লালনের গান শুনছি। লক্ষ করছি জগতের আর অতিজগতের মধ্যে তাঁর সাবলীল অবস্থানের বিস্ময়কর প্রতিচ্ছবি। ধর্ম বলি, সাধনা বলি অথবা আত্মানুসন্ধান সব কিছুই যেন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যবিন্দুর অভিমুখে অগ্রসরমান। যত দিন যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে এই দেখতে পাচ্ছি যে, সেই লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছাতে পারলেই যেন তার সর্বশ্রেষ্ঠ পাওয়াটি হয়। এটিকেই কেউ মোক্ষ বলছেন, কেউ বলছেন নির্বান।
মাঝে, বেশ কিছুদিন পূর্বে, গ্রামের একদল গৃহী বৈষ্ণব সাধকদের সাপ্তাহিক আরাধনা অনুষ্ঠানে ঈশ্বর আর স্বর্গ-নরক সম্মন্ধে তাঁদের বিশ্বাসে সংক্রমিত হয়ে আমারও মনে হয়েছিলো স্বর্গ বোধ করি আকাশের ওপারে থাকে। আর ঈশ্বর সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে এক নিরাকার স্বত্তা। আজ বুঝি, স্বর্গ আসলে আকাশের ওপারে নেই। এই বস্তু জগতের ভেতরেই স্বর্গ। মানুষের ভেতরেই বিভিন্ন রূপে ঈশ্বরের অবস্থান। আরও বিস্তৃত বললে, ঈশ্বর, স্বর্গ-নরক এগুলো কয়েকটি শব্দ মাত্র। এই শব্দগুলোর আড়ালেই এর প্রকৃত রূপ। সেই রূপের সন্ধানই মানব জন্মের মূল সাধনা। রবীন্দ্রনাথের `বৈরাগ্য ও মুক্তি' কবিতাটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে-
কহিল গভীর রাতে সংসার বিবাগী
গৃহ তেয়াগিব আজি ইষ্টদেব লাগি।
কে আমারে ভুলাইয়া রেখেছে এখানে?
দেবতা কহিল 'আমি'। শুনিল না কানে।
সুপ্তিমগ্ন শিশুটিরে আকড়িয়ে বুকে
প্রেয়সী শয্যার পাশে ঘুমাইতেছে সুখে
কহিল, কে তোরা- ওরে মায়ার ছলনা?
দেবতা কহিল 'আমি'। কেহ শুনিল না।
ডাকিল শয়ন ছাড়ি তুমি কোথা প্রভূ
দেবতা কহিল 'হেথা'- শুনিল না তবু।
স্বপনে কাঁদিল শিশু জননীরে টানি
দেবতা কহিল 'ফির' শুনিল না বানী।
দেবতা নিঃশ্বাস ছাড়ি কহিলেন হায়
আমারে ছাড়িয়া ভক্ত চলিল কোথায়?
হায়! কত সহজ জীবন যাপন করেণ সেই সব বৈষ্ণব সাধকেরা। সেদিনের আমার মতো তাঁদের বিশ্বস্ত চিত্তেও সম্ভবত এমন একটা চিত্রই সর্বদা ভেসে ওঠে। কর্মফল বলতে এখনো তাঁদের কেউ কেউ বিশ্বাস করেন পূর্বজন্মের কৃত কর্মের ফল। যা এই জন্মে, জন্মে জন্মে ভোগ করে যেতে হবে এবং তিরাশি লক্ষ যোনি ভ্রমন শেষে মিলবে কাঙ্খিত মুক্তি। তাঁদের এই বিশ্বাস এতোটাই মৌলিক যে সামান্য আঘাতে সেটা ভাঙবারও নয়। যেখানে আমার যুক্তি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও ভীষণ অর্থহীণ।
আহা! বিশ্বাসে মিলায় বস্তু...। আমি যা বিশ্বাস করি তা যদি তাঁদের ‘ঈশ্বর-বিশ্বাস’ এর মতোই গভীর হতো!