somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপমান আর অক্ষমতার গল্প

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১১:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মুম্বাই টাটা ক্যান্সার হাসপাতালের চিকিৎসকরা যখন বললেন, এখানে রেখে শুধু রোগীকে কষ্ট দেয়া, তার চেয়ে শেষ সময়টুকু বাড়িতে নিয়ে যাও, স্বামী-সন্তানের সাথে সময় কাটুক। তখন আমার ভেতরে কোনো বোধ কাজ করছিলো না। নয়তো এতো বড় কথা শুনেও কিভাবে আমি দুপায়ে নির্বিকার দাঁড়িয়ে ছিলাম?
ডাক্তারের কথাগুলো শুনছিলাম আর ভাবছিলাম আমার মেয়েটার কথা। বুকটা ভেঙ্গে আসে। চোখের পানি ততোদিনে শুকিয়ে গেছে, একের পর এক দু:সংবাদে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। প্রতিটি রিপোর্ট নতুন নতুন দু:সংবাদ নিয়ে আসছে, যেন প্রতি রিপোর্টেই ঘোষিত হচ্ছে মৃত্যু পরোয়ানা। মৃত্যুপথযাত্রী প্রিয়জনকে হাসপাতালের বিছানায় শুইয়ে রেখে সকাল-বিকেল হিসেব করছি হাতে আর কতো টাকা আছে! একা আমি সবদিক সামলে উঠতে পারছি না। হিমশিম খাচ্ছি। চারদিক অন্ধকার।
টাটা ক্যান্সার হাসপাতালের ডাক্তাররা বলেই দিয়েছিলেন, হাতে সময় বেশি নেই। আর কোনো চিকিৎসায় কাজ হবে না। ক্যান্সার ছড়িয়ে গেছে লিভারসহ বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে।
আমার হাতে সত্যিই আর কতোটা সময় আছে? মরিয়া হয়ে জানতে চাই আমি।
খুব অল্প, You don’t have even months. একটু থেমে ডাক্তার বলেন, আমাদের পরামর্শ, তুমি যতো দ্রুত পারো পেশেস্টকে বাড়ি নিয়ে যাও। হাসপাতালে রেখে তাকে আর কষ্ট দিও না। শেষ সময়টা তাকে স্বামী-সন্তানের সঙ্গ থেকে বঞ্চিত কোরো না। তোমার মেয়েটার মনেও মায়ের শেষ সময়ের কিছু স্মৃতি থাকুক।
দেশে ফিরিয়ে আনলাম ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখ, ডাক্তারের শেষ পরামর্শটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কপাল আমার! সেটিও পারলাম না। সেই দু:সহ অপমান আর অক্ষমতা আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। সারাটা জীবনই আমি এই বেদনায় জ্বলবো।
এতো বড় শারীরিক কষ্ট নিয়েও তার সব সময় চেষ্টা ছিলো স্বাভাবিক থাকার। শুধু মেয়েটা যখন সামনে থাকতো না, কিংবা ঘুমিয়ে পড়তো, তখন প্রকাশ পেতো যন্ত্রণাগুলো। কী করলে একটু শান্তি পাবে, বুঝতে না পেরে অক্ষম আমি ছটফট করতাম সারা রাত।
এই সময় স্যুয়ারেজের লাইনে কাজ হচ্ছিলো আমার এলাকায়। পানির লাইনে কোনো একটা গোলমাল হওয়ায় ট্যাপের পানিতে ময়লা আর দুর্গন্ধ। কয়েকদিন কেনা পানি দিয়ে কাজ চালালাম। কিন্তু রান্নাসহ অন্যান্য কাজেও পানি দরকার। কোথায় পাই? অগত্যা পাঁচ লিটারের দুটি কন্টেইনার নিয়ে গেলাম আমার সুবিধাজনক একটি স্থানে (সঙ্গত কারণেই জায়গাটির নাম উল্লেখ করছি না), যেখান থেকে পাওয়া যাবে পরিষ্কার পানি। সেই পানি ফুটিয়ে নিলেই হলো। কিন্তু পানি দেয়ার এখতিয়ার যার তিনি দারোয়ান দিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। দারোয়ানকে দিয়ে বলালেন, পানি দেয়া যাবে না। ততোক্ষণে আমার ড্রাইভার দুই কন্টোইনার পানি ভরে ফেলেছে। স্যারের হুকুম পেয়েই কিনা জানিনা, দারোয়ান এগিয়ে এলো ভরা কন্টেইনারের পানিগুলো মাটিতে ঢেলে ফেলে দিতে।
ড্রাইভার যখন ফোন করে আমাকে বিষয়টি জানালো, রাগে, দু:খে, অপমানে আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। নিজের ড্রাইভারের কাছেও একেবারেই ছোট হয়ে গেলাম।
প্রয়োজন বড় কঠিন জিনিস, এতো বড় অপমান গায়ে না মেখে পানি দেয়ার এখতিয়ার সেই লোকটিকে ফোন দিলাম। অনুরোধ করলাম, অন্তত যেন ভরা কন্টেইনার থেকে পানি ঢেলে ফেলে দেয়া না হয়। এতোবড় অপমান যেন না করা হয় আমাকে। যাই হোক, তার অসীম দয়া! সেই দুই কন্টেইনার পানি আমি নিতে পারলাম। তার সঙ্গে তিনি এও জানিয়ে দিলেন, আর কখনো যেন এখান থেকে পানি নেয়া না হয়। পানি নেয়া নিষেধ।
আমি আমার প্রয়োজনের কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি কিছু শুনতেই চাইলেন না। আমি তাকে টেক্সট করলাম। তিনি তার উত্তর দিলেন না।
শুধু এই পানির কষ্টের জন্য পরদিনই অসুস্থ্য স্ত্রী আর ছোট্ট মেয়েটাকে পাঠিয়ে দিলাম আমার শ্বশুর বাড়ি। আমার বাসা থেকে অনেক দূর……। বাসা ছেড়ে কিছুতেই যেতে চাইছিলো না আমার স্ত্রী। নিজের ঘর, নিজের বিছানা, আর সর্বোপরি কোনো ইমারজেন্সিতে হাসপাতালে নিতে হলেও তার এখানেই থাকা দরকার। কারণ আমার গাড়ি আর ড্রাইভার এই এলাকাতেই থাকে। কিন্তু পানি ইস্যুতে তাকে হার মানতেই হলো, ছেড়ে যেতে হলো আমাকে। আমার চারতলা বাড়ি আর আমার শ্বশুরের বাড়ির চারতলা, এই আট তলার সিঁড়িগুলো ভাঙ্গার মতো শারীরিক অবস্থাও ছিলোনা তার। এক একটি সিড়ির ধাপ ভাঙ্গে, আর সাথে নিয়ে আসা একটি প্লাস্টিকের টুলে বসে কিছুক্ষণ রেস্ট নেয়, এভাবেই অনেক কষ্টে দীর্ঘ সময় নিয়ে অতিক্রম করে সিঁড়ির পাহাড়।
সেটি ছিলো ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখ, ২০১৫ সাল। যদিও টাটা হসপিটালের ডাক্তার বলেছিলেন, স্বামী-সন্তানের সাথে শেষ সময়টা কাটানোর সুযোগ করে দিতে, কিন্তু আমার মতো অক্ষম-অপদার্থ স্বামী মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীকে সেটুকু সুযোগও দিতে পারলো না। সেদিনই বাড়ি ছেড়ে তার শেষ যাওয়া, এর পর বাড়ি ফিরে এসেছিলো সে, মার্চের ১৮ তারিখ, হাসপাতাল থেকে লাশ হয়ে।
আশ্চর্য হয়ে যাই, এতো কিছু ঘটে যাওয়ার পরও কিন্তু সেই লোকটি বহাল তবিয়তে আছে। আমার সাথে মাঝে-মধ্যেই দেখা হয়। কোনো দু:খ বা অনুশোচনা বোধ—কিছুই নেই তার মধ্যে।
গত একটা বছর আমি যতোটা না আমার মৃত স্ত্রীকে স্মরণ করেছি, তারচেয়ে বেশি স্মরণ করেছি ওই লোকটাকে। প্রতি মুহুর্তে আমার শরীরের প্রতিটি কোষ, আমার দেহের প্রতিটি লোমকূপ দিয়ে তাকে ঘৃণা করেছি। আমি জানিনা, মানুষ এই জীবনেই তার কৃত কর্মের ফল পায় কিনা, যদি সেটা নাও হয়, মৃত্যুর পরের জীবনে তাকে অবশ্যই এই ঘটনার জন্য জবাবদিহি করতে হবে।হে পরম করুনাময়, আমি তোমার দরবারে বিচার দিয়ে রাখলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১১:৫২
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×