somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সময়ের স্রোতে - শারদোৎসব

১৪ ই অক্টোবর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঝকঝকে আকাশে তুলো তুলো মেঘ উড়িয়ে; হালকা, কখনো জোরালো বাতাসে নদীর ধারের সাদা কাশের বন দুলিয়ে, টুপটাপ ঝরতে থাকা শিউলি ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে- প্রতিবছর শরৎ আসে, বর্ষার আড়ালে মুখ লুকিয়ে। ভাদ্র আর আশ্বিন, এই নিয়েই তার কারবার। তবু তার অপেক্ষায়, বিশেষত আশ্বিনের আশায়, সারা বছর দিন গোনে বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায়। দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব- যে নামেই বলি না কেন, এই শারদোৎসবই বাঙালী হিন্দুর প্রধান উৎসব। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা এর কেন্দ্র হলেও, বাদ পড়েনা বাংলাদেশ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ পাশ্চাত্য, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যও।

ঠিক কখন কোথায় কিভাবে দুর্গাপূজার প্রচলন - নির্দিষ্ট করে সে প্রশ্নের উত্তর দেয়া একরকম অসম্ভব। তবুও জানার আগ্রহে, প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে (সহজ কথায় মাটি খুঁড়ে), ভারতে এলাহাবাদের কাছে যে মূর্তিটি পাওয়া গেছে, তাকেই এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে পুরনো দেবীমূর্তি বলে ধরা হয়। কার্বন-ডেট অনুযায়ী এ মূর্তির বয়স ২২,০১৩ থেকে ২৫,০১৩ বছর। এছাড়া পাকিস্তানে বেলুচিস্তানের মেহেরগড়ে কয়েক হাজার ছোট ছোট নারীমূর্তি পাওয়া গেছে, যার মধ্যে সবচেয়ে পুরনোটির বয়স ৭,৫১৩ বছর। এই সব মূর্তি ও আরও অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার থেকে এটা একরকম নিশ্চিত যে, বর্তমানে প্রচলিত সব দেবীপূজা - ওই সমস্ত প্রাচীন আচার এবং রীতি-নীতিরই বিবর্তিত রূপ।

সিন্ধু সভ্যতায়ও খুঁজে পাওয়া গেছে দেবী দুর্গার অস্তিত্ব। প্রাচীন হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো ঘিরে গড়ে উঠেছিল এই সভ্যতা, টিকে ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০ সাল পর্যন্ত। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সাহিওয়াল জেলা থেকে ৩৫ কি:মি: পশ্চিমে ছিল হরপ্পা। আর মহেঞ্জোদারো ছিল পাকিস্তানেরই সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলাতে। সিন্ধু সভ্যতার ধর্মবিশ্বাসে দেবী ছিলেন সর্ব শক্তিমতী আদর্শ নারী, দেবতা শিবের স্ত্রী, পরিচিতা ছিলেন “প্রকৃতি” বা “শক্তি”, “জগদম্বা” এবং “জগন্মাতা” নামে। উত্তর ভারতের এই সমস্ত বিশ্বাস ও রীতিনীতি ছড়িয়ে পড়েছিল দক্ষিণ ভারতের অভিজাত দ্রাবিড় সভ্যতাতেও।

সিন্ধু সভ্যতার পর গড়ে ওঠে বৈদিক সভ্যতা। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ সাল - এই সভ্যতার সময়কাল। বৈদিক বিশ্বাসে “অগ্নি”, “বায়ু” এবং “ইন্দ্র” এই তিন দেবতাই প্রধান হয়ে ওঠেন। দেবীরা গুরুত্ব হারিয়ে কোনরকমে টিকে থাকেন দেবতাদের স্ত্রী হয়েই। তবে সিন্ধু এবং দ্রাবিড় ধর্মের মহাদেবী, বেদেও স্ব-মহিমায় থেকে যান - দেবতাদের জননী “অদিতি” হয়ে।

এরপরে দেবী দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায় “কেন উপনিষদ”-এ, যেখানে দেবী প্রধান তিন দেবতার মুখোমুখি হন পরম ব্রহ্মের (দেবতা ব্রহ্মা নয়) শক্তি হিসেবে। খ্রিষ্টপূর্ব ৭৫০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ সালের মধ্যে রচিত হয়েছিল এই উপনিষদ। কেন উপনিষদের কাহিনীটা সংক্ষেপে এরকম: একবার দেবতা ও অসুরদের মধ্যে যুদ্ধে দেবতারা জয় লাভ করলে, দেবতা অগ্নি, বায়ু এবং ইন্দ্র জয়ের গর্বে নিজেদের ক্ষমতা ও কৃতিত্ব নিয়ে অহংকার করতে থাকেন। তখন এক রহস্যময় পুরুষ তাঁদের সামনে উপস্থিত হয়ে, নিজ নিজ ক্ষমতা দেখাতে তাঁদের আহ্বান করেন। তিন দেবতাই তাতে চরমভাবে ব্যর্থ হন। ইন্দ্র তখন তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে তিনি অদৃশ্য হয়ে যান এবং পরিবর্তে দেবী উমা হৈমবতী দৃশ্যমান হন। ইন্দ্রের প্রশ্নের উত্তরে দেবী জানান - ওই পুরুষই ব্রহ্ম এবং এই বিজয় সেই পরম ব্রহ্মেরই বিজয়।

আদি কবি বাল্মীকি, আনুমানিক খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে, তাঁর “রামায়ণ” মহাকাব্যটি যখন লেখেন, তখনো বৈদিক ধর্মের রক্ষণশীল অনুসারীরা, শিব এবং দেবীকে তাঁদের দেবমন্ডলীর অন্তর্ভুক্ত করেননি। তবে দেবীপূজা প্রচলিত ছিল তখনকার আদিবাসী সমাজে, যার উল্লেখ পাওয়া যায় আরও কিছু সময় পরে লিখিত “মহাভারত”-এ।

স্পষ্টভাবে দুর্গাপূজার প্রথম বর্ণনা পাওয়া যায় “ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ”-এ, যা লেখা হয়েছে গুপ্ত যুগে, অর্থাৎ ৩০০ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। এই পুরাণ অনুযায়ী সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা করেন কৃষ্ণ, সৃষ্টির শুরুতেই।

বাংলায় প্রচলিত দুর্গাপূজা মূলত মহিষাসুর-মর্দিনীর পূজা। এ পূজার বিস্তৃত বিবরণ আছে “মার্কণ্ডেয় পুরাণ”-এ। মূল পুরাণটির রচনাকাল খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী হলেও, দুর্গাপূজার বর্ণনাসহ “দেবীমাহাত্ম্যম” বা “দুর্গা সপ্তশতী” অথবা “শ্রীশ্রীচণ্ডী” অংশটি যোগ করা হয়েছিল আরও অনেক পরে। মার্কণ্ডেয় পুরাণ ছাড়াও দুর্গাপূজার বর্ণনা পাওয়া যায় “কালিকা পুরাণ” (রচনাকাল ৯ম-১০ম শতাব্দী) এবং “বৃহদ্ধর্ম পুরাণ”-এ (রচনাকাল ১২শ শতাব্দী)।

মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবী দুর্গার চারটি কাহিনী আছে। প্রথমটি রাজা “সুরথ”-এর, যা আসলে দেবীমাহাত্ম্যমের ভূমিকা মাত্র। অপর তিনটি যথাক্রমে মধুকৈটভ, মহিষাসুর এবং শুম্ভ-নিশুম্ভের। সুরথ রাজার কাহিনী সংক্ষেপে এরকম: রাজা সুরথ একবার এক যুদ্ধে পরাজিত হন এবং সেই সুযোগে প্রিয় অমাত্যগণ তাঁর সম্পদ এবং সেনা দখল করে নেন। মনের দুঃখে রাজা বনে চলে যান এবং ঘুরতে ঘুরতে ঋষি মেধার আশ্রমে উপস্থিত হন। ঋষি মেধা রাজা সুরথকে যথাযোগ্য সম্মানের সাথেই আশ্রয় দেন। তবু রাজা তাঁর হারানো রাজ্যের ভাল-মন্দ চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠেন। সেই আশ্রমেই তিনি “সমাধি” নামের এক বৈশ্যের (মানে ব্যবসায়ীর) সাথে পরিচিত হন এবং কথা প্রসঙ্গে জানতে পারেন, সমাধি বৈশ্যে নিজের স্ত্রী-পুত্র দ্বারা বিতাড়িত। তবু তিনি সুরথ রাজার মতোই পরিবারের ভাল-মন্দ চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। সবকিছু ভেবে তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগল, যারা তাঁদের সাথে এত অন্যায় করেছে, কেন তাঁরা এখনো তাদের প্রতি এরকম মায়াবদ্ধ হয়ে আছেন। দুজনই ঋষি মেধার কাছে এর উত্তর জানতে চাইলে ঋষি তাঁদের বললেন, এসবই পরমেশ্বরী শক্তি মহামায়ার প্রভাব। রাজা সুরথ আরও জানতে চাইলে ঋষি মেধা রাজাকে দেবীমাহাত্ম্য সংক্রান্ত বাকী তিনটি কাহিনী শোনান। সবশেষে ঋষির কথায় অনুপ্রাণিত রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি নদীর তীরে তিনবছর কঠোর তপস্যায় দুর্গার পূজা করেন। তপস্যা শেষে দেবীর কৃপায় রাজা সুরথ তাঁর হারানো রাজ্য ফিরে পান এবং বৈশ্য সমাধি লাভ করেন তত্ত্বজ্ঞান।

শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত কাহিনীগুলির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় মহিষাসুর বধের কাহিনীটি। এই কাহিনী অনুসারে: অনেক অনেক কাল আগে রম্ভাসুর নামে অসুরদের এক রাজা ছিলেন। তাঁর ছেলে মহিষাসুর অমরত্ব লাভের আশায় ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন। তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা বর দিতে চাইলে তিনি অমরত্ব প্রার্থনা করেন। কিন্তু ব্রহ্মা রাজী না হওয়ায়, মহিষাসুর আরও কঠিন তপস্যা করতে থাকেন। ব্রহ্মা আবারও বর দিতে চাইলে মহিষাসুর অমরত্ব ছাড়া আর কিছু চান না বলে জানিয়ে দেন। অনেকবার ব্যর্থ হয়ে শেষে ব্রহ্মা মহিষাসুরকে ত্রি-ভুবনজয়ী হওয়ার বর দেন এবং সাথে শর্ত জুড়ে দেন - একমাত্র নারী ছাড়া আর কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারবেনা। বর পেয়ে মহিষাসুর স্বর্গ ও দেবতাদের রাজা ইন্দ্রের সাথে যুদ্ধ শুরু করেন এবং একশ বছর যুদ্ধের পর দেবতাদের পরাজিত করে তাঁদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেন। বিতাড়িত দেবতারা প্রথমে ব্রহ্মার কাছে যান, তারপর ব্রহ্মাকে সাথে নিয়ে শিব ও বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হন। দেবতাদের মুখে মহিষাসুরের অত্যাচারের কথা শুনে তাঁরা সবাই প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেন এবং সেই ক্রোধে প্রথমে বিষ্ণু,পরে শিব ও ব্রহ্মার মুখ থেকে প্রচণ্ড তেজ বের হতে থাকে। আরও পরে ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতাদের শরীর থেকেও তেজ বের হতে থাকে এবং সমস্ত তেজঃপুঞ্জ একত্রিত হয়ে হিমালয়ে ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে এক অপরূপা দেবীমূর্তি ধারণ করে। ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে হওয়ায় এই দেবী কাত্যায়নী নামে পরিচিতা হলেন। এক এক দেবতার প্রভাবে দেবীর এক একটা অঙ্গ উৎপন্ন হল। পরে প্রত্যেক দেবতা তাঁদের অস্ত্র দেবীকে দান করেন। হিমালয়, দেবীকে তাঁর বাহন হিসেবে সিংহ দান করেন। সব নিয়ে দেবী অষ্টাদশভূজা (অর্থাৎ ১৮ হাত) মহালক্ষী রূপে মহিষাসুরকে বধ করার জন্য যাত্রা করেন। বাঙালীদের কাছে এই দেবীই দশভুজা দুর্গা হিসেবে পরিচিত।

দেবী ও তাঁর বাহন সিংহের সিংহনাদে ত্রিভুবন কাঁপতে থাকলে, মহিষাসুর প্রথমে তাঁর বড় বড় যোদ্ধাদের দেবীর সাথে যুদ্ধে পাঠালেন। দেবী মহিষাসুরের সব সৈন্য এবং বীরদের নিহত করলে মহিষাসুর নিজেই দেবীর সাথে যুদ্ধ করতে এলেন। যুদ্ধে মহিষাসুর হাতি, মহিষ প্রভৃতি নানান রূপ ধরে দেবীকে আক্রমণ করেন। কিন্তু দেবী সবকিছু ব্যর্থ করে দেন এবং শেষে লাফ দিয়ে মহিষরূপী মহিষাসুরের পিঠে চড়ে খড়গ দিয়ে সেই মহিষের মাথা কেটে ফেলেন। তখন মহিষাসুর স্বরূপে বের হয়ে আসলে দেবী তাঁর বুকে ত্রিশূল বিধে হত্যা করেন। পুরাণ অনুসারে, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে দেবী কাত্যায়নী আবির্ভূতা হয়েছিলেন; শুক্লা সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে ঋষি কাত্যায়ন দেবীকে পূজা করেন এবং দশমীতে দেবী মহিষাসুর বধ করেন।

দেবীমাহাত্ম্যম বা শ্রীশ্রীচন্ডীমতে দুর্গাপূজার সঠিক সময় চৈত্র বা বসন্ত। তাই এর আর এক নাম “বাসন্তী পূজা”। বাসন্তী পূজা এখনও প্রচলিত থাকলেও বাঙালিদের কাছে জনপ্রিয়তায় অনেক অনেকদূর এগিয়ে আশ্বিনের অকালবোধন। এই অকালবোধনের বর্ণনা পাওয়া যায় পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত “কৃত্তিবাসী রামায়ণ”-এ। মূল রামায়ণে দুর্গা পূজার কোনও বিবরণ না থাকলেও, কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর বাংলা রামায়ণে দেবীমাহাত্ম্যম এবং কালিকা পুরাণের ঘটনা সাজিয়ে রামের দুর্গাপূজার বর্ণনা দিয়েছেন। বৈষ্ণব কবি হয়েও তিনি হাত বাড়িয়েছিলেন শাক্ত পুরাণের দিকে, কারণ বাঙালী কৃত্তিবাস পোশাক-আশাকে, খাদ্যাভ্যাস ও স্বভাবে বাঙালি করে তুলেছিলেন রামায়ণের চরিত্রদের।

কৃত্তিবাসী রামায়ণ অনুসারে, রাম-রাবণের যুদ্ধে দেবতা ব্রহ্মা রাবণ বধের জন্য দেবী দুর্গার পূজা করার পরামর্শ দেন রামকে। পূজার উদ্দেশ্যে রাম অকালে দেবীর বোধন বা ঘুম ভাঙান বলে, এ পূজার আরেক নাম “অকালবোধন”। পুরাণ মতে- মানুষের ছয় মাসে দেবতাদের একদিন এবং একইভাবে ছয় মাসে একরাত। আষাঢ় থেকে অগ্রহায়ণ - এই ছয়মাস হল দক্ষিণায়ন। বছরের এসময় দেবতাদের জন্য রাত এবং তাঁরা তখন ঘুমিয়ে থাকেন। এই ছয়মাসে শ্রাদ্ধ-তর্পণ করা গেলেও, দেব-দেবীর পূজা মোটেও শাস্ত্র অনুমোদিত নয়। তাই অকালবোধন করে এবং এরপর দুর্গাষষ্টী, মহাসপ্তমী ও মহাষ্টমী তিথিতে রীতিমতো চণ্ডীপাঠ করে তন্ত্রমতে রাম দেবী দুর্গার পূজা করেন। মহানবমীতে ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে পূজার আয়োজন করা হলে, রামভক্ত হনুমান সেই পদ্ম জোগাড় করে আনেন। কিন্তু পূজার সময় রামকে পরীক্ষা করার জন্য দেবী একটি পদ্ম লুকিয়ে ফেলেন। পদ্ম না পেয়ে পদ্মলোচন (পদ্মের মত লোচন বা চোখ) রাম নিজের এক চোখ তুলে অঞ্জলি দিতে গেলে স্বয়ং দেবী তাঁকে নিরস্ত করেন এবং রামকে রাবণবধের বরদান করেন।

রাম-রাবণের যুদ্ধ হয় সপ্তমীতে। অষ্টমীর সন্ধ্যায় সন্ধিপূজার শেষে নবমী শুরু হওয়ার সময়ই রাম রাবণকে নিহত করেন। রাবণের শেষকৃত্য হয় বিজয়া দশমীতে। তাই উত্তর ভারতে “দশেরা” উৎসব শেষে রাবণের কুশপুত্তলিকা দাহ করার রীতি চালু আছে। রাম-রাবণের যুদ্ধ শেষে রাবণকে দাহ করতে সব মিলিয়ে ঠিক চারদিন সময় লেগেছিল বলে, এখনকার শারদোৎসবও ওই চারদিনের মধ্যেই নির্দিষ্ট হয়ে আছে।

এবার এসব পৌরাণিক কাহিনী ছেড়ে, একটু ইতিহাসের খাতা খুলে দেখা যাক। ইতিহাসের পাতায় বিশাল আয়োজনে দুর্গাপূজার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৫০০ সালে। এক সূত্রমতে, দিনাজপুর ও মালদার জমিদারই অবিভক্ত বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। অন্য সূত্রমতে, ১৬০৬ সালে তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ অথবা নদীয়ার ভবানন্দ মজুমদার বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। শোনা যায় কংসনারায়ণ দুর্গোৎসব করেছিলেন রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞের বিকল্প হিসেবে। সেই আমলে তাতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৯ লাখ টাকা। বাংলার অন্যান্য প্রাচীন জমিদার বাড়ির দুর্গাপূজাগুলিও সব কংসনারায়ণের পরপরই শুরু হয় এবং কংসনারায়ণের দেখানো পথেই সাড়ম্বরে পালিত হতে থাকে। খুব সম্ভব দুর্গাপূজার শাস্ত্রীয় রূপটি ছাপিয়ে আড়ম্বরের চাকচিক্যটাই বড়ো হয়ে ধরা দেয় মানুষের মনে।

বাংলায় সপরিবার দুর্গার যে মূর্তি দেখা যায়, ১৬১০ সালে এর প্রচলন করেন কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার। সপরিবার দুর্গামূর্তিতে- মধ্যে থাকেন দেবী দুর্গা, সিংহের পিঠে মহিষাসুর-মর্দিনী হয়ে। তাঁর ডানপাশে উপরে লক্ষ্মীদেবী ও নিচে গণেশ; বাঁপাশে উপরে দেবী সরস্বতী ও নিচে কার্তিকেয়। সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার কার্তিকেয়র রূপ দেন জমিদার-পুত্রের, যা এর আগে ছিল সম্রাট সমুদ্র-গুপ্তের আদলে যুদ্ধের দেবতা রূপে। এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের হলেও, বাংলায় প্রায় সবখানেই দেবী দুর্গা সপরিবারে পূজিতা হন। বাঙালিদের কাছে তিনি বাংলারই মেয়ে, পূজার সময় যিনি সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়ী আসেন বেড়াতে এবং দশমীতে ফিরে যান স্বামীর ঘরে।

ব্রিটিশ আমলে অধিকাংশ জমিদারদের উদ্দেশ্য ছিল পূজা করে নিজেদের প্রতিপত্তি দেখানো এবং ক্ষমতাসীন ব্রিটিশদের নানা আয়োজনে আকৃষ্ট করে তাদের অনুগ্রহ লাভ করা। তাই অনেক সময় শাস্ত্রীয় পূজা হত গৌণ, মুখ্য হয়ে উঠত পায়রা ওড়ানো, বাইজি নাচের আসর বসানো- এরকম সব আয়োজন। উত্তর কলকাতার রাজা নবকৃষ্ণ দেব প্রথম এর চল শুরু করেন। এরপর দুইশত বছরের শাসনামলে ব্রিটিশ শাসকদের অনেকেই প্রভাবশালী ধনীদের বাড়ির পূজায় হাজিরা দিয়েছেন সপরিবারে। প্রতিমাকে প্রণাম জানানো বা প্রসাদ খেতেও তাঁরা পিছিয়ে থাকতেন না। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অডিটর জেনারেল জন চিপস (John Chips) নিজ উদ্যোগে বীরভূমে তাঁর কার্যালয়ে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। অবশ্য ১৮৪০ সালে, ইংরেজ সরকার নিজেই, আইন করে বাঙালির দুর্গাপূজায় ইংরেজদের অংশগ্রহণ বন্ধ করে দেন।

বাংলায় বারো-ইয়ারি বা বারোয়ারি দুর্গাপূজার সূচনা ১৭৯০ সালে। হুগলীর গুপ্তি-পাড়া অঞ্চলের ১২ জন বন্ধু মিলে সেই দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। এই বারোয়ারি পূজাই আরও পরে হয়ে দাঁড়ায় সর্বজনীন দুর্গোৎসব। সর্বজনীন মানে সকলের চাঁদায়, সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণে পূজার আয়োজন। প্রকৃত অর্থে বাংলায় সর্বজনীন দুর্গোৎসবের শুরু ১৯১০ সালে। “সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা” সেই পূজার আয়োজন করে উত্তর কলকাতার বাগবাজার এলাকায়। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে দুর্গা হয়ে ওঠেন পরাধীন দেশমাতৃকার প্রতীক। এরই উদ্দীপনায় বাঙালি সমাজে সর্বজনীন দুর্গাপূজা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং কালক্রমে অবিভক্ত বাংলার জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়।

আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন, অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে পূজা শুরু হলেও, পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন, অর্থাৎ মহালয়া থেকেই পূজার আমেজ শুরু হয়ে যায়। (প্রয়াত) বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র এবং (প্রয়াত) পঙ্কজ কুমার মল্লিকের কণ্ঠে অসাধারণ চণ্ডীপাঠের আকর্ষণে বাঙালী হিন্দুরা মহালয়ার দিন ভোর চারটায় জেগে ওঠেন। এই চলের শুরু অবশ্য ১৯৫০ সালে। সে বছর মহালয়ার দিন প্রচারিত হয় “মহিষাসুর-মর্দিনী” নামে দুই ঘণ্টার একটি রেডিও অনুষ্ঠান। প্রথম থেকেই অনুষ্ঠানটি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠে বাঙালী সমাজে। শুরুতে লাইভ প্রচার করলেও, পরে রেকর্ড করেই প্রচার করা হতে থাকে এই অনুষ্ঠান।

এখনকার দুর্গাপূজা ধর্মের গণ্ডী ছাড়িয়েও এগিয়ে গেছে অনেক অনেক দূর। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সবকিছু মিলিয়ে দুর্গাপূজা এখন বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। উপহার দেয়া-নেয়া, কেনা-কাটায় এর ব্যবসায়িক দিকটা যেমন জমজমাট; তেমনি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে যুক্ত হন রাজনীতিবিদরাও। এছাড়া দুর্গাপূজা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত শিল্প প্রদর্শনীও। চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা, বিনোদন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ম্যাগাজিন প্রকাশনা, টিভি ও রেডিওর বিশেষ অনুষ্ঠানসহ হয় আরও অনেক কিছু। যদিও থিম বা বিষয়ভিত্তিক মণ্ডপ ও প্রতিমা নির্মাণসহ আরও অনেক কিছু নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা বা সংস্কৃতির কারণে পূজাগুলোর বাজেট বেড়ে আকাশে উঠেছে।

দুর্গাপূজার ইতিহাস, সময়ের সাথে সাথে তার পরিবর্তন- এসব নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও, আমাদের মত সাধারণ মানুষদের অতসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই একটুও। আমরা শুধু চাই উৎসবের আনন্দে গা ভাসাতে। ওসব বিতর্ক এবং বড় বড় আলোচনা তোলা থাকুক বড় বড় ইতিহাসবিদদের জন্যই। হাজারটা দুঃখ এবং সমস্যায় জর্জরিত আমাদের জীবনে, শারদোৎসব নিয়ে আসুক একটুখানি সুখ, একটুখানি আনন্দ। সামান্য মানুষ হিসেবে চাওয়াও আমাদের খুব সামান্যই।
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×