“মামাবাড়ির আবদার” কথাটির সাথে পরিচয় নেই, এমন লোক বিশ্বের আর যেখানেই হোক বাংলাদেশে অন্তত খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। মামা থাকুক আর নাই থাকুক, মামাবাড়ির স্নেহ এবং প্রশ্রয় জীবনে কোনদিন জুটুক অথবা নাই জুটুক – “মামা”, “মামাবাড়ি” শব্দগুলোর প্রতি বাঙালীর মনের টান একেবারেই চিরকালীন। এদেশের সব শিশুর কাছে তাই চাঁদ যেমন, হিংস্র বাঘ-সিংহও তেমনই মামা হিসেবেই আপন।
সৌভাগ্যবশত: আকাশের চাঁদ কিংবা বাঘ-সিংহ নিয়ে মামার অভাব আমাকে পূরণ করতে হয়নি। বছরে অন্তত একবার বেড়াতে যাওয়ার মতো মামাবাড়িরও আমার অভাব হয়নি। অভাব হয়নি মামাবাড়ির আবদারেরও। বরং মামাবাড়ি নিয়ে রয়েছে অসংখ্য স্মৃতি; কিছু শৈশবের, কিছু কৈশোরের, কিছু তারও পরের। এতদিন পর সব স্মৃতি মনের গভীরে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে, সময়ের ক্রম অনুযায়ী তাদের সাজানো একেবারেই অসম্ভব।
মায়ের চাকরীর সুবাদে বছরের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশী সময় আমরা থাকতাম দূরে, স্ব-জনহীন, অনেকটা প্রবাসই বলা চলে। নিজের বাড়ী, মামাবাড়ি সব কিছুই ছিল তাই দারুণ আকর্ষণের। অবশ্য, মামাবাড়ির চেয়ে নিজের বাড়ীই আমাকে টানত বেশী। কারণ আর কিছুই নয়, বয়সে একটু বড় আমার এক জেঠতুতো ভাই। অসম্ভব সাহস, অফুরন্ত প্রাণশক্তি আর অকৃত্রিম আন্তরিকতা দিয়ে আমার ছোট্ট হৃদয়টিকে সে দখল করে নিয়েছিল খুব সহজেই। বড়দের ধমক কিংবা প্রচণ্ড মার কোনটাই তাকে দমাতে পারতোনা। দুরন্তপনায় তার সমান আমি কখনোই ছিলাম না, তবু অ্যাডভেঞ্চারের নেশা তার চেয়ে আমার কোন অংশেই কম ছিলনা।
সে তুলনায় মামাতো দাদা ছিলেন অনেকটা আমার-ই মত, শাসনের বেড়াজালে বন্দী। সারাক্ষণ লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকাটা নেহাতই পানসে। সেই বিরক্তি মাসীদের অশেষ স্নেহেও দূর হতোনা এতটুকুও। তার চেয়ে মেজ মামার শিশুসুলভ দুষ্টুমি ছিল অনেক মজার। আর তাই শৈশবের সেই বাড়ীতে তিনিই ছিলেন আমার সবচাইতে প্রিয়।
আদরের অভাব না থাকলেও মামাবাড়িতে আমার শৈশবটা নিরুপদ্রব ছিলোনা মোটেও। এর কারণ আমার মা। মামাবাড়ি এসেও তাঁর কড়া শাসন এবং মারের হাত থেকে নিস্তার ছিলনা। এছাড়া বাবা তো ছিলেনই। কিন্তু সবচেয়ে বেশী ভয় পেতাম একজনকেই। তিনি বড়মামা। কোনদিন তিনি বকা দিয়েছেন বা উঁচু গলায় কথা বলেছেন – এরকম কিছুই স্মৃতিতে নেই। তবু তাঁকে ভয় পেতাম, ভয়টা সংক্রামক বলেই।
যে সময়ের কথা বলছি, বাড়ীতে তখনো টিউবওয়েল বসেনি। কাছের এক দিঘী থেকে মাটির কলসি ভরে জল আনা হতো। এক বিকেলে বড় মাসীর সাথে আমিও গিয়েছিলাম - সেটা মনে আছে এখনো। ইলেক্ট্রিসিটি তখনো পৌঁছেনি, সন্ধ্যা হলেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসতো। মাসীরা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন ল্যাম্প জ্বালাতে, আর আমার মনে জায়গা করে নিত ভয়ংকর সব ভুতের ভয়।
তখন গাছও ছিল প্রচুর। দিনের বেলাতেই অন্ধকার লেগে থাকত। আমের গাছ, সুপারি গাছ আরও কত কি! দুটো আতা গাছের কথা মনে আছে, ছিল রান্নাঘরের খুব কাছেই। একটা ছিল ছোট, আর সেটাই হতো আমার ঘোড়া, টারজান টারজান খেলার সাথী। সারা বাড়ী, উঠোন, এমনকি পুকুরও গাছের পাতায় ভর্তি হয়ে থাকত। দিদিমা প্রায়ই পাতা কুড়তেন, আমের দিনে আমি কুড়তাম আম। দিদিমার সাথে খুব গল্প হতো তখন, যদিও গল্পের বিষয়বস্তু কিছুই আর এখন মনে নেই। দিদিমার ব্যক্তিত্বই আর দশজন থেকে তাঁকে আলাদা করে রাখতো। সে কারণেই হয়তো তাঁর সাথে খুব বেশী ঘনিষ্ঠতা আমার হয়ে উঠেনি। লম্বা বারান্দার একপ্রান্তে ছিল দিদিমার থাকার জায়গা। সেখানেই সাজানো থাকত তাঁর হুঁকো এবং তার সরঞ্জাম। এই হুঁকোর প্রতি আমার প্রচণ্ড কৌতূহল ছিল। কেন গুড়গুড় শব্দ হয়, কিভাবে ধোঁয়া বের হয় এসবই ছিল আগ্রহের বিষয়। মাঝে মাঝে দিদিমার বয়সী আরও কয়েকজন আসতেন, গল্প করতেন, হুঁকোয় টান দিতেন। কিন্তু এই স্মৃতির কতটা শৈশবের আর কতটা যে কৈশোরের- ঠিক করে তা বলা খুবই মুশকিল।
স্মৃতি ব্যাপারটাই কেমন যেন অদ্ভুত ধরণের! হাজার হাজারটা স্মৃতির মধ্যে কোনটা যে থেকে যায়, কোনটা হারিয়ে যায়, আর কোনটার সাথে কোনটা যে জুড়ে বসে – সেটা বোঝা দুঃসাধ্যই। স্পষ্ট মনে আছে ছোটমামার বিয়ের খুবই ছোট্ট একটুকরা স্মৃতি, অথচ শৈশবের আর কোথাও তাঁর কোন অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্ব নেই মামীদেরও। তাঁদের নিয়ে স্মৃতিগুলো মনে হচ্ছে কৈশোরের, কোনটাই শৈশবের নয়। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, খুবই স্পষ্ট মনে করতে পারি এক মামাতো ভাইকে আদর করতে গিয়ে দোলনা থেকে ফেলে দেওয়ার স্মৃতি, অথচ কোনভাবেই মনে করতে পারিনা ওর চেয়ে একটু বড় আরেক ভাই এবং বোনের কোন স্মৃতি।
থাক। স্মৃতি নিয়ে আর টানাটানি নয়। ফিরে আসি বর্তমানেই। মনে পড়েনা শেষ কবে গিয়েছি সেই মামাবাড়িতে। হয়তো এক যুগ, হয়তো তারও বেশী। এরই মাঝে পাল্টে গেছে অনেক কিছু, মানুষ, পরিবেশ, এমনকি আমিও। পাল্টে গেছে আমার দৃষ্টিভঙ্গি, আমার ভাল লাগা, ভাল না লাগার কারণগুলি। শুধু পাল্টায়-নি অতীত আর তার সব স্মৃতি। বেঁচে থাকার ব্যস্ততায় প্রচণ্ড ব্যস্ত এই আমি সেই স্মৃতি নিয়েই এখন ছুটে চলছি অন্য কোথাও, অবশ্যই অন্য কিছুরই আশায়।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


