somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী: আন্তরিক এক হৃদয়ের পাঁচালী

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মানুষ তার মৃত প্রিয়জনকে খুব কাছ থেকে একটিবার দেখার জন্য কত তুকতাক, কত যাদুমন্ত্র-ই না করে। তবে বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখার জন্য আমাকে কোনও গুণীনের শরণাপন্ন হতে হয়নি। বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি সেই অসাধ্যটি সাধন করেছে। বইটি পড়ার সময় আমি অনুভব করেছি বঙ্গবন্ধুর নিবিড় সান্নিধ্য । এ এক অলীক-বিরল অভিজ্ঞতা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমি ঘুরেছি অপরূপা দক্ষিণ বাংলার মধুমতী-বিধৌত এক নিভৃত পল্লীতে, তার শিশিরস্নাত মেঠোপথে, হিরণময় ফসলের মাঠে, মূখরিত ইশকুলে, বিকেলের খেলার মাঠে, অথই পদ্মায় স্টিমারে, কলকাতার সদর স্ট্রিটে, ট্রেনে দিল্লির পথে; তারপর রাজনৈতিক ময়দানে গায়ে- জ্বালা- ধরানো ভাষণ শুনেছি খুব কাছ থেকে । শুনেছি তাঁর পূর্বপুরুষের ইতিহাস। এ এক পরম বিস্ময়কর অভিজ্ঞতাই বটে।
বঙ্গবন্ধুর কাছে শরৎচন্দ্রের লেখনী-বৈদগ্ধ আশা করিনি ঠিক, তবে বইটি পড়তে শুরু করার পর খানিকটা স্তম্ভিতই হয়ে গেলাম। বাঙালি এই রাজনৈতিক নেতার লিখিত ভাষা এত সাবলীল এত, প্রাঞ্জল! যেন লিখছেন না, যেন কথা বলছেন; যে কথায় ছলাকলা নেই, ভান নেই, চাতুর্য নেই বিন্দুমাত্র; বাংলার মাটিঘেঁষা মানুষ তার ঘরের আঙিনায় বসে তার কাছের মানুষের কাছে যেভাবে হৃদয়ে কথা বলে, যা হৃদয়েরই রস-রসায়নে হয়ে ওঠে পাঁচালী-ঠিক সেই ভাবে লিখেছেন বইটি। আসলে বঙ্গবন্ধু লেখক ছিলেন না। তিনি লিখতে জানতেন না। বঙ্গবন্ধু ভান করতে পারতেন না বলেই লিখতে জানতেন না। পৃথিবীর তাবৎ লিখিত ভাষা মাত্রই ভান! আর্টিফিশিয়াল ...ভড়ং জানতেন না বলেই খোলাখুলি লিখেছেন:

‘অনেক সময় দেখা গেছে, একজন অশিক্ষিত লোক লম্বা কাপড়, সুন্দর চেহারা, ভালো দাড়ি, সামান্য আরবি ফার্সি বলতে পারে, বাংলাদেশে এসে পীর হয়ে গেছে। বাঙালি হাজার হাজার টাকা তাকে দিয়েছে একটু দোয়া পাওয়ার লোভে । ভালো করে খবর নিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ লোকটা কলকাতার কোন ফলের দোকানের কর্মচারী অথবা ডাকাতি বা খুনের মামলার আসামি। অন্ধ কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসও বাঙালির দুঃখের আর একটা কারণ।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী; পৃষ্ঠা, ৪৮)

৩২৯ পৃষ্ঠার বইটা পড়ার সময় বইটি আমার হাতের মধ্যে থরথর করে কাঁপছিল। আমি অনুভব করছিলাম ৩২৯ পৃষ্ঠার ফ্রেমের মধ্যে কী ভাবে একটা সময় তার সমস্ত বিক্ষোভ-প্রতিবাদ আর টানাপোড়েন নিয়ে জীবন্ত উঠে এসেছে শব্দস্পর্শগন্ধ সমেত। যেন নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে নিজের অজান্তেই পাঠককে কী এক যাদুমন্ত্র বলে নিঃক্ষেপ করেছেন এক প্রবল ঘূর্নির মধ্যে । বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটিতে ভারতীয় উপমহাদেশের এক বিচক্ষণ রাজনৈতিক নেতার কাছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসন-পীড়নের সকরুণ রাজনৈতিক ভাষ্য আশা করেছিলাম কেবল-আশ্চর্য এই, রাজনৈতিক ভাষ্যের পাশাপাশি পেলাম ... পাঠক একটি মহৎ গ্রন্থের কাছে যা আশা করে তাই। যে গ্রন্থপাঠের আবেশ র মগজের কোষে হয় স্থায়ী- যার জের থাকে দীর্ঘক্ষণ। বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে বাঙালির এক ধরণের আচ্ছন্ন মুগ্ধতা থাকাই স্বাভাবিক, সেসব সরিয়ে রেখে বইটি পড়ার চেষ্ট করেছি। ব্যর্থ হয়েছি। তাঁর অমোঘ টানে।
বাঙালি এই নেতার হৃদয়ের অকপট আন্তরিকতা আমায় গভীরভাবে বিস্মিত করেছে। সংসারে আন্তরিক মানুষ আমি কম দেখিনি। তবে প্রত্যেক বাঙালিই আন্তরিক কিনা জানি না। আমি নিজেও আন্তরিক কিনা সন্দেহ আছে। তবে বাঙালির এই সর্বশ্রেষ্ট নেতাটি যে নিখাদ আন্তরিক সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আলোচ্য বইটির ছত্রে ছত্রে তাঁর হৃদয়মাধুর্য স্পস্ট করে অনুভব করা যায়। এবং সেই আন্তরিকতা, সেই হৃদয়মাধুর্য অনুভব করে কী এক ঘোরে যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি ...যখন তাঁর দিল্লি থেকে কলকাতা ফেরার বর্ণনা পাঠ করি ...

‘... আমাদের সময় হয়ে এসেছে, ফিরতে হবে। চৌধুরী সাহেব তাড়া দিলেন। আমরাও গাড়িতে উঠে বসলাম। আগ্রায় ফিরে এসেই মালপত্র নিয়ে রওয়ানা করলাম তুন্দলা স্টেশনে। এসে দেখি বংলাদেশের অনেক সহকর্মীই এখানে আছেন। অনেক ভিড়। মালপত্র চৌধুরী সাহেবের প্রথম শ্রেণীর গাড়িতে ফেলে আমরা তাড়াতাড়ি উঠে পড়তে চেষ্টা করলাম। যখন সকলেই উঠে গেছে ট্রেনে, আমি আর উঠতে না পেরে এক ফার্স্ট ক্লাসের দরোজার হাতল ধরে দাঁড়ালাম। আমার সাথে আরেক বন্ধু ছিল। পরের স্টেশনে যে কোনও বগিতে উঠে পড়ব। অনেক ধাক্কাধাক্কি করলাম, প্রথম শ্রেণীর ভদ্রলোক দরোজা খুললেন না। ট্রেন ভীষণ জোরে চলছে, আমাদের ভয় হতে লাগল, একবার হাত ছুটে গেলে আর উপায় নাই। আমি দুই হাতলের মধ্যে দুই হাত ভরে দিলাম, আর ওকে বুকের কাছে রাখলাম। মেলট্রেন-স্টেশন কাছাকাছি হবে না। আমাদের কিন্তু অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছিল।বাতাসে হাত-পা অবশ হতে চলেছে। আর কিছু সময় চললে আর উপায় নাই। কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ ট্রেন থেমে গেল। আমরা নেমে পড়লাম।’
(অসমাপ্ত আত্মজীবনী ;পৃষ্ঠা, (৬০-৬১))

আসলে যে কোনও লেখাই স্মৃতিরই পুনরূপায়ণ। ক্ষুরধার স্মৃতিশক্তির অধিকারী বঙ্গবন্ধুর এ লেখাটিও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। কেননা, তিনি তাঁর আত্মজীবনীটি পেশাদার গবেষকের মতন নির্জন নিরাপদ কক্ষে বসে সমস্ত তথ্য সামনে রেখে বানিয়ে বানিয়ে লিখেননি, লিখছেন কারাজীবনের উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে বসে। অথচ প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রতিটি ঘটনার পারম্পার্য বজায় রেখেছেন আশ্চর্য দক্ষতায়। এমন ভাবে দৃশ্যের পর দৃশ্যের বর্ণনা করেছেন যেন তিনি এক স্বশিক্ষিত ‘স্টেরি টেলার’। পেশাদার গল্প-লিখিয়ের মতেই তিনি কলকাতার দাঙ্গার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে:

‘একদল লোককে দেখেছি দাঙ্গাহাঙ্গামার ধার ধারে না । দোকান ভাঙছে, লুট করছে, আর কোনো কাজ নেই। একজনকে বাধা দিতে যেয়ে বিপদে পড়েছিলাম। আমাকে আক্রমন করে বসেছিল। কারফিউ জারি হয়েছে, রাতে কোথাও যাবার উপায় নেই। সন্ধ্যার পরে কোন লোক রাস্তায় বের হলে আর রক্ষা নাই। কোন কথা নাই, দেখামাত্র গুলি। মিলিটারি গুলি করে মেরে ফেলে দেয়। এমনকি জানালা খোলা থাকলেও গুলি করে। ভোরবেলা দেখা যেত অনেক লোক রাস্তায় গুলি খেয়ে মরে পড়ে আছে। কোন কথা নেই শুধু গুলি।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী; পৃষ্ঠা; ৬৭)

ওপরের বর্ণনাটিতে একজন ঔপন্যাসিক কিংবা একজন গবেষকের বর্ণনার সঙ্গে ফারাক আমাদের চোখে সহজেই ধরা পড়ে। এখানেও সেই আন্তরিকতা।‘ সন্ধ্যার পরে কোন লোক রাস্তায় বের হলে আর রক্ষা নাই। কোন কথা নাই, দেখামাত্র গুলি।’ এজন্য বলছিলাম: বাংলার মাটিঘেঁষা মানুষ তার ঘরের আঙিনায় বসে তার কাছের মানুষের কাছে যেভাবে হৃদয়ে কথা বলে, যা হৃদয়েরই রস-রসায়নে হয়ে ওঠে পাঁচালী-ঠিক সেই ভাবে লিখেছেন বইটি।
তো, ৩২৯ পৃষ্ঠার পাঁচালীর কোন কোন বিষয়ে অভিভূত হলাম?
আমি ইতিহাসের ছাত্র বলেই বইটির প্রথম ছত্র থেকে বিদ্যুৎতাড়িত। তবে আমি প্রত্যেক মানুষের বিশৃঙ্খল আচরণের মধ্যেই তার মহত্বকে আবিস্কার করার চেষ্টা করি বলে পাঁচালীর এক জায়গায় এসে আমাকে বেশ জোরেসোরেই একটা ধাক্কা খেতে হল। খুলে বলছি। ভারত বিভাগের প্রাক্কালে কলকাতায় যে এক ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল সে কথা আমরা জানি। বিহারেও সে প্রাণঘাতী দাঙ্গা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। আতঙ্কিত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল রিফিউজি ক্যাম্পে। যাদের বেশির ভাগই মুসলিম হলেও ছিল অবাঙালি এবং উর্দুভাষী। বঙ্গবন্ধু বিহারের শরণার্থী শিবিরে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। এতে তাঁর স্বাস্থ ক্ষয় হয়েছে; তিনি শীর্ণকায় হয়ে গিয়েছিলেন অপরভাষী, অপরজাতির জন্য। এই বিষয়টি আমাকে তীব্রভাবে নাড়া দিয়েছে। আমি উপলব্দি করেছি একটা জাতির নেতা হওয়া কত দুরূহ। এমন সব মানবিক কারণে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী আমার কাছে কেবল একটা সময়ের নিছক রাজনৈতিক ভাষ্য বলে মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছে নির্জন কারাকক্ষে বসে এ অমূল্য লেখাটি এক হৃদয়বান বাঙালি হৃদয়ের এক আন্তরিক পাঁচালী ...

অসমাপ্ত আত্মজীবনী; শেখ মুজিবুর রহমান
প্রকাশনী: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড।
বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন: অধ্যাপক ফকরুল আলম।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১০:০৬
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×