আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে বঙ্গোপসাগরের এই নির্জন উপকূলে বিশাল এক Tower block নির্মাণ করত মোরশেদ। আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে ...। মোরশেদ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। সময়টা নভেম্বরের মাঝামাঝি। পূর্ণিমার রাত। মোরশেদ বঙ্গোপসাগরের নির্জন উপকূলে একটি পুরাতন দূর্গের বিশাল অলিন্দের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে । তার চোখ দুটি বঙ্গোপসাগরে অবারিত জলরাশির দিকে স্থির; যেখানে ঝিকমিক করছিল জোছনার তরল জল । ওর ঠিক সামনে দুটো ফুট নিচে উপকূল। উপকূলে বড় বড় পাথর। পাথরগুলোর ওপর ঢেউ আছড়ে পড়ছে। তার ক্ষীন শব্দ ভেসে আসে । বালিয়ারিতে জোছনা আর কুয়াশা একাকার। বাতাসে শীতের নখর। মোরশেদ অবশ্য শীত টের পায় না। সে সিগারেট টানছিল। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর তার সিগারেটের মাত্রা বেড়ে গেছে।
পিছনে পায়ের শব্দ শোনা যায়। মোরশেদ পিছন ফিরে তাকায়। অলিন্দ থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে। তাহের মিয়া সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। হাতে ট্রে। সিঁড়ির শেষে ছোট চাতাল। তার ঠিক মাঝখানে ভার্জিন মেরির একটি ভাস্কর্য। তারপর কালো পাথরের বিশাল দূর্গ-দেওয়াল আর প্রবেশ পথ। ভিতরে প্রায় পঁচিশটি ছোট বড় কক্ষ। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় সাগরঘেঁষা এ এই পুরনো দূর্গ কে স্থানীয় লোকজন ‘দূর্গবাড়ি’ বলে। ষোড়শ শতকে বঙ্গোপসাগরে পতুর্গিজদের জাহাজ ভিড়েছিল । তারাই নির্মাণ করেছিল। আজকাল সারাদিনই দূর্গবাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখে মোরশেদ। দূর্গবাড়ির স্থাপত্য কৌশল তাকে বিস্মিত করে। মোরশেদ স্থপতি। আন্তর্জাতিক মহলে ফেরদৌস মোরশেদ-এর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। তার মৃত্যুর পরও হবে।
তাহের মিয়ার হাতে ট্রেতে কফির কাপ। মোরশেদ কফির কাপ নেয়। বৃদ্ধ তাহের মিয়া দূর্গবাড়ির কেয়ারটেকার। বৃদ্ধের পরনে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির ওপর একটা ঘিয়ে রঙের চাদর । বৃদ্ধ হলেও মাঝারি উচ্চতার শক্ত সমর্থ শরীর । ফরসা মুখে সাদা দাড়ি। মাথায় টুপি। তাহের মিয়ার বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ । ভাগ্যের অন্বেষণে উখিয়ায় এসেছিল। মোরশেদ দূর্গবাড়ির কেনার পর তাকে ছাঁটাই করেনি। বরং বেতন বাড়িয়ে দিয়েছে। তাহের মিয়া গম্ভীর ধরনের মানুষ। কথা কম বলে। কথা বললেও চাঁদপুরের ভাষায় বলে। ঠিক বোঝা যায় না।
মোরশেদ বলল, কাল দুপুরে আমার দু’জন গেস্ট আসবে। তুমি রান্নাবান্না করে রেখ।
তাহের মিয়া মাথা নাড়ে। তারপর চলে যায়। চাঁদপুর থেকে বিধবা মেয়েকে নিয়ে এসেছে তাহের মিয়া । মেয়ের নাম পরী। রান্না পরীই করে। তাহের মিয়া কনজারভেটিভ বলে তার মেয়ের ব্যাপারে আর আগ্রহ দেখায়নি মোরশেদ। অবশ্য দু-একবার পরীকে দেখেছে মোরশেদ। পিছনের অলিন্দে বসে চুল শুকাচ্ছিল। তখন। পরী দেখেতে অদ্ভুত সুন্দর। এত সুন্দর মেয়ে বিধবা হয় কি করে!
কফির কাপে চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরায় মোরশেদ। কাল মর্তুজা ওর বউকে নিয়ে আসছে। অনেক বছর পর দেখা হবে মর্তুজার সঙ্গে। বুয়েটে সহপাঠী ছিল মর্তুজা । মোরশেদ আমেরিকা চলে গেলেও যোগাযোগ ছিল। কয়েকদিন আগে মর্তুজা ফোনে জানাল যে ও উখিয়ায়। মোরশেদ তখন দূর্গবাড়ির ঠিকানা দিয়েছিল। মর্তুজা কে ক্যান্সারের কথা বলেছে মোরশেদ।
রাত বাড়ে। মোরশেদ অলিন্দ থেকে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে থাকে। সিঁড়ি ভাঙার সময় তার দূর্বল লাগে। মাঝেমাঝে আত্ব্যহত্যার কথা ভাবে মোরশেদ। শখ করে একটা দশমিক ৪৪ ম্যাগনাম-এর কোল্ট এনাকোন্ডা রিভলভার কিনেছিল শিকাগো থেকে। মার্কিন আর্কিটেকচারাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম Skidmore, Owings and Merrill -এর হেড কোর্য়াটার ওই শিকাগো শহরেই । ওই বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করত মোরশেদ। অ্যাবরিল ওর কলিগ ছিল। মেয়েটি ফ্রেঞ্চ। ২৮ বছর বয়েসি চশমা পরা ব্লন্ড মেয়েটি প্রেমে পড়েছিল মোরশেদ। চিনের নানজিং শহরে ১,৪৮০ ফিট উচুঁ গ্রিনল্যান্ড ফাইনানশিয়াল সেন্টারের কাজ পেয়েছিল Skidmore, Owings and Merrill । কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থপতি অ্যাড্রিয়ান স্মিথ কে। সেই টিমে মোরশেদ আর অ্যাবরিলও ছিল । কাজের ফাঁকে ওরা ঘুরে বেড়াত। তখন পৃথিবীকে মনে হয়েছিল স্বর্গ। তারপর অ্যাবরিল কেমন বদলে যায়। মোরশেদকে এড়িয়ে চলতে থাকে। তখন মোরশেদ-এর ক্যান্সার ধরা পড়ে। অ্যাবরিল কে পাশে পায়নি। অভিমানে চিকিৎসা করেনি। অ্যাবরিল-এর মুখটা মনে পড়লে মাঝেমাঝে আত্ব্যহত্যার কথা ভাবে মোরশেদ ...
অঞ্জলি দূর্গবাড়ি দেখে অভিভূত। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, বাব্বা ! এত বড় বাড়িতে আপনি একা থাকেন?
একা কোথায়? কেয়ার টেকার আছে। ওর মেয়েও আছে। মোরশেদ হেসে বলল।
অঞ্জলি হাসে। গভীর চোখে বিদ্যুতের ঝিলিক। মোরশেদ মুগ্ধ হয়। অঞ্জলি গায়ের রং শ্যামলা হলেও টানটান পেলব শরীরের চটক আছে। বয়স ২৫/২৬ এর বেশি না। অঞ্জলি আর্কিটেক্ট। কবিতাও লেখে। কবি পরিচয়টাই বড় করে তুলে ধরল। অঞ্জলি কে যতই দেখছে ততই মৃদু কাঁপন অনুভব করছে মোরশেদ । প্রথম দেখার পর থেকেই অঞ্জলি ভীষণ টানছে। মোরশেদের জীবন থেকে অ্যাবরিল চলে যাওয়ার পর ওর ভিতরের যে নদীটি শুকিয়ে গিয়েছিল। সে নদীতে এখন বান ডাকার সময় এসেছে। মৃত্যুর আগে? আশ্চর্য!
খাওয়ার ঘরটা বেশ বড়। মাঝখানে পনেরো ষোলটা চেয়ার ঘিরে বিশাল এক অমসৃণ কাঠের টেবিল। বিশাল জানালা দিয়ে হু হু করে শীত দুপুরের ঝলমলে রোদ আর শীতার্ত বাতাস ঢুকছিল । টেবিলে ভাত, মুরগীর ঝোল আর গুড়ের পায়েসের বাটি । খাবার তাহের মিয়া বেড়ে দিচ্ছে। মোরশেদ অবশ্য ভাত-ডাল খায় না। তার সামনে একটা বাটিতে কপি সেদ্ধ । মর্তুজা অবশ্য খাদ্যরসিক। বারবার তাহের মিয়ার রান্নার প্রশংসা করছে। এই চল্লিশ ছুঁই ছুঁই মর্তুজার মাথাজুড়ে টাক। গোল ফ্রেমের চশমা পরা ছোটখাটো গড়নের থলথলে শরীরটি ফরসা । পরনে জিন্সের নীল জ্যাকেট আর কালো কর্ডের প্যান্ট।
অঞ্জলি আর্কিটেক্ট বলেই হয়তো জিগ্যেস করে, এই দূর্গবাড়ি কারা বানিয়েছিল জানেন মোরশেদ ভাই?
মোরশেদ বলল, পতুর্গিজরা সম্ভবত । সিক্সটিনথ সেঞ্চুরিতে ওরা বে অভ বেঙ্গলে আসে। হয়তো এই দূর্গবাড়িটা ওদের ট্রেডিং পোস্ট ছিল। তবে আর্কিটেকচারে কিছু মুগল এলিম্যান্ট আছে। হয়তো মুগলরা দূর্গটি জয় করে নিয়েছিল। দক্ষিণের অলিন্দে যে কামানটি আছে, সেটি মুগলদের।
ওহ্। কিন্তু আপনি দূর্গবাড়ির কথা কিভাবে জানলেন?
কক্সবাজের এক লইয়ারের কাছ থেকে। এ বছরের শুরুরে দেশে ফিরে এখানে-ওখানে ঘুরছিলাম।
তখন তো আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি? অঞ্জলি ফস করে জিগ্যেস করে। কন্ঠস্বরে অভিযোগের সুর স্পস্ট।
মোরশেদ হাসে। বড় ম্লান সে হাসি। বলল, আমি আমি তখন মেন্টালি ভীষণ আপসেট ছিলাম। কি করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
সরি।
ওকে। ইটস অল রাইট। বলে হাসল মোরশেদ। তারপর বলল, আমার দেশের বাড়ি কক্সবাজারের চকোরিয়ার। চকোরিয়া, রামু আর কক্সবাজারে আমার শৈশব কৈশরের অনে স্মৃতি আছে। সেসব স্মৃতিময় স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছি । তখন আনিসউদ্দীন আহমেদ-এর সঙ্গে পরিচয়। ভদ্রলোক অ্যাডভোকেট । কক্সবাজার শহরে থাকেন। দূর্গবাড়ির কথা প্রথম তার মুখেই আমি শুনি। ২০০৫ সালে ইউনুস বাঙালি নামে কক্সবাজারের স্থানীয় এক ব্যবসায়ী অল্পদামে দূর্গবাড়ি কিনে নেয়। ইউনুস বাঙালি শিপব্রেকিং এর ব্যবসা করতেন। অ্যাডভোকেট আনিসউদ্দীন আহমেদ তার ল’ইয়ার । ইউনুস বাঙালি ২০১০ সালে মারা যান। আমি তার ছেলে আইয়ুব বাঙালির কাছ থেকে দূর্গবাড়ি কিনি। কেনার সময় কাগজপত্র অ্যাডভোকেট আনিসউদ্দীন আহমেদই করে দিয়েছিলেন। জায়গাটা ছোট ছোট পাহাড় আর গভীর বাঁশবনের আড়ালে বলে দীর্ঘকাল পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল।
অদ্ভূত। অঞ্জলির চোখে
হ্যাঁ, অদ্ভূত।
আপনিও । বলে অঞ্জলি হাসে। গভীর চোখে তাকায়। মোরশেদ কেঁপে ওঠে। ও গোপন বার্তা পায়। মুখ নীচু করে চামচ নাড়তে থাকে। শরীর কাঁপছে। মর্তুজা কি কিছু টের পেল?
মর্তুজা বলে, অঞ্জলি, মোরশেদ- এর নাম কিন্তু বিশ্বজোড়া। যাদের পোস্টমর্ডান আর্কিটেকচার নিয়ে আগ্রহ আছে তারা ফেরদৌস মোরশেদ কে গুরু মানে। এখানে আসার সময় তোমাকে বললাম না যে মোরশেদ Skidmore, Owings and Merrill -এ ছিল । ওরাই তো দুবাইয়ে Burj Khalifa বানালো।
অঞ্জলির খাওয়া শেষ। তাহের মিয়া একটা বাটি নিয়ে এসেছে। হাত ধুয়ে অঞ্জলি বলল, আমারও Skidmore, Owings and Merrill এ চাকরি করার ইচ্ছে ছিল। তো, আপনার বন্ধু দেশ ছেড়ে কোথাও যাবে না। এখন তিনি পালংখালি তে জেলেপাড়ার দেবতা হয়েছেন।
মর্তুজা হাসে । ফ্যাকাশে ।
মর্তুজার প্রজেক্ট সম্বন্ধে জানে মোরশেদ। পালংখালি জায়গাটা উখিয়ার দক্ষিণে। ওখানকার জেলে পাড়ায় জেলেদের জন্য ঘরবাড়ির নকশা করছে মর্তুজা । ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় জেলেদের পলকা ঘরগুলি উড়ে যায়। শক্ত অথচ সস্তা মেটেরিয়াল নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছে মর্তুজা । মর্তুজাকে Sintra নামে একটি লিসবন ভিত্তিক পর্তুগিজ এনজিও স্পন্সর করছে । অঞ্জলি বুয়েট থেকে পাস করে বেরিয়ে ওই এনজিওতে জয়েন করেছে। অঞ্জলি অবশ্য মর্তুজার দ্বিতীয় স্ত্রী। মর্তুজার প্রথম স্ত্রী নাজনীন বুয়েটে মোরশেদ আর মর্তুজার ক্লাসমেট ছিল। নাজনীনের সঙ্গে মর্তুজার বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ জানে না মোরশেদ। ওদের ছেলেমেয়ে হয়নি- এই কি কারণ? মোরশেদ অবশ্য মর্তুজা কে জিগ্যেসও করেনি। দীর্ঘকাল বিদেশ থাকার অভ্যেস।
খাওয়ার পর মর্তুজা কে মোরশেদ বলল, তোরা দূর্গবাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখ। আমি এখন একটু রেস্ট নেব। বিকেলে দেখা হবে। বলে উঠে পড়ে।
মর্তুজা আর অঞ্জলি ঘুরে ঘুরে দূর্গবাড়ি দেখে। একটা কক্ষের দেয়ালে কুঠার, চাবুক টাঙানো। এক পাশে কাঁটাওয়ালা চেয়ার। দু’পাশে হাতলওয়ালা কাঠের বিছানা।
টর্চার সেল মনে হয়। মর্তুজা বলল।
অঞ্জলি শিউরে ওঠে। কাকে মারত? কারা যন্ত্রণা পেয়েছিল। মেয়েদের রেপ করত নিশ্চয়। বাঙালি মেয়েদের? মুশকো চেহারা পতুর্গিজ জলদস্যুরা ছিপছিপে বাঙালি মেয়ের ওপর কল্পনা করে অঞ্জলির নিঃশ্বাস ঘন হয়ে ওঠে। ওরা কক্ষ থেকে বের হয়ে আসে। পাঁচশ বছরের পুরনো এই দূর্গবাড়িতে অনেক সিঁড়ি, অলিন্দ আর চুনাপাথর আর গন্ধকের গন্ধ ছড়ানো আধো-অন্ধকার করিডোর। পায়রার বাকুম বাকুম। রাতের আলোর জন্য জেনারেটর। একটা পর্তুগিজ কামান। না, মগলদের কামান ...
পিছনের অলিন্দে রোদে বসে সাদা শাড়ি পরা একটি মেয়ে চুল শুকাচ্ছিল। ফরসা পিঠের অনেকটাই উদাম। বয়স আঠারো-উনিশ-এর বেশি না । মেয়েটি ভীষণ সুন্দরী। মুখের আদল অনেবটা সুচিত্রা সেনের মতো। কে এ?
থামের আড়াল থেকে তাহের মিয়া বেড়িয়ে আসে। বলে, এ হইল আমার ছুট মেয়ে। নাম হইল পরী।
ও। রান্না করে কি ওই করে? অঞ্জলি জিগ্যেস করে।
হ।
অঞ্জলি মর্তুজার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, আর তুমি ওর রান্না বাবার প্রশংসা করলে তখন।
মর্তুজা হাসে। অপ্রস্তুত। মর্তুজার কামার্ত চোখ পরীর ব্লাউজবিহীন ফরসা উদোম পিঠ ঘুরছিল। বাঁ দিকে একটা সিঁড়ি। দ্রুত পায়ে সেদিকে যেতে থাকে অঞ্জলি । সিঁড়ির শেষে দূর্গের ছাদ। ওরা ছাদে পা দিতেই অজস্র কবুতর উড়ে গেল।ধূসর-নীল আকাশের তলায় ঝলমলে রোদ। দূরে ঝিলিমিলি সমুদ্র। ছাদের এক প্রান্তে বাঁশের খুঁটিতে আড়াআড়ি একটা তার টাঙ্গানো। তারে একটা চেক লুঙ্গি। সম্ভবত তাহের মিয়ার। লুঙ্গির পাশে ছায়া আর ব্রা। ব্রাটা সাদা রঙের । সম্ভবত পরীর। মর্তুজার হাতে দশ মেগাপিক্সেলের একটা প্যানাসনিক লুমিক্স ক্যামেরা। সে এক ক্লিকে ছায়া আর ব্রার ছবি তুলে নেয়। তখনই অঞ্জলি বলে, তাহের মিয়ার মেয়েটা কি সুন্দর! ওর সঙ্গে কি মোরশেদ ভাইয়ের ডিপ কোনও রিলেশন আছে? তোমার কি মনে হয়?
মর্তুজা কাঁধ ঝাঁকাল। মনে মনে বিরক্ত। অহেতুক সেক্সের প্রসঙ্গ কেন? তা ছাড়া মোরশেদ ক্যান্সারের রোগী, মৃত্যুপথযাত্রী।
মৃত্যুপথযাত্রী বলেই কি আজকাল কিছু খাওয়ার পর ভীষণ ক্লান্তি পায় মোরশেদের? দু’বেলা ক্যান্সারের অষুধ খেতে হয়। অষুধ অবশ্য খেত না মোরশেদ। অষুধ না-খেলে এক-একা অশেষ যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে বলেই খায়। অ্যাবরিল এমনিতেই অনেক মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে। ওই ফরাসি মেয়েটিকে গভীর ভাবে ভালোবাসত মোরশেদ । নানজিং থাকার সময়ই মধ্যবয়েসি এক পাকিস্তানি ব্যবসায়ীর সঙ্গে অ্যাফেয়ারে জড়িয়ে পড়েছিল অ্যাবরিল। জানতে পেরে অস্থির দিশেহারা হয়ে উঠেছিল মোরশেদ। অ্যাবরিল কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল আর ২ মিলিয়ন ডলারের চেক। অ্যাবরিল রাজি হয়নি । চাকরি ছেড়ে সেই পাকিস্তানি ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে জার্মানি চলে যায় অ্যাবরিল। মোরশেদ তখন দিশেহারা। ওই পাকিস্তানি ব্যবসায়ী একাত্তরের গণহত্যার জন্য দায়ি নয়। তবু পাকিস্তান গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি। হয়ত এই কারণে মোরশেদের মানসিক যন্ত্রণা প্রকট হয়ে উঠেছিল। ওই সময়ে নানজিং এ চেকআপের পর এক চিনে ডাক্তার বলল: ক্যান্সার। হতাশায় মৃতুকে আরও কাছে টানার জন্য সিগারেট খাওয়া শুরু করে। একবার নানজিং এর ১,৪৮০ ফিট উচুঁ গ্রিনল্যান্ড ফাইনানশিয়াল সেন্টার থেকে লাফিয়ে পড়ার কথা ভেবেছিল। দশমিক ৪৪ ম্যাগনাম কোল্ট এনাকোন্ডা রিভলবারটা হাতে নিয়ে রাতভর বসে থাকত। আত্মহত্যার মুখ থেকে অবশ্য ফিরে এসেছে। কেমোথেরাপি এড়িয়ে মৃত্যুর আগে একবার শৈশব কৈশরের স্মৃতিময় স্থানগুলি দেখে নির্জনে মৃত্যুবরণ করবে বলে অনেক বছর পর বাংলাদেশে ফিরে এখন অঞ্জলি কে দেখে বাঁচতে চাইছে মোরশেদ ...
রাতে খাওয়ার পর মোরশেদ, মর্তুজা আর অঞ্জলি অলিন্দে বসেছিল। মোরশেদ সিগারেট টানছিল। শীতরাতের ধবল জোছনায় চারপাশ উজ্জ্বল। সমুদ্রে ছড়িয়েছিল কুয়াশার মসৃণ চাদর। সে চাদর ছিঁড়ে আকাশে উড়ছিল একঝাঁক নিশাচর গাঙচিল।
হঠাৎ অঞ্জলি বলে, আপনাকে আমার ভীষণ ঈর্ষা হচ্ছে মোরশেদ ভাই ।
কেন? মোরশেদ ভিতরে ভিতরে কাঁপছিল। ওর কন্ঠস্বরও কেঁপে উঠল। সে বারবার অঞ্জলি নামটি উচ্চারণ করতে চায়।
অঞ্জলি বলে, এত বিরাট সুন্দর আর নির্জন বাড়িতে থাকেন বলে আমার ঈর্ষা হচ্ছে ।
দূর্গবাড়ি তোমার এত পছন্দ অঞ্জলি?
হ্যাঁ। অঞ্জলি মাথা নাড়ে। নীল জিন্সের ওপর সাদা সোয়েটার পড়েছে অঞ্জলি । কাঁধ অবধি ছাঁটা চুল। অঞ্জলি কে পুতুলের মতো দেখায়।
মোরশেদ বলে, অঞ্জলি তুমি কবি বলেই নির্জনতা পছন্দ কর। ঠিক আছে। আমি দূর্গবাড়িটা তোমাকে গিফট করব ।
গিফট করবেন মানে! শীতের এই নির্জন রাতে অঞ্জলির উচ্ছ্বসিত কন্ঠস্বর অনেক দূর অবধি যায় । নিশাচর গাঙচিলের ঝাঁকে যেন গুঞ্জন ওঠে।
মোরশেদ হেসে বলে, মানে আর কী-দূর্গবাড়িটা তোমাকে গিফট করব। কালই আমি অ্যাডভোকেট আনিসউদ্দীন আহমেদ-এর সঙ্গে কথা বলব।
সত্যি গিফট করবেন। অঞ্জলির দুটি চোখে অবিশ্বাস ঝরে ঝরে পড়ে। হাত দুটি জড়ো করে রেখেছে প্রার্থনার ভঙ্গিতে।
হ্যাঁ। করব। আমি আমি আমার জীবনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি অঞ্জলি ।মোরশেদ বলল।
হ্যাঁ। আমি আপনার বন্ধুর কাছে দুঃসংবাদটা শুনেছি। আমি সব সময় আপনার জন্য প্রার্থনা করি। অঞ্জলির কন্ঠস্বর থেকে বিষাদ ঝরে পড়ে।
এরপর নীরবতা নেমে আসে। তারপর মর্তুজা আর অঞ্জলি উঠে চলে যায়। ঘুমাতে । একটু পর মোরশেদও উঠে পড়ে। ওর বেডরুম থেকে সরু একটা করিডোর দিয়ে অঞ্জলিদের বেডরুমে যাওয়ার একটা পথ আছে । মোরশেদ নিঃশব্দে সেখানে দাঁড়ায়। উঁকি দেয়। কক্ষে হলুদ আলো জ্বলে আছে। বিছানায় আধশোয়া ভঙ্গিতে থাকা মর্তুজার পরনে সাদা জাঙ্গিয়া। অঞ্জলি নগ্ন হচ্ছিল ধীরে ধীরে। সময় নিয়ে। নীলছবির পেশাদার অভিনেত্রীর মতো। শ্যামলা পেলব শরীরজুড়ে নরম লাবণ্য। মোরশেদ ক্রমশ জেগে উঠতে থাকে। ওর ভিতরের যে আগুন নিভে গিয়ে গিয়েছিল, পরীর নগ্ন পিঠ দেখেও যে আগুন আর জ্বলে ওঠেনি। সে আগুন এই মুহূর্তে জ্বলে ওঠে। মৃত্যুর আগে একবার অন্তত নরম নগ্ন অঞ্জলিকে তীব্র আকাঙ্খায় আলিঙ্গন করার ইচ্ছে তীব্র হয়ে ওঠে। এতে যদি মর্তুজার মৃত্যুও হয়, তবুও ...
পরদিন সকালে অ্যাডভোকেট আনিসউদ্দীন আহমেদ- কে ফোন করে মোরশেদ। দানপত্রের দলিল তৈরি করতে নির্দেশ দেয়। মর্তুজা অবশ্য আপত্তি করল। অঞ্জলি তাকে চোখ রাঙায়। মর্তুজার ওপর অঞ্জলির কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ । কারণটি গতরাত্রে দেখেছে মোরশেদ। অঞ্জলি ওকেও জাগিয়ে তুলেছে।
সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাল মোরশেদ। রাতে খাবারের পর ওরা তিনজন অলিন্দে এসে বসল। আজ কিছু খেতে পারেনি মোরশেদ। বমি লাগছিল। বিমর্ষ বোধ করছিল। অবশ্য অঞ্জলি ফুরফুরে মেজাজে ছিল। অবশ্য মর্তুজা গম্ভীর ছিল। বলল, কাল সকালে চলে যাব। মোরশেদ বলল, ওকে। দূর্গবাড়ির কাগজপত্র রেডি হলে আমার উকিল তোর ওখানে দিয়ে আসবে। উকিলকে সব ইন্সট্রাকশন দেওয়া আছে।
মর্তুজার মুখ কালো হয়ে ওঠে। অবশ্য কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখেই কথা বলে সে। রাত বাড়ে। অঞ্জলি হাই তুলে। মর্তুজার দিকে চেয়ে বলে, ঘুমাতে যাবে না?
মর্তুজা বলে, তুমি যাও। শুয়ে পড়। আমরা দু’বন্ধু বসে গল্প করি।
অঞ্জলি লাস্যময়ী ভঙ্গিতে চলে যায় । মর্তুজা খানিকটা রূঢ়স্বরে বলে, তুই অঞ্জলি কে দূর্গবাড়ি গিফট করবি কেন?
দূর্গবাড়ি ওর ভালো লেগেছে বলে। আমি তো বেশি দিন বাঁচব না। আমি ভাবতে পারি না আমি মরে গেলে বাড়িটা শূন্য পড়ে থাকবে। তাহের মিয়া আর পরীকে তোরা নিশ্চয়ই তাড়িয়ে দিবি না। বলে কাশতে থাকে মোরশেদ। আজ সন্ধ্যার পর থেকে ভারি দূর্বল লাগছিল শরীর। সামান্য জ্বরও আছে। সেই সঙ্গে বমির ভাব। থেকে থেকে গা গুলিয়ে উঠছিল। মোরশেদ উঠে দাঁড়ায়। তারপর ধীরে ধীরে অলিন্দের কিনারে চলে আসে। মর্তুজাও। মর্তুজা বলে, তুই আমার বউকে বাড়ি গিফট করছিস। ব্যাপারটা আমার ভালো নাও লাগতে পারে। এটা কখনও ভেবে দেখেছিস?
মোরশেদ বলে, তোর মৃত্যু ঘনিয়ে এলে বুঝবি, মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের হিসেব অন্যরকম। বলে পকেটে হাত দিয়ে দশমিক ৪৪ ম্যাগনাম-এর কোল্ট এনাকোন্ডার শীতল শরীর স্পর্শ করে মোরশেদ। মর্তুজা কে গুলি করার পর অঞ্জলির কাছে ছুটে যাবে, তীব্র আবেগে ওকে আঁকড়ে ধরবে। হঠাৎই মাথা টলে ওঠে মোরশেদের । কাত হয়ে পড়ে যায় সে । রেলিং ধরে টাল সামলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু উথালপাথার বাতাসের তোড়ে উল্টে পড়ে যায়। বাতাসের প্রবল শব্দে পড়ন্ত মোরশেদের আর্তনাদ শোনা গেল না। পাথরের ওপর লাশ পড়ে রইল। নিথর।
অঞ্জলি সম্ভবত ওপরের ছোট অলিন্দ থেকে দৃশ্যটা দেখছিল। ও ছুটে এসে ঝুঁকে পড়ে। ওর ঠিক সামনে দুটো ফুট নিচে উপকূল। উপকূলে বড় বড় পাথর। পাথরগুলোর ওপর ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ক্ষীন শব্দ। বালিয়ারিতে জোছনায় কুয়াশা মিশে আছে। বাতাসে শীত। অঞ্জলি বলে, ইস্ ! মরে গেলেন?
হ্যাঁ। মর্তুজার কন্ঠস্বর কেমন সন্তোষের ভাব ফুটে ওঠে।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। তাহের মিয়া। বৃদ্ধ কাছে আসতেই অঞ্জলি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে, তোমার স্যার এই মাত্র নীচে পড়ে গেলেন ।
তাহের মিয়া মাথা নেড়ে বলে, হ। পরী দেখছে। আমি নামাজ পইড়া শুইয়া পড়ছিলাম। আমারে ডাইকা তুইলা বলল। আহা স্যার পইড়া গেল। অসুইখ্যা মানুষ ...আহারে ... আল্লায় বিচার করছে ...
মর্তুজা বলল, লাশটা পাথরের ওপর পড়ে আছে। এখন কি করা যায়?
তাহের মিয়া বলে, চিন্তা কইরেন না। আমি সব সামাল দিমু। লাশ ভাসায় দিমু সাগরে। স্যারে আমারে কইছিল তাহের মিয়া আমি মইরা গেলে আমার লাশখান সাগরে ভাসাইয়া দিও।
অঞ্জলি শ্বাস টানে ... তার চোখ বঙ্গোপসাগরে অবারিত জলরাশির দিকে স্থির। যেখানে এই মুহূর্তে তরল জোছনার জল আর জল । অঞ্জলির হঠাৎ মনে হল, পরী কই? পরী তো এল না। ও জিগ্যেস তাহের মিয়াকে জিগ্যেস করে, পরী কই?
তাহের মিয়া হাত তুলে নিচের দিকে দেখিয়ে বলে, ওই যে পরী ...
অঞ্জলি ঝুঁকে দেখে সাদা শাড়ি পরা একটি মেয়ে মোরশেদের লাশ পাথরের ওপর দিয়ে টানতে টানতে সমুদ্রের পাড়ে নিয়ে যাচ্ছে ...