somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গ্রিকপুরাণ: নিষ্পাপ কুমারী অ্যামিমোন-এর উপাখ্যান

২৩ শে মে, ২০১১ সকাল ১০:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অ্যামিমোন। নিষ্পাপ অ্যামিমোন নামে পরিচিত। নিষ্পাপ। কেননা, পিতার আদেশ উপেক্ষা করে বাসররাতে স্বামীকে হত্যা করেনি অ্যামিমোন। কেন করেনি? উপকথা সে ব্যাখ্যা করেনি। তবে আমরা নিষ্পাপ অ্যামিমোন-এর মনোভাব বুঝতে পারি । অ্যামিমোন বাসররাতে স্বামীকে হত্যা করেনি বলে আজও মানুষ তাকে মনে রেখেছে অথচ তার অন্যান্য বোনদের কথা মনে রাখেনি - যারা বাসররাতে স্বামীকে হত্যা করেছিল । অ্যামিমোন- এর নামে একটি সুন্দর প্রজাপতির নামও রেখেছেন জীব বিজ্ঞানীরা। । গ্রিক পুরাণে অ্যামিমোনে অবশ্য হাইপার্মনেষ্ট্রা নামেও পরিচিত।





ভূমধ্যসাগর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানচিত্র। দক্ষিণে প্রাচীন মিশর। উত্তরে গ্রিস। ওই দুটি অঞ্চলের সঙ্হে প্রাগৈতিহাসিক কালেই নৌযোগে যাতায়াত ছিল। পুরাণেও সেই কথা উঠে এসেছে।

পুরাকালে মিশরের বেলুস নামে এক ফারাও (স¤্রাট) ছিলেন । তার দুই যমজ ছেলে ছিল । একজনের নাম ডানাউস এবং অন্যজনের নাম ঈগিপ্তাস। ডানাউস পঞ্চাশ কন্যা ছিল এবং ঈগিপ্তাস-এর পঞ্চাশ পুত্র ছিল । রাজা বেলুস তার মৃত্যুর পূর্বেই ডানাউস এবং কে ঈগিপ্তাস
দুটি রাজ্য দান করেছিলেন। ঈগিপ্তাস পেল লিবিয়া এবং ডানাউস মিশর । তবে ক্ষমতা লোলুপ ঈগিপ্তাস মিশর আক্রমন করে । আতঙ্কিত ডানাউস একটি জাহাজ তৈরি করে। এবং সে জাহাজে পঞ্চাশ কন্যাকে নিয়ে অথই সাগরে (ভূমধ্যসাগর) পাড়ি জমালেন।
গ্রিক উপকথামতে এটিই মানবজাতির প্রথম জাহাজ।
জাহাজটি গ্রিসের আর্গো পৌঁছল।



গ্রিসের মানচিত্রে আর্গোর অবস্থান। তৎকালে আর্গো শাসন করতেন রাজা পেলাসগাস। ডানাউস রাজা পেলাসগাস- এর কাছে আশ্রয় চাইলেন। রাজা পেলাসগাস স্বৈরাচারী ছিলেন না। তিনি ডানাউসকে আশ্রয় দেবেন কিনা সে বিষয়ে ভোটের আয়োজন করলেন। গনতন্ত্রমনা গ্রিকরা ডানাউস কে আর্গোতে আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে ভোট দিল।

ডানাউস আর্গোতে ছোট্ট বসতি গড়ে তুললেন। তবে নতুন এক সমস্যার মুখোমুখি হলেন। আর্গো রাজ্যে বিষম খরা চলছিল। নদী-নালায় কোথাও পানি নেই। গ্রিক পুরাণে এই ভয়াবহ খরা Argives drought বলে পরিচিত। খরার কারণ ছিল দেবতাদের মধ্যে বিরোধ। বিশেষ করে সমুদ্র দেবতা দেবতা পোসাইদোন এবং জিউসপতœী দেবী হেরার মধ্যে সংঘাত। আর্গোর নদী দেবতা ছিলেন ইনাচুস। দেবতা ইনাচুস হেরার পক্ষ নিয়েছিলেন। এতে দেবতা পোসাইদোন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে আর্গোর সমস্ত নদী ও জলাশয় শুকিয়ে ফেলেন।
ডানাউস তার পঞ্চাশ কন্যকে জলপাত্র দিয়ে পানির খোঁজে পাঠালেন।
একেক জন একেকদিকে পানির খোঁজে গেল।
অ্যামিমোনও জলপাত্র নিয়ে হাঁটছিল।
হাঁটতে হাঁটতে লার্না নামক একটি যায়গায় উপস্থিত হল অ্যামিমোন।
লার্না জায়গাটা আর্গোর কিছু উত্তরে।



প্রাচীন গ্রিসের মানচিত্রে লার্নার অবস্থান। এখানেই পানির সন্ধান করছিল অ্যামিমোন। এখানেই বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার ।

লার্নার প্রান্তরে একটি পুরুষ হরিণ দেখতে পায় অ্যামিমোন । এ বিষয়ে গ্রিসের উপকথা লিখেছে she shot at it ...। তার মানে কি অ্যামিমোন এর হাতে তীরধনুক ছিল? যাক হোক। তীর গেল ফসকে । কাছেই ঘুমিয়ে ছিল এক স্যাটার। তীর ফশকে তার গায়ে বিঁধল।


স্যাটার। গ্রিক পুরাণে অরণ্যশ্বাপদ। এটির মাথা এবং শরীর মানুষের কিন্তু কান শিং এবং পা ছাগলের। লাম্পট্য এবং মদ্যপ রঙ্গ কৌতূকের জন্য স্যাটার আলোচিত।

গায়ে তীর বিধঁলে ঘুমন্ত স্যাটার উঠল জেগে ।
প্রানভয়ে দৌড়ে তে থাকে অ্যামিমোন ।
অ্যামিমোন কে তাড়া করতে থাকে স্যাটার।
অ্যামিমোন চিৎকার করতে থাকে-
কে কোথায় আছ! বাঁচাও! বাঁচাও!



অ্যামিমোন এবং দেবতা পোসাইদোন।

দেবতা পোসাইদোন কাছেই ছিলেন।
তিনি এগিয়ে এসে অ্যামিমোন কে রক্ষা করলেন ।
তারপর অ্যামিমোন কে লার্নার জলপ্রপাত দেখিয়ে দেন সমুদ্রের দেবতা।



স্যাটার প্রাণিটি কেবল প্রাচীন গ্রিসের উপকথায় নয় এই একুশ শতকেও সাহিত্য ও চলচ্চিত্রেও দেখতে পাওয়া যায় । সি এস লুইস- এর ফ্যান্টাসি উপন্যাস অবলম্বনে ২০০৫ সালে চিত্রায়িত ‘দ্য ক্রনিকলস অভ নারনিয়া’ ছবিতেও স্যাটারকে দেখা যায়।

আমরা জানি উপকথার নানারকম ভাষ্য হতে পারে।
লার্নায় অ্যামিমোন এবং দেবতা পোসাইদোন উপাখ্যানের অন্য এক ভাষ্য হল: ...অ্যামিমোন পানির খোঁজে এসে লার্নার প্রান্তরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে একটি স্যাটার দেখতে পেয়ে চিৎকার করে ওঠে। দেবতা পোসাইদোন কাছেই ছিলেন। তিনি স্যাটার লক্ষ করে ত্রিশূল ছুড়ে মারলেন। ত্রিশূল ফশকে একটি পাথরের ওপর বিধঁল। স্যাটার পালিয়ে যায়। দেবতা কুমারী অ্যামিমোন কে জড়িয়ে ধরে সান্ত¦না দেন। দেবতার স্পর্শে কুমারী অ্যামিমোন কেঁপে ওঠে। দেবতা পোসাইদোন হাঁটতে হাঁটতে পাথরের কাছে পৌঁছে ত্রিশূল টেনে তোলার সময়ই ত্রিমূখী জলধারা উৎসারিত হয়।
আজও সেই জলধারা ‘অ্যামিমোন কুয়া’ নামে পরিচিত।
যা হোক। দেবতা পোসাইদোন কুমারী অ্যামিমোন-এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। দু’জনে নির্জন লার্নার প্রান্তরে প্রেমে ভেসে গিয়েছিল।। সেই প্রেমের ফসল নাওপিলিয়াস নামে এক পুত্র সন্তান। সে পরবর্তীকালে নাওপিলিউস নামে একটি নগরের পত্তন করেছিল। নাওপিলিউস নগরটি এখন অবশ্য নাফপ্লিও নামে পরিচিত।
উপকথা এমনই বিচিত্র ...



গ্রিসের নাফপ্লিও শহর।

যদি এ উপকথার সূচনার কথাগুলি মনে থাকে ...অ্যামিমোনে- এর বাবা ডানাউস ...তার যমজ ভাই ঈগিপ্তাস ... যার পঞ্চাশ পুত্র ছিল। ঈগিপ্তাস -এর আক্রমনে মুখে মিশর থেকে জাহাজে করে গ্রিসের আর্গোতে পালিয়ে এসেছিল ডানাউস ...
আর্গো উপকূলে এক জাহাজ ভিড়ল।
সেই জাহাজ থেকে নামল ঈগিপ্তাস-এর পঞ্চাশ পুত্র ।
তারা ডানাউস-এর মেয়েদের বিয়ে করতে এসেছে।
ডানাউস রাজি হননি। কারণ তিনি ভাইয়ের অপকর্ম ভুলে যান নি।
প্রত্যাখাত হয়ে ঈগিপ্তাস-এর পুত্ররা আর্গো রাজ্য জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করার হুমকি দিল।
ডানাউস চিন্তিত হয়ে পড়লেন। রাজা পেলাসগাস-এর কথা মনে পড়ল তার । মিশর থেকে গ্রিস পৌঁছার পর আমাকে রাজা পেলাসগাস আশ্রয় দিলেন। এখন দুরাচারী ঈগিপ্তাস এর পঞ্চাশ পুত্র আর্গো রাজ্য আক্রমন করলে রাজা কি ভাববেন। আমি এখন কি করি। আমাকে একটা উপায় বের করতেই হবে।
ডানাউস বিয়েতে সম্মত হলেন। তারপর মেয়েদের ডেকে সমস্ত খুলে বললেন। প্রত্যেক মেয়েকে একটি করে ক্ষুরধার ছুরি দিলেন। তারপর বললেন, বিয়ের রাতেই বরদের হত্যা করবে।
মেয়েরা বাসর রাতে স্বামীকে হত্যা করতে সম্মত হয়।
অ্যামিমোন এর বিয়ে হয় লিনসিউস- এর সঙ্গে। তবে অ্যামিমোন তার স্বামীকে হত্যা করে না। লিনসিউস প্রাণে বেঁচে যায়। এতে ডানাউস ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। অ্যামিমোন কে অন্ধকার কারাগারে নিক্ষেপ করেন।
পরবর্তীকালে অবশ্য দেবী আফ্রোদিতির হস্তক্ষেপে অ্যামিমোন কারাগার থেকে বেরিয়ে আসে।
ডানাউস- এর উনপঞ্চাশজন কন্যাই তাদের স্বামীদের হত্যা করেছিল। সে কারণে পাতালপুরীতে তাদের সাজা দেওয়া হয় । তাদের শাস্তি ছিল বিচিত্র। তলায় ছিদ্রবিশিষ্ট একটি পাত্রে অবিরাম পানি ভরে যাওয়া।



১৯০৩ সালে আঁকা ইংরেজ প্রি-রাফালাইট চিত্রকর জন উইলিয়াম ওয়াটারহাউজের (১৮৪৯ ১৯১৭) The Danaides । ডানাউস -এর কন্যারা The Danaides নামে পরিচিত।



এই প্রজাপতির নাম অ্যামিমোন ।



অ্যামিমোন এবং দেবতা পোসাইদোন।



সাইপ্রাসের ডাকটিকিটে অ্যামিমোন এবং দেবতা পোসাইদোন। মানুষ এভাবে উপকথাকে ধরে রাখে।

ছবি: ইন্টারনেট।

তথ্যসূত্র:

ফরহাদ খান: প্রচীত্য পুরাণ

http://www.paleothea.com/
http://www.theoi.com/Heroine/Amymone.html
http://en.wikipedia.org/wiki/Amymone
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×