somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমরা কি অভ্যন্তরীন পর্যটনের কথা ভাবতে পারি? (২)

১৩ ই অক্টোবর, ২০০৮ সকাল ১০:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(এই লেখাটা আমি আমার একজন প্রিয় সুহৃদ ‘আশাবাদী’-কে উৎসর্গ করছি।)

এক/ আপনার মনে বাস্প জমেছে। বুকের ভিতরে ধীরে ধীরে জমে উঠছে গাঢ় অভিমান।
আপনার মোবাইলে একটি বিশেষ নম্বর সেভ করা আছে।
আপনি ছোট্ট ব্যাগটা গুছিয়ে কাউকে কিছু না-বলেই বেরিয়ে পড়লেন ...

দুই/ ১৯৯৫ সাল। জুন মাস। দু’জন বন্ধুর সঙ্গে ট্যাক্সি করে ( একাত্তরের সেই বিখ্যাত) শুভপুর ব্রিজের দিকে যাচ্ছি। সেই প্রথম দেখলাম ছাগলনাইয়া। কী সুন্দর জায়গা! সীমান্ত-ঘেঁষা ছড়ানো প্রান্তর, দূরে প্রতিবেশি রাষ্ট্রের অনতিউচ্চ সবুজ ধূসর পাহাড়শ্রেণি ...
মনে মনে ভাবলাম: বাংলাদেশের মানুষ কি জানে এত সুন্দর জায়গা আছে বাংলাদেশে।
কল্পনার চোখে দেখলাম: কৃত্রিম একটা হ্রদ ঘিরে সার সার কাঠের পর্যটন কটেজ। কত কত মানুষ বেড়াতে এসেছে। প্রাণভরে দেখছে, বাংলাদেশের এক অতীত সুন্দর যায়গা। ছড়ানো প্রান্তরে খেলনা রেলগাড়ি। শিশুদের হাতে বেলুন ...

তিন/ ১৯৯৪ সাল। ১৭ ডিসেম্বর। পূর্বাহ্ণ। আর কিছুক্ষণ পর সেন্ট মার্টিন দ্বীপে নামব আমরা। ডিসেম্বরের উজ্জ্বল রোদে সমুদ্র পাড়ের বালি চিকচিক করছিল। ভাবছিলাম-মানুষ সেন্ট মার্টিন না এসে কেন বালি দ্বীপ, মালদ্বীপ যায়!
অবশ্য তখন কমিউকেশন আজকের মতন সহজ ছিল না।
এবং আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কোলাহলশূন্য কুমারী রুপটিই দেখেছিলাম।

চার/ যখন প্রথম দেখি হিমছড়ি, ওই ’৯৪ সালেই- কক্সবাজারের বেলাভূমির পাশের পাহাড়ে সার সার হোটেল নেই দেখে অবাক হয়েছিলাম। ওই ’৯৪ সালেই কল্পনা করেছিলাম- কক্সবাজারের বেলাভূমির পাশের পাহাড়ে সার সার হোটেল। সিঁড়ি নেমে গেছে ...অভ্যন্তরীণ পর্যটনের অমিত সম্ভাবনা তখনই উঁকি দিচ্ছিল মনে।

পাঁচ/ আপনার মনে বাস্প জমেছিল। বুকের ভিতরে ধীরে ধীরে জমে উঠছিল গাঢ় অভিমান।
আপনার মোবাইলে একটি বিশেষ নম্বর সেভ করা ছিল।
আপনি ছোট্ট ব্যাগটা গুছিয়ে কাউকে কিছু না-বলেই বেরিয়ে পড়েছিলেন ...

ছয়/ বাসের ভিতরে বসে থেকে মনের মেঘ কতকটা কাটল। কিন্তু, আপনি ইনট্রোভার্ট। আপনার আরও আরও শান্ত্বনা প্রয়োজন। আপনি সেদিকেই যাচ্ছেন। আপনার জন্য অপেক্ষা করছে মধ্য -অক্টোবরের জ্যোস্না। হিম। কচুরিপানার গন্ধ। ঝিঁঝির ডাক ...

সাত/ সন্ধ্যের মুখে শিমূলিয়ার বাসস্টপে নামলেন আপনি। রফিক দাঁড়িয়েছিল বাসস্টপে । ২৫/২৬ বছরের তরুন। শ্যামলা। দেখলে কেমন আপন মনে হয়। আপনারা কুশল বিনিময় করলেন। রফিকের মুখের ঝকঝকে হাসি আপনাকে দারুণ ভাবে আশ্বস্ত করে।

আট/ রাস্তার পাশে একটা ভ্যান দাঁড়িয়ে। আপনি ভ্যানে উঠলেন। কতদিন পর ...। আপনার ভালো লাগছে। দু’পাশে খোলা মাঠ। খাল। সন্ধ্যা নামছে। যেতে যেতে মাগরিবের আজান শুনতে পেলেন। শহরের চাপিয়ে দেওয়া পোশাকটা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। আপনি স্বাভাবিক হচ্ছেন।
ভ্যানে করে যেতে যেতে রফিক যা বলল তা এই: ...রফিকের বন্ধুরা মিলে স্কুল মাঠের পাশে একটা ঘর তুলেছে। বছর খানেক হল। সেখানেই মাঝে মাঝে শহর থেকে মনে বাস্প-জমা লোকজন এসে থাকে। একবার নাকি একটি মেয়ে এসেছিল। একা। দিন কতক থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিল। আজও ফোন করে রফিকদের খোঁজ খবর করে রোকসানা শিরিন।
আপনি ভ্যানে যেতে যেতে রোকসানা শিরিন-এর মুখটি কল্পনা করলেন। কি ওর দুঃখ কে জানে। পৃথিবীতে আমরা তো কাঁদতে এসেছি।

নয়/ ভ্যানটা যখন স্কুল মাঠের পাশে থামল ততক্ষণে চাঁদ উঠে গেছে। মধ্য-অক্টোবরের ক্ষীণ কুয়াশাও জমেছে চরাচরে। আপনার মনের মেঘের সঙ্গে সে কুয়াশা যুদ্ধ করে। আপনি জানেন শিমূলিয়ার কুয়াশার কাছে আপনার মনের মেঘেরা পরাজিত হবে।

দশ/ সুপারি গাছে ঘেরা টিন সেডের একটা বাড়ি। রফিকরা বলে কাচারিবাড়ি। ভিতরে ঢুকে হারিক্যানের আলোয় দেখলেন-দুতিনটে রুম। মাটির মেঝে। টিনের দেওয়াল। বাতাসে ধূপের গন্ধ। রফিক বলল, রঞ্জন প্রতি সন্ধ্যায় ধূপ জ্বালায়।
এভাবে আপনি প্রাচীন বাংলায় ফিরে যেতে থাকেন।
ধূপের গন্ধের ভিতরে সেই শক্তি নিহিত।
পিছনে ছোট্ট একটা উঠান। ম্লান জ্যোস্না ছড়িয়ে আছে। টিউবয়েল। বাঁ পাশে রান্নাঘর। হারিকেনের আলো। একটা মেয়েকে দেখলেন। কে মেয়েটি?
উঠানের ওপাশে একটা পুকুর। জাম গাছ। ঘাটলা। পানার গন্ধ। কি নির্জন।
রফিক আপনার পাশে দাঁড়িয়ে। ও বলল- বছর খানেক আগের কথা। রফিক ওর বেকার বন্ধুদের নিয়ে সন্ধ্যার পর মোমবাতি জ্বালিয়ে তাশ পেটাচ্ছিল। ঠিক তখনই জুবায়ের নামে এক চিন্তাবিদ চিন্তারাজ্য থেকে নেমে এসে দাঁড়ায়। তারপর ওদের কাচারিবাড়ি তৈরি করার কথা বলে। তারপরই ...

এগারো/ কাচারিবাড়িতে যে মেয়েটি রাঁধে তার নাম সাবিনা । শ্যামলা মতন দেখতে। তেইশ-চব্বিশের মতন বয়স। গত বছর পাষন্ড স্বামী রাগের মাথায় তালাক দিয়েছিল। আর ঘরে তোলেনি। বাপের বাড়ি ফিরে এসেছিল। সেখানে নানান সমস্যা। বছর তিনেকের একটি বাচ্চা ছিল সাবিনার। তখন অনেকটা নিরুপায় হয়েই শিশুকোলে শহরমূখী হওয়ার কথা ভাবছিল সাবিনা। আর ঠিক তখনই রফিকরা ...

তেরো / রাত নটার দিকে পাটি পেতে খেতে বসেছেন। ভাত। ছোট মাছের ঝোল। ডাল। ডালটা চমৎকার রাঁধে সাবিনা। ঘন। ঠিক আপনার পছন্দের মত। সে কথা আপনি বললেনও। সাবিনা বসে ছিল কাছে। পানির গ্লাটা বাড়িয়ে দিল। ওকে আপনার বোনের মত মনে হল। কাছেই রফিকও বসে ছিল । ও সাবিনার গল্পটা খুলে বলল। আপনি সামান্য বিষন্ন বোধ করেন। ভবিষ্যতে সাবিনার বাচ্চার জন্য কিছু করবেন কথা দিলেন। রফিক বলল, শিরিন আপাও মাঝে মাঝে টাকা পাঠায় সাবিনার বাচ্চার জন্য। সে টাকা জমাচ্ছে সাবিনা। দু বছর পর শিউলিকে স্কুলে ভরতি করে দেবে।
অনেক দিন পর খেয়ে উঠে ভালো লাগল আপনার।
রফিক বলল, সাবিনার বিয়ের চেষ্টা করছে সে। সাবিনা রাজী হচ্ছে না ...
রোখসানা শিরিন এখানে কেন এসেছিল?

চৌদ্দ/এখন অনেক রাত। রফিকরা ঘুমিয়ে পড়েছে। আপনি পুকুর ঘাটে বসে আছেন। বসে বসে আকাশপাতাল ভাবছেন। রাগ করে আবার সিগারেট ধরবেন ভেবেছিলেন। সাবিনা ও প্রকৃতি বাধ সাধছে। ক্রমশ আপনাকে ঘিরে ফেলছে প্রকৃতি ও সাবিনার গল্পটা। রোখসানা শিরিনের গল্পটা। আপনার চারপাশে এখন মধ্য -অক্টোবরের জ্যোস্না।
হিম। কচুরিপানার গন্ধ। পুকুরের পানির গন্ধ। ঝিঁঝির ডাক। দূরে বড় রাস্তায় ট্রাকের আওয়াজ। সাবিনার বাচ্চাটা একবার কেঁদে উঠল। এরা সবাই মিলে আপনাকে বলার চেষ্টা করছে-মানুষ তোমাকে দুঃখ দিলে কি হবে। আমরা তো আছি।
আপনি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
আপনি জানেন, কাল আপনার দিনটা সুখে কাটবে। শিমূলিয়ায় নাকি হাজার বছরের পুরনো একটা দিঘী রয়েছে। চন্দ্রদিঘী। তার পাড়ে শতাব্দী প্রাচীন বটবৃক্ষ দাঁড়িয়ে। যে বটবৃক্ষের ডাল কাটলে লোকে নাকি মুখে রক্ত তুলে মরে।
কাল আপনি রফিকের সঙ্গে সেই উপকথার নিকটে যাবেন ।
কাল ১৬ অক্টোবর। কাল আপনার জন্মদিন । অথচ কথাটা কাউকে বলবেন না। রফিককে না। সাবিনাকে না।
থাকুক। সামান্য অভিমান থাকুক অভিমানী বুকে।

পনেরো/ সতোরোই অক্টোবরের সকালে বিদায় নেওয়ার সময় সাবিনার গাঢ় কাজলকালো চোখে টলটলে জল।
রফিকের মুখে সামান্য বিষন্নতা। রঞ্জনও কেমন গম্ভীর।
আপনি নিমিষেই জেনে যান- অবারিত ভালোবাসা পৃথিবীতে একমাত্র কোথায় মেলে।

ষোল/ বন্ধুরা, এই হল ইন্টারনাল টুরিজমের কাব্যিক দিক।
এখন এই স্বপ্নকে টুকরো টুকরো করে ভাঙ্গুন।
তা হলেই আরেক স্বপ্ন তৈরি হবে। যা হবে অটুট।

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:২৬
১০টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×