক্ষমতার দখলের জন্য চাই যুদ্ধ। পিথাগোরাস যে কারণে যুদ্ধ আটকাননি।
এই পিথাগোরাসের অন্ধকার দিক।
ভ্রান্ত অর্ফিক মতবাদ প্রচারের জন্য নিহত হল অসংখ্য নিরীহ নারীপুরুষশিশু।
সময় সব সময় কারও পক্ষে থাকে না।
ক্রোটনে পিথাগোরীয়পন্থিদের বিরুদ্ধে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হল। পিথাগোরাস ক্রোটন ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। কোথায়? মেটাপনটিওন-এ। ওখানেই তার মৃত্যু হলো। সময়টা ৫০০ খ্রিস্টপূর্ব।
এদিকে গনতন্ত্রপন্থি ও পিথাগোরীয়পন্থিদের মধ্যে ক্রোটনে সংঘাত চলছিল। তা সত্ত্বেও ক্রোটন ও এর আশেপাশের নগররাষ্ট্রগুলিতে পিথাগোরীয়পন্থিদের প্রভাব বাড়ছিল।
বিউরি আরও লিখেছেন- ক্রোটন নগরে ছিল মিলন-এর বাড়ি। সে ছিল পিথাগোরীয়পন্থি; বিরুদ্ধবাদীরা তার বাড়িতে আগুন লাগাল। পিথাগোরীয় ভ্রাতৃসংঘের
চল্লিশজন “ভাই” পুড়ে মরল। এরপর ওদের যেখানেই পাওয়া গেল পুড়িয়ে মারা হল।
এসমস্তই ঘটল পিথাগোরাসের ভ্রান্ত বিশ্বাসের জন্য।
আগেই বলেছি। পিথাগোরাসের দর্শনের দুটো ভাগ। এক দার্শনিক। অপরটি ধর্মীয়। পিথাগোরাসের মতবাদে অনেক মানবিক থাকলেও তিনি তার বিশ্বাস জনগনের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সাইবারিয়াস নগর তার অনুসারীদের দ্বারা ধ্বংস হল। তিনি বাধা দেননি। কেন? তিনি যে ভ্রাতৃসংঘ গড়লেন তা শেষ অবধি ধ্বংস-মৃত্যু-আগুনে গড়াল। কেন? কেন তিনি অর্ফিয়াসের মনগড়া কথায় বিশ্বাস করতেন? যে কারণে তাকে ক্রোটন ছেড়ে পালাতে হল!
এই পিথাগোরাসের অন্ধকার দিক।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:৩৪
১৮টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×