somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: নাট্যকার

২১ শে নভেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাত বছর পর মানসকে দেখে চমকে ওঠে বর্ষা । তখন কক্সবাজারের সি বিচে শেষবেলার ম্লান ছায়া ঘনিয়ে উঠছিল । আর ছিল সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের আর্তনাদ; সেই সঙ্গে এলোমেলো বাতাসের লুটোপুটি। বর্ণিল আকাশটা যেন চিত্রকরের ক্যানভাস।
মানস ছাতার পাশে দাঁড়িয়ে অস্তগামী সূর্যটার দিকে তাকিয়ে ছিল। লম্বা ফরসা মানসকে চিনতে ভুল হয়নি বর্ষার। কালো রঙের প্যান্ট আর নীল সোয়েটার পরে আছে মানস। গায়ে সাদা রঙের চাদর জড়ানো। একমুখ চাপদাড়ি, মাথায় কোঁকড়া চুল। মানসের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কেমন ঘোর লাগে বর্ষার । আড়চোখে আদিত্যর দিকে তাকায় ও। আদিত্য ওর পাশে হাঁটছিল। এই মুহূর্তে ফুরফুরে মেজাজে আছে আদিত্য। ওর দিকে লোকজন তাকাচ্ছে। জনপ্রিয় টিভি নাট্যকার আদিত্য করিমকে অনেকেই চিনতে পারছে। বাংলাদেশে আদিত্য করিমের লেখা নাটক তুমুল জনপ্রিয়। হূমায়ূন আহমেদ- এর পর এখন আদিত্য করিম- এর যুগ কিনা- অনেকবারই টিভিতে এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে আদিত্যকে। একুশে সন্ধ্যায় কি বাংলা ভিশনে অসংখ্যবার সাক্ষাতকার দিয়েছে আদিত্য। সম্প্রতি এটিএন নিউজের এক টকশোতে সড়ক দূর্ঘটনা নিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছে। সৈকতে বেড়াতে আসা অনেকেই আদিত্যকে চিনতে পেরে দূর থেকে হাত নাড়ছে। এই একটু আগে একজন কিশোরী আদিত্যর কাছে ছুটি এসেছিল । চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ স্তব্দ হয়ে ছিল। অতি কষ্টে কান্না আটকেছে। অবরুদ্ধ কন্ঠস্বরে বলল, আপনি ... আপনি এত সুন্দর লেখেন। আদিত্য হেসেছিল। বর্ষা তখন মিটিমিটি হাসছিল। বর্ষা এমন পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত। বিয়েবাড়ি কিংবা জন্মদিনের অনুষ্টানে কিংবা শপিংমলে আদিত্যর ফ্যানরা এমন করে আদিত্যকে ঘিরে ধরে। বর্ষার তখন চাপা আনন্দ হয়।
বেলাশেষের সামুদ্রিক লোনা বাতাসে বর্ষার শাড়ির আঁচল উড়ছিল। ঘিয়ে রঙের কার্ডিগেন পরেছিল বর্ষা। সময়টা নভেম্বরের মাঝামাঝি। শীতের মরসুম শুরু। বাতাস সুযোগ বুঝে দাঁত বসায়। সূর্য ডুবতে খানিকটা দেরি। সি বিচে বেশ ভিড়। অদ্ভূত সুন্দর বর্ণিল আকাশের দিকে চেয়ে ভিড়ের দিকে তাকাতেই দূর থেকে মানস কে দেখতে পেয়ে চমকে উঠেছিল বর্ষা । তারপর বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে আদিত্যকে বলল, তুমি এখানে একটু দাঁড়াও। আমি এখুনি আসছি।
কি হল তোমার? কোথায় যাবে? আদিত্য অবাক হয়ে যায়।
প্লিজ। এসে সব তোমাকে বলছি। বলে বর্ষা দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায়।
আদিত্য বিস্মিত হলেও বেশিক্ষণ অবশ্য বিস্ময়ের অবকাশ পেল না। কেননা, ওর সামনে হলুদ রঙের সালোয়ারকামিজ পরা একজন তরুণি এসে দাঁড়িয়েছে। আদিত্যর চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ স্তব্দ হয়ে রইল মেয়েটি । অতি কষ্টে কান্না আটকে অবরুদ্ধ কন্ঠস্বরে বলল, আপনি ... আপনি এত সুন্দর লেখেন কীভাবে। বলে আদিতকে ছুঁয়ে গেল।
আদিত্যর লেখা নাটক মেয়েরা পছন্দ করে বেশি। মেয়েদের কিশোরী বয়েসের কথা আদিত্যর নাটকে ফুটে ওঠে। বিশেষ করে কলেজ জীবনকে ঘিরে কিশোরীর প্রেমের গল্পই আদিত্যর নাটকের মূল থিম। সেই সঙ্গে আবেগ ঘন সংলাপ তো আছেইনাটক মেয়েদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আদিত্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই মেয়েটি যদি যদি জানত আসল নাট্যকার কে - তাহলে নিশ্চয়ই ভীষণ অবাক হয়ে যেত। নাটক আদিত্য লেখে না। আদিত্যর সব নাটকই বর্ষা লিখে দেয় ... অবশ্য আদিত্যর নামে। খুব কম লোকই জানে এটা। বর্ষার জন্যই আদিত্য আজ ঈর্ষণীয় খ্যাতির চূড়ায় উঠেছে ।
বর্ষা ভিজে বালির ওপর হাঁটছে। পা দুটো ভীষণ ভারী ঠেকছিল ওর। শরীর অল্প অল্প কাঁপছিল। মাথার ভিতরে ক্ষীণ কুয়াশার মেঘ ছড়িয়ে আছে। মানস! এত দিন পর। আশ্চর্য!আহ্, সেই সব দিন ... যখন কিশোরী বয়েসে মানসের হাত ধরে ঘুরে বেড়াত ধলেশ্বরীর চরে। নারায়নগঞ্জের চাষাড়ায় থাকত বর্ষারা। কলেজ জীবনে সহপাঠী ছিল মানস । না, সাহপাঠী না-
মানস ছিল বর্ষার প্রথম প্রেম। কি যে গভীর ভাবে বর্ষা ভালোবাসত মানসকে। সেই স্মৃতি আজও অম্লান। বর্ষা মনে মনে ঈশ্বরকে অনুভব করে। মনের ভিতরে বাজে রবীন্দ্রনাথের গান: ‘মাঝেমাঝে তব দেখা পাই’। অনেক অনেক দিন আগে আগে যাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম সেই এখন আবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। একদিন যার সঙ্গে ঘর বাধার স্বপ্ন ছিল ...না সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আজও বাংলাদেশে রেহনুমা খানমের সঙ্গে সামাজিকভাবে মানস পাল-এর বিয়ে সম্ভব নয়। একবার ওই বয়েসের আবেগে বশে মানসের হাত ধরে পালাবার কথা ভেবেছিল বর্ষা । পালানো হয়নি। বড় ভাই লঞ্চ ব্যবসায় লাখ টাকা লস করল। বাবার তখন স্ট্রোক হয়ে গেল ... বর্ষার লেখা নাটকে মানস এর কথাই উঠে আসে । নাটক লেখার সময় কিশোরী জীবনে ফিরে যায় বর্ষা । মানসকে বর্ষা যা বলেছে কিংবা মনে মনে বলেছে কিংবা আজও মানসকে যে কথা বলা হয়নি ... বর্ষা সেই সব কথাই লিখে নাটকে। মানুষ প্রেমের গল্পই শুনতে চায়। বার বার। হাজারবার ...
বর্ষা পায়ের পায়ে মানসের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
মানস ঠিক চমকে না-উঠলেও অবাক হল ।
তুমি? এখানে? বলে মানস হাসল। বড় অপ্রস্তুত সে হাসি।
বর্ষা চুপ করে থাকে। ভাগ্যিস- ‘তুমি বর্ষা না?’ এমন হাস্যকর অগভীর কথা বলে নি মানস।
কেমন আছ? গভীর আবেগে বর্ষা বলে।
ভালো। বলে মাথা ঝাঁকায় মানস। বর্ষার ঘাড়ের ওপর দিয়ে আদিত্যর দিকে তাকায়। তারপর বলে, তুমি কেমন আছ?
আমি ভালো নেই। আমি ভালো আছি। বর্ষা বলে। তারপর বলে, এখন ... এখন কোথায় থাক তুমি? বেলাভূমির অস্থির পাজী বাতাস ওর কথা উড়িয়ে নেয় যেন। সমুদ্রের ওই দূর পাড়ে অল্প অল্প করে সূর্যটা ডুবছিল । বর্ষা অস্থির বোধ করে।
থাকি কুমিল্লা। টমসম ব্রিজের কাছে। মানস বলে।
বর্ষা ভাবছে-কি নাম ওর বৌয়ের। দেখতে কেমন? মানস কি সুখি? কি আশ্চর্য আমি এখন মানসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কত দিন পর। বর্ষা জিগ্যেস করে, কি করছ এখন?
কনট্র্যাক্টটারিই করি আর কী।
বিয়ে করনি?
না।’
কেন?
এখনও গুছায় নিতে পারি নাই। বলে মানস হাসল। মাথা ঝাঁকায়।
বর্ষা জিগ্যেস করে, এখানে মানে কক্সবাজারে কবে এলে?
মাসখানেক হইল । কক্সবাজারে একটা হোটেলের রড সাপলাইয়ের কাজ পাইছি।
ও। বলে মুখ ফিরিয়ে আদিত্যর দিকে তাকায় বর্ষা। আদিত্যকে একদল তরুণতরুণি ঘিরে আছে।
কে ও? তোমার হাজব্যান্ড? মানস জিগ্যেস করে।
হ্যাঁ। বীণা মাসী কেমন আছে? সুপ্তি?
মা মারা গেছে।
কবে?
গতবছর।
ওহঃ। আর সুপ্তি?
সুপ্তির বিয়ে হয়ে গেছে। ঈশ্বরদী থাকে।
মানসের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? আদিত্য ব্যাপারটা কিভাবে নিচ্ছে কে জানে। বর্ষার অস্থিরতা বাড়ছে। অস্থির বাতাসে মুখের ওপর চলে আসা চুল সরিয়ে বর্ষা বলল, আমি এখন যাই। তুমি ভালো থেকো।
মানস হাসল। বড় ম্লান সে হাসি।
বর্ষা দ্রুত পায়ে আদিত্যর কাছে ফিরে যেতে থাকে। ততক্ষণে সি বিচে দিনের আলো মুছে সন্ধ্যার অন্ধকার ফুটে উঠছিল। সূর্যটা দিগন্তে লালচে ছোট টেনিস বলের মত হয়ে আছে। ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস বাড়ছে দূর দিগন্তে উদীয়মান চাঁদের আকর্ষনে।
আদিত্যকে ওর ফ্যানরা ঘিরে রেখেছিল বলে তখনই সেই অনিবার্য প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হল না বর্ষাকে। আদিত্য ক্যাপ পরা ছড়ি হাতে সাহেবী চেহারার একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছে। ভদ্রলোক জিগ্যেস করছেন, আপনি কাফকা পড়েছেন কি? উত্তরে আদিত্য কী যেন বলছে।
তখুনি বর্ষার মোবাইলের রিং টোনটা বেজে উঠল। রাসেল ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। শর্ট ফিলমের স্ক্রিপ্টের কথা তোর মনে আছে তো? কাজ শুরু করে দে। উর্মি অস্থির হয়ে আছে। আমরা অনেক কষ্টে জয়া আহসানকে অভিনয় করাতে রাজি করিয়েছি ... কলকাতায় ‘গেরিলা’ হিট হওয়ার পর তো জয়া আহসান এখন আকাশে উড়ছে ... এনি ওয়ে ... তোদের কক্সবাজার ভ্রমন সুখকর হোক।
বর্ষা ম্লান হাসল। রাসেল আদিত্যর কাজিন। জাহাঙ্গীরনগরে বর্ষার ক্লাসমেট ছিল। রাসেল আর রাসেলের বউ উর্মি অবশ্য জানে- নাটক আদিত্য লেখে না, লেখে বর্ষা । রাসেল আর উর্মি মিলে ‘অন্তরা’ নামে একটা প্রোডাকশান হাউজ দিয়েছে। উর্মি চ্যানেল আই’র সাগর ভাইকে চেনে। উর্মির ইচ্ছে চ্যানেল আই’র জন্য শর্ট ফিলম করবে।
এরই মধ্যে সূর্যটা টুপ করে ডুবে যায়। এই মুহূর্তটা বর্ষার ভালো লাগে। আজ অবশ্য ভালো লাগছে না।
দু’দিন হল বর্ষা আর আদিত্য কক্সবাজার এসেছে। রাতে বাইরে কোথাও খেয়ে খেয়ে। এখন রেস্তঁরার দিকে যেতে যেতে আদিত্য বলল, কে ছেলেটা ? কন্ঠস্বর কেমন গম্ভীর শোনায়।
ওহ্! ওর নাম মানস। আমার ক্লাসমেট। মানে আমরা একই কলেজে পড়তাম । আমরা তখন নারায়নগঞ্জে থাকতাম। মানসের মা বীণামাসী আমায় খুব ভালোবাসত। আজ শুনলাম তিনি মারা গেছেন।
ও। আদিত্যর মুখ কেমন গম্ভীর হয়ে উঠল। ।
বর্ষা ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে। আজ আদিত্যর সামনে মানসের সঙ্গে দেখা করা কি ঠিক হল? অন্যায় তো কিছু হয়নি। আদিত্য তো বন্ধুর মত। জাহাঙ্গীরনগর পড়ার সময় পরিচয়। বর্ষা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ পড়ছিল সমাজবিজ্ঞানে। বর্ষার তখনও এম এ-টা কমপ্লিট হয়নি। রাসেলের জন্মদিনে প্রথম দেখেছিল আদিত্যকে। প্রথম দেখায় ভালো লেগেছিল বলে বর্ষাই আগ্রহী হয়ে মোবাইল নম্বর এক্সচেঞ্জ করেছিল। বর্ষা তখন একটা চাকরি আর বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। আদিত্যকে দেখে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিল। মানসের কথা কখনও আদিত্যকে বলা হয়নি। আজ কি মানসের কথা আদিত্যকে বলব? কেন নয়? আজ যে আদিত্য করিমকে লোকে চিনছে সে তো বর্ষার জন্যই।
কলাতলী সৈকত ঘেঁষে নতুন একটি রেঁস্তরা হয়েছে। নাম: ‘রূপচান্দা।’ ছিমছাম রেঁস্তরা । রূপচান্দা মাছের জন্য বিখ্যাত। ভিতরের পরিবেশ বেশ অদ্ভুত। কেমন ভুতুরে জাহাজ বলে মনে হয়। কাঠের পাটাতন। বেড়ার দেয়ালে ঝোলানো লন্ঠন। ম্লান আলোয় কাউন্টারে একটি আদিবাসী মেয়ে বসে। রাখাইন সম্ভবত।
ওরা রূপচান্দায় ঢুকে পিছনের একটা টেবিলে বসল। একটু পর একটি অদ্ভূত সুন্দরী মেয়ে অর্ডার নিতে এল। এও কি রাখাইন?
বর্ষা অর্ডার দিল, রূপচান্দা ফ্রাই। নান আর সালাদ।
ফালুদা আছে ম্যাডাম। দেব?
বর্ষা আদিত্যর দিকে তাকায়। আদিত্য মাথা নাড়ে। বর্ষা বলে, না। থাক । শীত পড়ে গেছে। ওর আবার ঠান্ডার ধাত আছে।
কফি?
ওকে।
থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। বলে মেয়েটি চলে যায়।
রেঁস্তরার লোকজন আড়চোখে এদিকে তাকাচ্ছে। বর্ষা উপভোগ করে। এরা যদি জানত আসলে কে নাটক লেখে। ... তখনও ওদের বিয়ে হয়নি। আদিত্য জগন্নাথ থেকে পাস করে বেরিয়ে একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কে জয়েন করেছে। অবসর সময়ে বর্ষার সঙ্গে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়। আর নাটক লেখে। একটা-দুটো চ্যানেলে সে নাটক প্রচারিত হয়েছে। একবার আদিত্যর টাইফয়েড হল। ঘোর জ্বরে অচেতন। প্রযোজক ঘন ঘন ফোন করছে। নাটকের স্ক্রিপ্ট দেবে বলে অগ্রীম বাবদ কিছু টাকা নিয়েছিল আদিত্য। বর্ষা রাতারাতি একটা নাটক লিখে আদিত্যর নাম জমা দিয়েছিল। (নাটক লেখার সময় মানসের মুখটা ভাসছিল। ওর বাবা কুমিল্লায় জমি কিনেছেন। চলে যাবেন ...এই বিরহ ফুটিয়ে তুলেছিল নাটকে ) ... সেই শুরু। তার পর থেকে আদিত্য করিম-এর নাটক মানেই হিট ... ২০০৯ সালের মাঝামাঝি এন টিভি তে ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ নামে ধারাবাহিক নাটক লেখার অফার পেল আদিত্য । স্পন্সর করল বাংলা লিঙ্ক। নাটক লিখে গ্রিন ডেলটা পুরস্কারও পেল আদিত্য। হয়তো তখন আদিত্য অনুশোচনায় ভুগছিল। তখন একবার আদিত্য বর্ষাকে বলেছিল, এবার সবাইকে সত্যি কথা বলে দিই । সবাই জানুক নাটক আসলে তুমিই লেখ।
না।
না কেন?
আমার লোকজনের ভিড়টির ভালো লাগে না। সত্যি কথা সবাই জানলে আমাকে টিভিতে ডাকবে। আমার টিভিতে মুখ দেখাতে লজ্জ্বা করে।
আশ্চর্য! এ কেমন কথা।
আমি এমনই।
বিধবা মাকে নিয়ে পাবনায় মামার বাড়ি মানুষ আদিত্য । (আদিত্য করিম ওর ছদ্মনাম। আদিত্যর আসল নাম গোলাম মওলা বাচ্চু) ঢাকা শহরে টিউশনি করে কোনও বেলা খেয়ে না -খেয়ে জগন্নাথ থেকে পাস করে ব্যাঙ্কের চাকরি জুটিয়েছিল। সেই আদিত্য কে ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে দিতে হল।বর্ষা নাটক লেখার পর আর টাকার অভাব নেই। বর্ষা একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে ঢুকেছিল। নাটক লেখার জন্যেই স্কুলটা ছাড়তে হল । পান্থপথে ছিমছাম একটা ফ্ল্যাট থাকে ওরা। অবশ্য ভাড়া। সেগুনবাগিচার কাছে একটা ফ্ল্যাট কিস্তিতে কিনছে। গাড়িও কিনেছে। গত বছর বিয়ে করল। বিয়ের পর গত অক্টোবরে নেপাল ঘুরে এল। সবই তো বর্ষার জন্য। এখন মানসের কথা আদিত্যকে বলা যাবে না কেন?
সেই রাখাইন মেয়েটি খাবার দিয়ে গেছে। আদিত্য সিগারেট ধরিয়েছে। অল্প অল্প করে বিষাদ কাটছিল বর্ষার। কাঁটাচামচ দিয়ে অল্পখানি রূপচান্দা ভেঙে মুখে ফেলল। চমৎকার স্বাদ। বর্ষা বলল, আদিত্য, আজ তোমাকে একটা সত্য কথা বলব।
বল। আদিত্য খাচ্ছে না। কাঁটাচামচ দিয়ে রূপচান্দার শরীর ফালা ফালা করছে।
আমার নাটকে আমি মানসের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথাই লিখি।
আদিত্যর মুখটা কেমন কালো হয়ে উঠল। থমথম করছে। আদিত্যর পরিবর্তন লক্ষ করে বিস্মিত হয় বর্ষা। অথচ ...অথচ ওকে কেবল স্বামী না। বন্ধু ভাবে বর্ষা। বর্ষা শ্বাস টানে।
আদিত্য সামান্য ঝুঁকে চাপাকন্ঠে বলল, ছিঃ বর্ষা। একটা হিন্দু ছেলের সঙ্গে ...
মুহূর্তেই বর্ষার চোখ দুটি ভিজে ওঠে। আদিত্যকে উদার ভেবেছিল। ভুল ভেবেছিল। ছিঃ! অনেক কথা বলার ছিল বর্ষার। বলল না। গলা চড়বে। লোকজন তাকাবে।
ওরা মুখোমুখি স্বামীস্ত্রীর মতো কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। তারপর খাওয়া শেষ না করে ওরা প্রাণহীন পুতুলের মতো রেঁস্তরা থেকে বেরিয়ে আসে।
সময়টা নভেম্বরের মাঝামাঝি বলে আজও আকাশে পূর্ণিমার একটা চাঁদ ওঠার কথা। সিবিচে সাদা জোছনা ছড়ানোর কথা। গতকাল রাতেও হোটেলে ফেরার আগে সিবিচে অনেকক্ষণ হেঁটেছে ওরা। আজ আর হাঁটবে না। আদিত্যকে ভীষণ গম্ভীর দেখাচ্ছে। হোটেলে ফেরার পথে আদিত্য একটা কথাও বলল না।
ওরা কলাতলীতে হোটেল সি বার্ড এ উঠেছে। অবশ্য ঢাকা থেকে বুক করে এসেছিল। বিশিষ্ট নাট্যকার আদিত্য করিম-এর বদৌলতে টপ ফ্লোরই পেয়েছে ওরা। অনেক রাত অবধি ওরা বারান্দায় বসে থাকে। আদিত্য ঘুমিয়ে গেলে বর্ষা লিখতে বসে। নোটবুকটা সঙ্গে এনেছে।
রুমে ঢুকে আদিত্য আজ আর বারান্দায় বসল না। বাথরুমে গেল একবার। তারপর আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়।
এর পর আদিত্যর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেমন হবে?
যখন আমার শরীরে ওর বীজ ধীরে-ধীরে বেড়ে উঠছে ...
বর্ষা তলপেট স্পর্শ করে ... শরীরে শিরশিরে একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে ...
রাসেল তখন একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল। মনে পড়ল। ওকে সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখে দিতে হবে। সাবধানে দরজা খুলে বর্ষা নোটবুক নিয়ে বারান্দায় এল। বারান্দায় এলোমেলো লোনা বাতাস। বড় শীতল সে বাতাস। বর্ষা কেঁপে উঠল একবার। দূরে বহু দূরে অবারিত জোছনার সমুদ্র। বুক ভরে শ্বাস নেয় বর্ষা। মনে বিষাদের ভারী পাথর। আজ আদিত্যর সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরল। আমার নাটকে আমি মানসের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথাই লিখি। ... এই কথা আমি বলতে গেলাম কেন? আমি আদিত্যকে সুখি করেছি বলে? তুচ্ছ ব্যাঙ্কার থেকে আকাশচুম্বি খ্যাতির চূড়ায় তুলে দিয়েছি বলে? কিন্তু আদিত্য এত কষ্ট পেল কেন? ভালোবাসা কি এমন? ভালোবাসাই তো? মানস হিন্দু? আশ্চর্য! কথাটা আজ প্রথম মনে হল। এর আগে কখনও মনে হয়নি। মনে হয়েছে মানস লাজুক একটা ছেলে, যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়, গোপনে লেখা কবিতা পড়ে শোনানো যায় ... ধলেশ্বরীর চলে শীতের অপরাহ্নে হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো যায়। ...বর্ষা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর মানসরা কুমিল্লা চলে যায়। মানসের বাবা সুবির মেসো কুমিল্লায় জমি কিনেছিলেন। বর্ষার বাবাও মারা গেলেন। বর্ষা মা আর ছোটবোনকে নিয়ে গাজীপুর বড় বোনের বাসায় চলে আসে। অনেক কম্প্রোমাইজ করে থাকত সে বাড়িতে। দুলাভাইয়ের লোভী চোখ বর্ষার শরীরে ঘুরঘুর করত। এসব যন্ত্রণা আর অপমান সহ্য করে জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হয়ে
রাসেলের থ্রুতে আদিত্যর সঙ্গে পরিচয় হল ... মানস অবশ্য মাঝেমাঝে ফোন করত। তবে সেভাবে আর যোগাযোগ থাকেনি ... আজই দেখল। সাত বছর পর।
বর্ষা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
বারান্দায় কতগুলি বেতের চেয়ার। বর্ষা বসল। কোলের ওপর নিয়ে ছোট্ট নোটবুকটা অন করে। ক্রিন কেমন ঝাপসা দেখায়। আমি কি কাঁদছি? ওয়ার্ড ফাইল ওপেন করে। বর্ষা ঠিক করেছে ও শর্ট ফিলমের নাম দেবে “অন্ধকারে নিঃসঙ্গ জোছনায়” ও লিখতে থাকে: প্রথম দৃশ্য ...কক্সবাজার সিবিচ। সন্ধ্যালগ্ন। সাত বছর পর বিকেলের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে তাপসকে দেখে অর্পার শরীর পাথরের মতো ভারী হয়ে উঠবে ...
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×