ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যায় আলো পুরো পড়ে না যেতেই। শীতকালের বেলা ছোট। তাই কনকের মনটা খারাপ হয়ে যায়। সেজদা 'বসুমতী'র একটা পুরনো সংখ্যা নিয়ে এসেছে লাইব্রেরি থেকে। লুকিয়ে সেটাই দেখে। রান্নাঘরের পিছনে কিছুটা জংলা মত। পরিষ্কার করা হয় না। বিড়ালগুলো গুচ্চের কাটাকুটি এনে ফেলে। এখান থেকে কারো নজরে পড়বে না। কনক অনেকদিন ধরেই জায়গাটা বেছে নিয়েছে। মা খুব রাগ করে এসব বই ধরলে। অথচ কনক পড়তে ভালবাসে। সুর করে শ্লোক পড়ে, রামায়ণের। কত পাতা সে না দেখে আউড়ে যেতে পারে। কিন্তু ওভাবে পড়তে নেই । চান করে আসন নিয়ে বসতে হয়। এগুলো তো সাধারণ পদ্য না।
সামনের বছর কনক ক্লাশ ফাইভে উঠবে। তখন জলপাণি পাবে পরীক্ষায় বসলে। মেয়েদের স্কুল আছে রাঢ়ুলিতে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র দেবের মায়ের নামে । কনক সব খবর রাখে। তাঁর নাম ভুবনমোহিনী দেবী। খুব বিদূষী নারী, আর খুব সাহসী। ইংরেজদের রুখে দিয়েছিল। প্রফুল্লদেব মহাশয়ও বিরাট পন্ডিত। কিন্তু স্কুল কনকদের গ্রাম থেকে পাঁচক্রোশ। সেখানে কি রোজ হেঁটে যাওয়া যায়? কনক মনে মনে মধুসূদনকে বলে যেন ওদের বাড়িটা একটু করে এগিয়ে যায়, রাঢ়ুলির দিকে । কথামৃতে ঠাকুর বলেছেন সেই বালকের কথা--বললে মধুসূদন সব শোনে।
রাঢ়ুলির স্কুল! যেখানে মেয়েরা উচু উচু ক্লাশে পড়ে, কত কি জানে, স্কুলের আগে গান গায়, সেলাই শেখে । ঝাঁন্সি ব্রিগেডের নামও জানে কনক। যেখানে মেয়েরা দেশের নামে দস্তখত করে। কালি না, হাত কেটে রক্ত দিয়ে লেখা। উরিব্বাস কি সাহস। কনক কিন্তু শুধু পড়তে চায় এত এত বই। বিহারীলাল বাবুর পদ্য, ছোট ছোট কথিকা .. সবকিছু। যা পায় হাতের নাগালে । আচার্যদেব সেবার সভায় এসে কি কি বললেন, সেজদারা হাতে করে লিখে বিলি করেছিল। কনক দাদার টেবিলে পেয়ে তাও পড়েছে। কতবার পড়েছে ! কতকগুলো শব্দ মোটে চেনা ছিল, বাকিটা কিছুই বোঝেনি। তবু পড়ে। খুঁজে খুঁজে পড়ে। দুপুরে মা অতসী জেঠিমার কাছে যায়, পিসী জপ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে । মশা কামড়ায় খুব এখানে বসলে। তারপরও, এ জায়গাটাই আপাতত নিরাপদ। শীতকাল বলে সাপের ভয় কম। বেলা ছোট, তাও এটুকু সুবিধা আছে।
বসুমতীতে কনকের মন ভারি আটকায়। ছাপার অক্ষর, ফুল ফুল নকশার উপর কি সব নামী লেখকদের কথা থাকে .........। কনকের স্বপ্নজগতের মানুষ এরা। সবাই কলকাতার লেখক, সেখান থেকে বসুমতী আসে। আচ্ছা প্রকাশক লোকটা কে? কি তার কাজ ? সেজদা বলেছে ছাপার মেশিনে কালি থাকে। তাতে একদিক থেকে সাদা কাগজ দিলে অন্য দিক থেকে লেখা লেখা বইয়ের পাতা চলে আসে। সারারাত কাজ চলে। কারা যেন বসে আঠা লাগায়। তারপর লিস্টি মিলিয়ে চলে যায় শহরের বড়বড় মানুষদের বাসায়, কলেজে, সারাদেশের লাইব্রেরীতে । কনকদের মত গ্রামের লাইব্রেরিতে আসে সবার পরে।
লাইব্রেরীর বই ছোটদের হাতে আসে না, বড়রা পড়েন। জ্যাঠামশায়রা রোজ বই নিয়ে কথা বলেন। আসেন হেডমাস্টার, যোগীনাথ সেন তারপর অবিনাশ মাস্টারবাবু। প্রতিদিন সন্ধ্যায় যান ওনারা। তর্ক ও হয় খুব, কনক শুনেছে। সেজদা বলে আগে ছেলেদের যাওয়া বারণ ছিল, অবিনাশ স্যার আসার পর ওদের পড়ার জন্য খাতা খুলেছে। আর চাইলে লাইব্রেরীর দোচালা ঘরের বাইরে আসন বিছিয়েও পড়তে পারে। অবিনাশ মাস্টার মশায়কে সেজদারা অবিনাশ স্যার বলে কিন্তু উনি পড়ান কনকদের স্কুলে। উনি নাকি গান্ধীদেবের ভক্ত । গান্ধীদেব কে কনক জানে না , কিন্তু সেজদার কাছে ছবি দেখে অবাক। কেমন রোগা একটা মানুষ, কিন্তু নাকি অনেক সাহস তার। উনি খুব বড় মানুষ তাই কনক তাকে গান্ধীদেব বলে, দাদা বলেন গান্ধীজি।
চলবে..
(সদ্যপ্রয়াত পিতামহীকে নিয়ে স্মৃতিচারণের প্রচেষ্টায়----
ব্যাপারটা আমার জন্য সহজসাধ্য নয়। ঐতিহাসিক তথ্য সাথে গ্রামীণ জীবনের পটভূমি---যেকোন সাহায্য ও উপদেশ পেলে কৃতার্থ হব
শুরু করলাম যদি কখনো শেষ হয় .... )