প্রাচীন মিশরের সূর্যদেবতা রা। রা ছিলেন প্রধান দেবতা এবং দেবতাদের অধিপতি। রা-এর শরীর মানুষের হলেও মুখটি বাজপাখির, ... মাথায় একটি সূর্যচাকতি যা ঘিরে পবিত্র গোখরা সাপ । যে কারণে প্রাচীন মিশরের ফারাও তুতানখামুন-এর কপালে গোখরা সাপ শোভা পেত ... প্রাচীন মিশরবাসী বিশ্বাস করত রা-এর ক্ষমতা লুকিয়ে আছে তাঁর পবিত্র নামে। এই গুপ্ত নাম কেবল রা-ই জানেন। এ ভাবে প্রাচীন মিশর পরবর্তী সেমেটিক ধর্মসমূহকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল ...
প্রাচীন মিশরের মানচিত্র। নীল নদ, পিরামিড ও মমির দেশ মিশর। যে দেশটি সম্পর্কে আজও মানুষের আগ্রহের যেন শেষ নেই। প্রাচীন মিশরের মমিভিত্তিক পরকালবাদী অভিনব ধর্মটি আজও আমাদের মনে গভীর বিস্ময়ের সৃষ্টি করে ... সেই সঙ্গে প্রাচীন মিশরীয় দেবদেবীগনও কম রহস্যময় নয় ...
রা-এর শরীরটি মানুষের হলেও মুখটি বাজপাখির।
কেন?
কারণ রা ছিলেন প্রধান দেবতা এবং দেবতাদের অধিপতি। তাঁর অবস্থান অনেক উচ্চে মনে করা হত। উড়ন্ত বাজপাখি যেমন মাটির অনেক ওপরে বিচরণ করে, ঠিক তেমনি ...
বাজপাখি। রা এর প্রতীক।
প্রাচীন মিশরে এমন একটি ধারণা প্রচলিত ছিল যে-সূর্যদেব রা মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। উদিত সূর্য ছিল সেই সৃষ্টির প্রতীক। প্রাত্যহিক সূর্যের আবর্তন যেন নবজন্মের কথাই মনে করিয়ে দেয়। যে কারণে রা-কে মনে করা হত জীবনের উৎস এবং পরম শক্তির আধার। রা-এর একজন ঘনিষ্ট সহযোগী ছিলেন ন্যায়বিচারের দেবী মাত । মাত ছিলেন শৃঙ্খলা ও সত্যের প্রতীক।
রা-এর নৌকা।
নৌকায় চড়ে আকাশপথে ভেসে বেড়ান রা। সেই নৌকার নাম Barque of Millions of Years ... প্রাচীন মিশরের মানুষ এমনই কল্পনা করেছে। প্রতিদিন দিনের শেষে রা-এর জীবনপ্রদীপ যেত নিভে। অবশ্য তাঁর পাতালদেশে রাত্রিকালীন ভ্রমন অব্যাহত থাকত, এবং চাঁদকে তিনি রেখে যেতেন আলো বিলাতে। নৌকাটিকে পাতালদেশের ১২ টি দরজা অতিক্রম করতে হত। ১২ টি দরজা মানে রাত্রির ১২ ঘন্টা। অবশ্য পরের দিন ভোরে রা আবার জন্ম নিতেন।
মিশরের অধিবাসীরা বিশ্বাস করত রাতের বেলা আকাশদেবী নুট রা-কে গিলে খেত। এবং ভোরে পুর্নজন্ম হত। রা কে বলা হত Re-Horakhty ... এর মানে দিগন্তের হোরাস। হোরাস ছিলেন প্রাচীন মিশরের আরেক সূর্যদেবতা।
অবশ্য রা-এর দিবাকালীন যাত্রা সব সময় নিরাপদ ছিল না। কেননা, দিনের বেলায় প্রধান শক্রর সঙ্গে যুদ্ধ বেঁধে যেত। সেই প্রধান শক্র ছিল সাপ। সেই সাপের নাম আপেপ। অন্য হিংসুটে দেবতারা সাহায্য করত আপেপ কে। এরা হলেন-সেথ এবং বাসতেত।
আপেপ।
দেবতা রা-এর কপালে সূর্যচাকতি যা ঘিরে পবিত্র সাপ-গোখরা। এর কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। দেবতাদের অধিপতি সূর্যদেবতা সাপকে ডরাবেন কেন-সাপ তো আমি কপালে রাখি!
ফারাও তুতানখামুন এর কপালে গোখরা। প্রাচীন মিশরের শাসকশ্রেণি- অর্থাৎ ফারাও দের সঙ্গে রা-এর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ট। এর অন্যতম কারণ হল- রা মহাবিশ্বের শাসক, ফারাও বিশ্বের। কাজেই দুজনের বৈশিষ্ট্য অভিন্ন। যে কারণে মর্তে রা-এর মিরর ইমেজ ছিলেন ফারাও । এই কারণেই প্রাচীন মিশরে ফারাও কে মানব-ঈশ্বর মনে করা হত।
প্রাচীন মিশরের প্রধান দেবতা রা-এর ক্ষমতা এক বিচিত্র উপায়ে রূপান্তরিত হয়েছিল।
এবার সে প্রসঙ্গে আসি।
বৃদ্ধ বয়েসে রা একবার সংঙ্কুচিত হয়ে যান। আইসিস তখন রা-এর লালা সংগ্রহ করে সেই লালাকে সাপে পরিনত করেন। (আইসিস ছিলেন মিশরীয় মাতৃদেবী। ওসিরিস এর বোন এবং স্ত্রী এবং হোরাস এর মা ...) রা যেখানে ঘুম থেকে ওঠে সেখানে সাপটিকে লুকিয়ে রাখেন আইসিস । রা পা দিলে সাপ রা-কে ছোবল। রা প্রচন্ড যন্ত্রনায় চিৎকার করে ওঠেন। মর্মান্তিক চিৎকার শুনে দেবতারা সব ছুটে আসেন। কিন্তু কেউই রা-এর ব্যথা কমাতে পারে না। তখন চতুর আইসিস বললেন, তুমি তোমার গুপ্ত নামের অর্থ আমাকে বল। তাহলে আমি তোমায় যাদুবলে সারিয়ে তুলব ... রা-এর ইচ্ছে ছিল না গুপ্ত নামের অর্থ বলার কিন্তু খুব যন্ত্রনা হচ্ছিল। নিরূপায় হয়ে রা তাঁর গুপ্ত নামের অর্থ বললেন। সে অর্থ জানতে পেরে আইসিস তাঁকে মন্ত্রবলে সারিয়ে তোলেন।
এর পর থেকে রা-র ঐশ্বরিক ক্ষমতা আইসিস এর হাতে চলে যায়।
আইসিস। বলা হয়েছে ...generally depicted wearing a cow's horns bearing a golden disk representing the sun. রা-র ঐশ্বরিক ক্ষমতা আইসিস এর হাতে চলে যায় বলেই সোনালি চাকতি আইসিসের মাথায় শোভা পায় ...প্রাচীন মিথ এমনই বিস্ময়কর।
রা-এর এরকম শক্তির রূপান্তর প্রাচীন মিশরে আরও একবার ঘটেছিল। যেমন আমুন ছিলেন মেমফিস এর (প্রাচীন মিশরের একটি স্থানের নাম) স্থানীয় উর্বরতার দেবতা। কালক্রমে সূর্যদেব রা এর সঙ্গে মিশে আমুন-রা হয়ে উঠেছিলেন আমুন ।
রা-এর প্রশংসা করে অজস্র গীত রচনা করা হয়েছিল প্রাচীন মিশরে।
পিরামিডের দেওয়ালে সেসব প্রশংসা-গীত লেখা রয়েছে। তারই একটি তে বলা হয়েছে -
প্রণতি তোমায়, যে তুমি রা রূপে উদিত হও দিগন্তে
হে, অনঢ় এবং অপরিবর্তনীয় বিধানের কর্তা
প্রতিটি চক্ষু আকাশপথে ভাসমান তোমায় দেখে
অবশ্য তুমি তাহাদের দৃষ্টি হইতে রহ অদৃশ
তাহাদের সাক্ষাৎ দান কর উষালগ্নে
সম্মানিত রা ভাসমান আলোর নৌকায় যায় ভেসে
রক্তিম এবং হলুদ রশ্মি ছড়ায় দিগদিগন্তরে
যে আলোককে জানা যায় না, এমনই অপার্থিব (সে আলোক)
যে তুমি দুর্নিবার অতিক্রম করো আকাশের আলোকময় পথ ...
দেবতাদের জন্মভূমি যে আলোকের প্লাবনে যায় ভেসে
ছবি: ইন্টারনেট।
তথ্যসূত্র:
http://www.egyptartsite.com/ra.html
http://www.touregypt.net/featurestories/re.htm
http://www.thenileandegypt.com/deities.html
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:১২