যুগবিভাগ।
আলোচনার সুবিধার্তে সুপ্রাচীনকালের বাংলার ইতিহাসকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
১) প্রাগৈতিহাসিক বাংলা বা Pre-historic Bengal.
২) প্রাচীন বাংলা বা Ancient Bengal.
আমরা আসলে যা আলোচনা করি তা সবই প্রাচীন বাংলা নিয়েই। প্রাগৈতিহাসিক বাংলা নিয়ে সেরকম আলোচনা কোথায়। প্রাগৈতিহাসিক বাংলার ইতিহাস হল বাংলার আদিম অরণ্য বসবাসরত আদি-অস্ত্রালদের ইতিহাস।
প্রাচীন বাংলার শুরু ঐতিহাসিক কালে, যখন নগরসমূহের ও লেখনির উদ্ভব হয়ে গেছে। প্রাচীন বাংলা বলতে আমরা সাধারণত বুঝি খ্রিস্টের জন্মের ৬ থেকে ৭ শ বছর আগেকার সময়কালের কথা-যখন পুন্ড্রনগর বা গঙ্গাহৃদি নগরগুলি আশেপাশের কৃষিজমির উদ্ববৃত্ত থেকে গড়ে উঠছিল । যখন পশ্চিম থেকে আর্যরা আসতে শুরু করেছে, প্রাচীন বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর বাড়ছে তাদের ধর্ম ও ভাষার প্রভাব। (দ্র: নীহাররঞ্জন রায়। বাঙালির ইতিহাস।)
আর প্রাগৈতিহাসিক বাংলা মানে আদি-অস্ত্রালরা যখন বাংলার আদিম অরণ্যে বৃষ্টিতে ভিজত; ফলমূল কুড়োত, দলবেধে শিকার করত; সম্মিলিতভাবে নাচত, গাইত, বোঙ্গা দেবতার উপাসনা করত ... (আদি-অস্ত্রালদের নিয়ে আগেই কিছু আলোচনা করেছি।)
প্রাগৈতিহাসিক বাংলার অরণ্যে আদি-অস্ত্রালদের হাজার হাজার বছর কেটেছিল।
এখানে একটা কথা বলে নিতে চাই- বর্তমান বাংলাদেশকে এখন আমরা যেমন দেখি- পাঁচ কি দশ হাজার বছর আগে সেই প্রাগৈতিহাসিক সময়ে বাংলার ভৌগোলিক অবস্থা ঠিক এ রকম ছিল না। থাকা সম্ভবও ছিল না। তার কারণ, বাংলার অর্ধেক ভূখন্ডই তো হিমালয় থেকে উত্থিত হওয়া নদীগুলির পলি পড়ে পড়ে সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই আদি অস্ত্রালদের বাসভূমি থেকে বর্তমান দক্ষিণ বাংলার পুরো অঞ্চলই বাদ দিতেই হচ্ছে। কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহ, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর-এসব অঞ্চলগুলি ছিল বলেই মনে হয়। কেননা, এসব অঞ্চল তুলনামূলকভাবে হিমালয় পর্বতের কাছে ছিল।
একটা সূত্রমতে, সূত্রটি মনে করতে পারছি না বলে দুঃখিত, আজ থেকে ৪০০০ বছর আগে বঙ্গোপসাগরের পাড় ছিল ঢাকার শ্যামলীর আদাবরের কাছে! এই তথ্যটি আমি সম্ভবত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্বের কোনও একজন অধ্যাপকের লেখায় পড়েছি।
যাই হোক। আদি-অস্ত্রালরা বাংলার আদিম অরণ্যে বৃষ্টিতে ভিজছিল হাজার হাজার বছর ধরে।
তারপর?
তারপর হেনরি লুইস মর্গান।
মানে!
হেনরি লুইস মর্গান ছিলেন একজন বিশিষ্ট মর্কিন নৃবিজ্ঞানী। মর্গানের জন্ম ১৮১৮; মৃত্যু, ১৮৮১। মর্গান দীর্ঘদিন আমেরিকার আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক বিবর্তন পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁর ধ্রুপদী গ্রন্থের নাম, “অ্যানসিয়েন্ট সোসাইটি” বা আদিম সমাজ; প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৭ সালে। মর্গানের গবেষনা সেই উনিশ শতকে এতই আলোরণ তুলেছিল যে প্রখ্যাত জার্মান পন্ডিত ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস মর্গানের বইটার একটি সংক্ষিপ্ত সার প্রনয়ন করেছিলেন "পরিবার, ব্যাক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উদ্ভব" নামে।
সামাজিক বিবর্তনের একটি একরৈখিক তত্ত্ব উপস্থাপক করেছেন মর্গান ।
তাঁর মতে আদিম সমাজের বিকাশ হয় তিনটি ধাপে।
১) বন্যতা বা বুনো যুগ।
২) বর্বরতা।
৩) ও সভ্যতা।
এই তিনটি লক্ষণ বা স্তর বিশ্বের যে কোনও আদিম সমাজেই দেখা দেয়। আসলে এই স্তরগুলি হচ্ছে একেকটি পর্যায়। আদিম সমাজের একটি পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে উত্তরণ ঘটে ।
বুনো যুগের বৈশিষ্ট্য হল আগুনের আবিস্কার, তীর ধনুক দিয়ে শিকার করা ও মৃৎশিল্পের ব্যবহার।
বর্বর পর্যায়ে আদিম মানুষ পশুপালন করতে শেখে, কৃষিকাজও শুরু হয় এই পর্যায়েই। সেই সঙ্গে ধাতু শিল্পর ব্যবহারও জানে আদিম মানুষ ।
সভ্যতায় বর্ণমালা ও লেখনিই হয়ে ওঠে সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য।
আর এভাবেই মর্গান সমাজ প্রগতির সঙ্গে ও কৃৎকৌশলগত প্রগতির সমন্বয় ঘটান। যে কারণে তিনি মাকর্সবাদী পন্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষন করতে পেরেছিলেন।
কিন্তু, প্রাগৈতিহাসি বাংলায় কি মর্গানের তত্ত্বটি প্রয়োগ করা যায়?
অবশ্যই। আদি-অস্ত্রালদের অরণ্যজীবন তো আর অ-সামাজিক (!) ছিল না। আদিস্তরের হলেও তাদের সমাজজীবন ছিল। ওই আদি-অস্ত্রালরাই প্রাগৈতিহাসিক বাংলায় আগুনের আবিস্কার করেছিল, বুদ্ধি খাটিয়ে তীর ধনুক তৈরি করে শিকার করত, মৃৎশিল্প রও উদ্ভব হয়েছিল, পশুপালন, কৃষিকাজের আবিস্কার করে আদি-অস্ত্রাল নারীরা, যেহেতু কৃষিকাজের আবিস্কারের কৃতিত্ব নারীদের; ধাতু শিল্পের ব্যবহারও কমবেশি আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল বলে অনুমান করি।
সভ্যতা আরও পরের ব্যাপার।
ওই কৃতিত্বটা একক ভাবে আদি-অস্ত্রালদের দেওয়া যায় না।
কেন?
কেননা, আদি-অস্ত্রালদের পরে প্রাগৈতিহাসিক বাংলায় এসেছিল দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ। (এদের সম্বন্ধে পরের পর্বে জানব।)
তার আরও পরে আলপাইন আর্যরা।
প্রাচীন বাংলায় সভ্যতা প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব এদের সবারই।
ক্রমশ।
তথ্যসূত্র:
১) 1) Wikipedia, Lewis H. Morgan.
এখানে মর্গানের বইটা (“অ্যানসিয়েন্ট সোসাইটি”) পড়ার সাইটের ঠিকানা আছে।
২) এ কে এম শাহনাওয়াজ রচিত ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস: প্রাচীন যুগ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:১০