somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমরা কি অভ্যন্তরীন পর্যটনের কথা ভাবতে পারি? (৩)

১৫ ই অক্টোবর, ২০০৮ সকাল ৮:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গ্রামের মধ্যে হোটেল কিংবা কাদামাটির প্রলেপ

রহমান সাহেব পাগলাটে ধরনের লোক। দীর্ঘদিন খুলনার ইউসুফ জুটমিলে চাকরি করেছেন। এখন গ্রামের বাড়িতে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। স্ত্রী দীর্ঘদিন হলো মৃত। ছোট মেয়েটা ঢাকায় থাকে। বড় ছেলেটি অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়া তো দূরের কথা, ঢাকাতেও কালেভদ্রে যান রহমান সাহেব। এও তাঁর এক খেয়াল।
তো, বছরখানেক হল এক নতুন খেয়ালে মেতেছেন রহমান সাহেব।
হোসেনপুর গ্রামে রীতিমতো হোটেল খুলে বসেছেন।
হোটেল মানে পৈত্রিক ভিটের ওপর কাচারিবাড়িটাই খানিক সাফসতরো করে নিয়েছেন। ছ-সাতটি ঘর। শহর থেকে অথিথি আসবে। ঘরসংলগ্ন পরিস্কার বাথরুম করেছেন। শহরের অতিথির প্রথম দাবী ঘর সংলগ্ন পরিস্কার বাথরুম । খববেরর কাগজের বিজ্ঞাপনে সে কথা বলাও হয়। কিছু টাকা খরচ হয়ে যায়। হোক। হোটেল থেকে আয়ও তো হবে। হচ্ছেও। শহরের পেপারে বিজ্ঞাপন দেখে লোক আসছে । খরচ তো কক্সবাজারের তুলনায় চার ভাগের এক ভাগ। তবু রহমান সাহেবের আয় ভালোই।
টাকা জমিয়ে মায়ের নামে গ্রামে একটা বার্ধক্যনিবাস করবেন ভাবছেন।
হোটেলের রাঁধুনি রাঙার মা। বৃদ্ধা। বিধবা। স্বামী মরার পর ছেলে তাড়িয়ে দিয়েছিল। পুবপাড়ায় খালপাড়ে বসেছিল। কথাটা শামসুলের মুখে শুনে রহমান সাহেব নিজে গিয়ে ডেকে এনেছেন।
তা, হোসেনপুর গ্রামটি এমন কিছু আহামড়ি নয়। তবে যথারীতি সবুজ। আর শহর হল ধূসর। শহরের মানুষ হোসেনপুরে এলে চোখের আরাম টের পায়। এখানে আকাশের নিচে বিস্তর চাষের জমি। গাছপালা। মাঠ। পুকুর। গ্রামের পুব দিকে বড় একটা দিঘী। লোকে বলে, চন্দ্রদিঘী। দিঘীর পাড়ে শতাব্দী প্রাচীন এক ছায়াময় বটবৃক্ষ।
অতিথিরা ঘুরে ঘুরে দেখে মুগ্ধ হয়।
গ্রাম ঘুরিয়ে দেখায় শামসুল। ষোলসতের বছরের শ্যামলা মিষ্টি চেহারার কিশোর। এতিম। বাপ-মা মারা যাওয়ার পর চাচার বাড়ি ছিল। ওখানে অনেক কষ্ট। রহমান সাহেবই মায়াবশত ডেকে এনেছেন। বাপ-মা মারা যাওয়ার পর লেখাপড়া মাথায় উঠেছিল শামসুলের। এখন রাতের বেলা পড়ান শামসুলকে। স্কুলেও নাম লিখিয়ে দিয়েছেন।
গত জুনে মিসেস ইসলাম ঘুরে গেলেন হোসেনপুর।
তখন একটা ঘটনা ঘটেছিল।
খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখেই ছেলেমেয়েসমেত গিয়েছিলেন মিসেস রুবি ইসলাম । মেয়ের নাম ফরিয়া। সার্টপ্যান্ট পরা গোমড়া মুখের শ্যামলা মতন দেখতে। আসলে মেয়ের জন্যই যাওয়া। মেয়েটা দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন টেলিফোনে কথা বলে ...
মিসেস রুবি ইসলামের বড় ছেলের নাম শিহাব। বুয়েটে পড়ে। লম্বা। ফরসা। চশমা-পরা। একটা অ্যাকুয়েস্টিক গিটার এনেছে। কাট-এওয়ে। আইভানেজ।
রহমান সাহেব পাগলাটে ধরনের লোক। শিহাবকে বললেন, মাইজভান্ডারি পার নি? স্কুল খুইলাছে রে মওলা স্কুল খুইলাছে হে হে ...বলে বুকে দুম দুম বারি।
মিসেস ইসলাম হেসে বললেন, না না চাচা। ওরা কী সব অলটারনেটিভ শুনে।
শুনি বাবা। বাজাও।
দুপুরের খাওয়ার পর সবাই বারান্দায় বসে ছিল। শিহাব ঘর থেকে গিটার এনে টিউনটা ঠিক করে পাওয়ার কর্ড বাজিয়ে গাইতে শুরু করে-

দুজনকে মনে হয় দুগ্রহের ...

গান শেষ হলে রহমান সাহেব মাথা দুলিয়ে বললেন, ভালো।
শামসুল দাঁড়িয়ে ছিল কাছেই। ওর মুখচোখে আনন্দের আভা।
শিহাব গিটার রেখে আশপাশটা ঘুরে দেখতে উঠানে নেমে গেল। ওর পিছন পিছন ফারিয়া। উঠানে রোদ ঝকঝক করছিল। খড়ের গন্ধ। গোবরের গন্ধ। রহমান সাহেব গাই পালছেন। শহরের অতিথিরা খাঁটি দুধের স্বাদ পেয়ে মুগ্ধ।
যা দেখছি ভালোই লাগছে। মিসেস রহমান বললেন।
রহমান সাহেব বললেন, সবাই কক্সবাজার যায় সুখে। আর আমার এখানে মানুষ আসে মনে বাস্প জমলে।
ও। মিসেস ইসলামের মুখে ছায়া ঘনালো। কি যেন আড়াল করতে চাইছেন।
রহমান সাহেব বললেন, আমি যেই অপিসে চাকুরি করতাম,খুলনায়, সেখানে জুবায়ের রহমান নামে আমার এক কলিগ ছিল। ইন্টারনাল টুরিজমের আইডিয়াটা তারই। আমি রিটায়ার কইরা এখন বাস্তবায়ন করতেছি।
মিসেস ইসলাম বললেন, পেপারে দেখে এলাম। ছেলেমেয়েদের শহরে ভালো লাগছে না। বিশেষ করে মেয়েটার।
বুঝছি। আস্তে আস্তে লাগব। বিকালে চন্দ্রদিঘীটা দেখলে ভালো লাগবে। যান বেড়াইয়া আসেন। শামসুল নিয়া যাবে। আপনার মেয়ের মনে হয় সমস্যা।
জ্বী। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। রাতে তেমন ঘুমায় না। খালি জেদ করে।
বুঝছি। বৃষ্টি নামলে সব ঠিক হয়া যাবে।
মানে? মিসেস ইসলাম অবাক।
মানে পরে বলব। বলে রহমান সাহেব উঠে গেলেন।
মিসেস রহমান ছেলেমেয়েদের নিয়ে গ্রাম দেখতে বেরুলেন। সঙ্গে শামসুল ছিল। চন্দ্রদিঘীর পাড়ে এসে ফারিয়া একবার ফোন করতে চাইল। রিফাতকে বলবে, ¯স্প্রেডিং অ্যানসিয়েন্ট বানিয়ান ট্রিটার কথা।
মিসেস ইসলাম দিন কয়েক হল মেয়ের সেলফোন জব্দ করেছেন। মেয়েকে ধমক দিলেন। ফারিয়ার মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে ওঠে। ইংরেজীতে কী যেন বলল। চাপা স্বরে।
শিহাব বলল, উফঃ, তোমরা আবার শুরু করছ।
বিকেলের আগেই সবাই ফিরে এল। বেড়ানোটা তেমন জমল না।
সন্ধ্যের পর ধুম বৃষ্টি শুরু হল।
খাওয়া-দাও সারতে সারতে নটা বাজল। ফারিয়া খেতে এল না।
রহমান সাহেব মিসেস ইসলামকে বললেন, যান মেয়েরে নিয়া উঠানে যান।
উঠানে যাব কেন? । মিসেস রহমান অবাক। উঠানে বৃষ্টি আর অন্ধকার। কাদা।
যান। মেয়েরে উঠানে নিয়া গিয়া জামা খুইলা কাদায় গড়াগড়ি দেন। কেউ দেখব না।
মানে? মিসেস রহমান অবাক।
রহমান সাহেব বললেন, আপনাগো গায়ে অনেকদিন হইল কাদা লাগে না। তাইতে মনের অসুখ হইসে। যান মেয়েরে উঠানে নিয়া গিয়া জামা খুইলা কাদায় গড়াগড়ি দেন। কেউ দেখব না। মনের অসুখ সাইরা যাইব। যান। মেয়ের গায়ে কাদা মাখায় দেন। বৃষ্টিতে ভিজেন গিয়া। এইখানে আরছেন ক্যান? রাঙার মার হাতের রান্না খাইতে?
কথাগুলি বলে রহমান সাহেব ভিতরে চলে গেলেন।
মরিয়া হয়ে তাই করবেন মিসেস ইসলাম। ভাবলেন।

( এই লেখাটি হয়তো কাল্পনিক। কিন্তু আমি ’৯৩ সালের বর্ষায় পদ্মার এক চরে বসে ছিলাম দুপুরে। অর্ধনগ্ন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। নানা কারণে আমার মনে অসুখ করেছিল। আমি পদ্মার ঝিকঝিকে পানির দিকে চেয়ে গায়ে থিকথিকে কাদা মাখছিলাম ... গায়ে থিকথিকে কাদা মাখছিলাম আর সেরে উঠছিলাম। কাদা কি ঠান্ডা! তখন থেকেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই-মনের অসুখের নিদান কাদাজলে আছে।
গ্রামের লোকের মনের তেমন অসুখ কই?
ওদের কেবল ভাতের কষ্ট ...
সেটা দূর করা যায় যদি মাঝে মাঝে আমরা ওদের কাছে গিয়ে দিন কয়েক থাকি। ওদের উঠানের কাদা মাখি গায়ে সন্ধ্যারাতের বৃষ্টিতে ...)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:২৩
৭টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×