somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিদায় হে বিদ্যাপীঠ,বিদায় হে ক্যাম্পাস...

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১১:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



শেষ কবে চোখের পানি ফেলেছিলাম,মনে নেই।হয়তো বা বাবার শাসনে বা টিচারের বকুনিতে।তখনকার কাঁদুনিতে যতটা না শোক ছিল,তার চেয়ে বোধ হয় ক্ষোভ ছিল বেশী।আবেগকে রুদ্ধ করতে গিয়ে মানুষের চোখে যে জল আসে,তার ধারা যে কতটা শক্তিশালী হয় সেটা অনুভব করলাম ক্যাম্পাস থেকে আমাদের বিদায় বেলায়।"জীবন-আবেগ রুধিতে না পারি" কবির এই কথাটি কতটা সত্য অনুধাবন করলাম গত কয়েকটা দিনে।এ অনুভূতি ব্যক্ত করার মত নয়,কেবল আমরা যারা আমাদের নাড়ীর টান ছিঁড়ে এসেছি তারাই বুঝতে পারছি এই বিদায়ের ব্যথা।

আমাদের বিদায়ের সুর বেজেছিল ঈদের ছুটির পর থেকেই।এ ক্যাম্পাস ছেড়ে অন্যত্র যেতে হবে,মনের ভেতর এক অজানা ভয়-শোক-হতাশা মিশ্রিত এক অদ্ভুত অনুভুতির শুরু সেখান থেকেই।এরপর স্যারদের সিগনেচারের জন্য ওয়ার্ডগুলো দৌড়োদৌড়ি করতে হয়েছে সবাইকে।আমাদের তখন মনে হয়েছে,ইশ...এই ওয়ার্ডে আর আসা হবে না,নাইট করা হবে না।আমাদের হাসপাতাল যেন একটি বৃক্ষ,একে একে যেন এই বৃক্ষের শিকড়গুলো কেউ কেটে দিচ্ছে আর গাছটা ধীরে ধীরে প্রাণশূন্য হয়ে পড়ছে।অথচ এই বৃক্ষের প্রাণরসের বিনিময়ে আমরা ধীরে ধীরে কলি থেকে প্রস্ফুটিত পুষ্পে পরিণত হয়েছি।

অবশেষে সেই দিনটি চলে এল।নভেম্বরের ত্রিশ তারিখ।সকাল থেকেই সবার প্রস্তুতি,কখন র‍্যালি হবে,কে কি সাজব।যে ফরটি টু ক্যাম্পাসে হাতে গোনা কয়েকটা প্রোগ্রাম করেছে,তারাই এক দিনের প্রস্তুতিতে এম এম সি-র ইতিহাসে অন্যতম সাফল্যজনক একটি সারম্বর র‍্যালি করে ফেলল।আমরা সবাই অবাক হয়ে গেলাম,একটু আফসোসও খেলা করে গেল মনে,"আরে...আমরাও তো পারি।আমরাও তো ইচ্ছে করলে প্রতি বছর কেন,প্রতি মাসে মাসে সফলতম প্রোগ্রাম উপহার দিতে পারতাম।"সেদিন বিকেলে আবার প্রাতিষ্ঠানিক কাজ,সবাই হাসপাতালের অফিস রুমে জড়ো হলাম।জড়ো হলাম আমাদের চলে যাবার পাসপোর্ট "Internship completion certificate" এর জন্য।তখনও আমাদের গতানুগতিক ব্যস্ততা,হুড়োহুড়ি।মনে হচ্ছিল আমরা বোধ হয়,কোন পরীক্ষার জন্য সবাই মিলে ফর্ম ফিলআপ করছি।হায় ! এই ফর্ম ফিলআপ আমাদের যেন মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে এক কঠিন যুদ্ধে ঠেলে দিল।

রাত হল।সবাই একত্রিত হলাম আমাদের কলেজ ক্যান্টিনে।রাতভর প্রোগ্রাম চলল,আমরা সবাই মেতে উঠলাম আনন্দ উৎসবে।প্রদীপ নেভার আগে যেমন শেষবারের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠে,আমরাও বোধ হয় সেরকম প্রজ্বলিত হয়ে উঠলাম।নেচে গেয়ে পার হল প্রায় সারা রাত,আমাদের উৎসাহের কমতি নেই,আনন্দের ভাটা নেই।যে ক্যাম্পাসে কাটিয়েছি সাড়ে ছয় বছর,যে ক্যান্টিনগুলোতে খেয়ে বেড়ে উঠেছে আমার দেহের কোষ,তাকে ছেড়ে যাব কিভাবে?অনুষ্ঠানের শেষ ভাগে আমার মনে করুণ আর্তিতে ভরে গেল,আমি আর বন্ধুদের সাথে নাচতে গাইতে পারলাম না।দূর থেকে বসে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমার বন্ধুদের দিকে।

ধীরে ধীকে ফিকে হয়ে গেল সব রং,শুন্যতা এসে ভর করল সবার হৃদয়ে।হায় রে বাস্তবতা ! তুই এত নিষ্ঠুর কেন?কেন তুই কেড়ে নিতে চাস আমার বন্ধুদের?যাদের সাথে কাটিয়েছি মুহুর্তের পর মুহুর্ত,এক দিনের ব্যবধানে তাদের হারাব সময়ের গহ্বরে,এ কেমন নিয়তির খেলা?আমি আর পারছিলাম না,মনে হচ্ছিল চিৎকার করে বলি,"না...না...আমরা যাব না,আমরা থাকব আমাদের ক্যাম্পাসে।প্রতিদিন লেকচারে যাব দল বেঁধে,একসাথে আইটেম-কার্ড-টার্ম-প্রফ দিব।আমরা মেডিকেল স্টুডেন্ট হব,আমরা ইন্টার্ন হব আবার।দরকার নেই আমার বড় বড় প্রফেসর হবার।আমরা থাকব,আমরা ফর্টি টু হিসেবেই থাকব।"

চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি,আমাদের ব্যাচের শক্ত মনের ছেলেটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে।কিছু বোঝার আগেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ কেঁদে ফেলল।কি করব,কি বলব ওকে?আর বলবই বা কিভাবে?নিজের অজান্তেই তখন আমার চোখে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।ধীরে এই বৃষ্টি ছড়িয়ে গেল চোখ থেকে চোখে,অন্তর থেকে অন্তরে।ক্যান্টিনের ছেলেরা অবাক হয়ে দেখছে,মামারা খালারা কাঁদছে কেন এইভাবে?এমন কি দুঃখ তাদের?হায় রে...কিভাবে বুঝাব ওদের,কিভাবে বুঝাব পুরো পৃথিবীকে?আমরা ছিলাম পরিবার,এম এম সি ছিল আমাদের বসতবাড়ি।হঠাৎ মহাকাল নামের এক কালবৈশাখী এসে সেই ঘরকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়ে গেল।আমরা আর সেই ঘরে থাকতে পারব না,বাড়ির উঠানে দৃপ্ত পদচারণা করতে পারব না।এ কেমন নিয়তি?

আমরা কাঁদলাম সবাই।কেউ প্রকাশ্যে,কেউ মনে মনে।সেই অশ্রুর স্রোতে ভেসে গেল আমাদের ক্যাম্পাস,আমাদের হাসপাতাল।আমরা বর্তমান থেকে হয়ে গেলাম অতীত।অফিসের নথিপত্রে জমা হল আরো কিছু ফাইল,ধুলো পড়ার অপেক্ষায় থাকল তারা।আর আমরা গ্রহ ভেঙ্গে হয়ে গেলাম গ্রহাণু,গ্রহাণু থেকে উল্কা কিংবা ধুমকেতু।ছুটে গেলাম মহাকাশে,নিয়তিকে সাক্ষ্য রেখে।বলে গেলাম,"ভাল থাকিস তোরা,খুব ভালো।আমরা হয়তো আর মিলতে পারব না কোনদিন,তৈরি করতে পারব না নতুন গ্রহ।কিন্তু দূর থেকে যেন একে অন্যের আলোর বিচ্ছুরণ বলতে পারি,আমরা একসময় একই গ্রহের ধূলিকণা ছিলাম।বিদায় এম ফরটি টু।"

[লেখাটা লিখেছিলাম আমাদের ব্যাচের ফেইসবুক পেইজের নোটস হিসেবে।যাদের ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে,তারা জানে ক্যাম্পাস ছাড়ার বেদনা কত মর্মন্তুদ।তাই ব্লগের বন্ধুদের সাথে শেয়ার না করে পারলাম না।]
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১১:৫০
১৪টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×