আগের কাহিনীর পর.........।
এই যখন অবস্থা, তখন ত্রাণ কর্তার মত আগাইয়া আসছিল আমার নানা। আমি ছোটবেলায় তুলনামুলকভাবে অনেক বেশি সময় কাটাইছিলাম নানার বাড়িতে। বংশের বড় নাতি হওয়ায় আদর পুরাটাই পাইছিলাম। আর চুপচাপ ভদ্র স্বভাবের (হাবাগোবা টাইপ) হওয়ার সুবাদে আর পড়াশুনায় তুলনামূলকভাবে ভাল হওয়ায় আমাকে নিয়া নানার গর্বের অন্ত ছিল না। আমাকে অনেক ভালবাসত আমার নানা। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পাওয়ার জন্য আমার নানা আমাকে তাঁর বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে পাওয়া বাই-সাইকেলটা (প্রায় তেত্রিশ বছর বয়স্ক) দিয়া দিছিল। মনে হইতে পারে জিনিসটা পুরাতন কিন্তু, সাইকেলটার কন্ডিশন নতুনের মতই ছিল খালি রঙটা ছাড়া। ভয়াবহ রকমের রাগী হবার কারনে তাঁর সাইকেলে ভয়ে আর কেউ হাত লাগানোর সাহস পাইত না। এই নানাকে হারাইলাম মাস তিনেক আগে। এই ব্যাটাকে এত্ত ভালবাসতাম যে আম্রিকায় বইসা এঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে বাথরুমের শাওয়ার ছাইড়া পাঁচ বছর পর আমি বাচ্চা ছেলের মত কইরা কানছি।
যাই হোক এরপর ব্যাপারটা এমন দাড়াইছিল যে আমার আব্বাকে তাঁর কেনা জমি বেচে দিয়া টাকা যোগাড় করে আম্রিকা পাঠান লাগবে। আমরা মুটামুটি জানতাম তাঁর হাতে কিছু এক্সট্রা টাকা থাকে কিন্তু হাজার পঞ্চাশের বেশি আশা করি নাই।কিন্তু আমাদের এই দুর্দশা দেখে আমার নানা আর বইসা থাকতে পারে নাই। উনি বইসা বইসা দেখতেছিলেন যে কিভাবে আমাদের এক্সপেকটেশন গুলা ফেইল হইতেছে আর আমরা একটা সিচুয়েশনের মধ্যে পরছি। এই লোক আমাদেরকে বিপদ থেইকা উদ্ধার করার জন্য নিজের জমি বেচে দেড় লাখ টাকা দিয়া দিল। আমি উনাকে বলছিলাম আমার অন্য খালারা যদি কিছু বলে? আমার নানা আমাক বলছিল, কেউ কিছু উচ্চারণ করে দেখুক! আমি আমার জমি বেঁচে তোমাকে টাকা দিচ্ছি, আমার জমি আমি যা ইচ্ছা তাই করবো। আমার নানা তাঁর প্রিয় নাতিরে উদ্ধার করতে যেই লেভেলের ড্রাস্টিক মেযার নিছিল, তার প্রতিদান এই নাতি ইহজনমে দিতে পারবে না। এই লোকটা আমারে দুনিয়াতে ঋণী কইরা রাইখা গেল।
আমার আব্বা যখন এই টাকা হাতে পাইল তখন কিছুটা সাহস ফিরে পাইল কারন না হইলেআমাদেরই জমি বিক্রি করা লাগত। টাকা যোগাড় করতে যাইয়া এই লেভেলের নাজেহাল হইয়া আমার বাপের মন খুব খারাপ হইয়া গেছে। নিকট আত্মীয় থেকে শুরু কইরা বন্ধু বান্ধব সবাই হতাশ করছে দেখে আমার আব্বা সব্বাইরে হিসাবের খাতা থেইকা বাদ দিয়া দিল। এইবার আমাদের কিছু জমি বন্ধক (সুদ দেওয়া লাগে না, কমপক্ষে এক বছর পর টাকা ফেরত দিলেই জমি ফেরত) দিয়া, আর বাড়ির সব সম্বল মিলাইয়া প্লাস আমার নানার দেওয়া দেড় লাখ টাকা মিলাইয়া বাকি টাকা যোগাড় হইয়া গেল। এইবার ওদের কাছ থেকে পাসপোর্ট খানা লওনের পালা!
*** টাকা যোগাড় জনিত পুরা ব্যাপারটাই স্কিপ করতে পারতো আমার আব্বা। আমার আব্বাকে নাকি এক ভদ্রলোক অফার দিছিল যে আমি যদি ওই লোকের মেয়েরে বিয়া করি তাইলে ওরাই সব টাকা দিবে। আমার আব্বা বেশ কড়াভাবেই অফারটাকে প্রত্যাখ্যান করছিল। ওইদিন আমার আব্বা মেরুদণ্ড সোজা রাইখা ওই কামটা না করলে আজকে আমার ফ্রিডম বলে যেই জিনিসটা আছে সেইটা থাকত নাহ (মইড়া বাইচ্চা থাকতাম )।
ভ্যাজালটা হইল গিয়া জিনিসটা আছে ঢাকায়, আর ঢাকা হইল ওদের টার্ফ। টাকা দেওয়া লাগবে তো লাক তিনেক ! সেইফ কিছু একটা বাইর করা দরকার। ইশকুলের টিচার হবার সুবাদে আমার আব্বার বহুত ছাত্র বিভিন্ন প্লেসে ছড়াইয়া ছিটাইয়া আছে। এমন একজনকে পাওয়া গেল যে কিনা পুলিশ আর পোস্টিং ঢাকার সদরঘাটে। আমার আব্বা ওর সাথে আলাপ করল ব্যাপারটা নিয়ে। সেই ভদ্রলোক যাইতে বলল ঢাকায়। এরপর আমার আর আব্বার টাকা নিয়া ঢাকা যাত্রা! আমার আব্বা আমারে দিল দেড় লাখ টাকা আর নিজের কাছে রাখল দেড়লাখ টাকা জাস্ট ইন কেইস। তখন ডাকাইত পড়ত ঢাকাগামী কোচগুলাতে। আমার আব্বা টাকা নিয়া ভয়ানক চিন্তিত, পারলে বুকে আগলাইয়া রাখে আরকি। আর আমি চিন্তা করলাম মাল গুলাকে নিয়া বেশি চিন্তা না কইরা ডাফল ব্যাগের মদ্যে ঢুকাইয়া লকারে দিয়া দিলাম!!! পরদিন সকালে ঢাকায় নাইমা সদরঘাটে গেলাম ওই পুলিশ ভাইয়ের কাছে। উনি আমাদেরকে নিয়ে গেলেন উনার থাকার স্থানে। যাইয়া দেখলাম ওরা খুব সুখে নাই। ইউনিভার্সিটির হলের গন রুমে যেমন ছেলেপেলেরা গাদাগাদি কইরা থাকে তেমন করে ওরাও মেঝেতে গাদাগাদি করে থাকে।
যাহোক, একটু পর উনি উনার ইউনিফর্মটা চাপাইলেন। তারপর আমরা গেলাম ইস্টার্ন প্লাসে, ওদের অফিসে। সাত-আট তলায় ওদের অফিস ছিল। যেই মাত্র ওদের অফিসে ঢুকলাম ওরা তো পুরা আতঙ্কিত হইয়া গেল পুলিশ দেইখা! একটু পর যখন ওরা বুঝল যে ওদেরকে ধরতে যাওয়া হয় নাই, তখন ওরা একটু শান্ত হইল। এর পরে চা টা খাইয়া ওরা ভিসার প্যাকেট টা নিয়া আসল আমি চেক করলাম মালগুলা। তার পর আমার আব্বা ওদেরকে টাকাটা দিয়া দিল। ওই মুহূর্তে কি মনে কইরা আমি আমার আব্বার মুখের দিকে তাকাইলাম, দেখে মনে হইল আমার আব্বার বয়স হুট করেই যেন দশ বছর বাইড়া গেল। বুঝলাম টাকাটা হাতছাড়া হওয়াটাই এর মুল কারণ। হয়ত আমার আব্বা তখনো নিশ্চিত ছিল না যে আমি শেষ পর্যন্ত আম্রিকায় যাইতে পারবো কি না, নাকি সব ধোঁকা।
এরপর গেলাম টিকেট কাটতে। ওদেরই একজন এক ট্রাভেল এজেন্সির কাছে নিয়া গেল আমাদেরকে। ওইখানে টিকেট কাটলাম আটষট্টি হাজার টাকা দিয়া। তারপরে গেলাম আমার আব্বার আরেক ছাত্রের কাছে। ওই ভদ্রলোক নাকি মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকে এমডি পদে আছেন। উনি আমাদেরকে পাসপোর্টে ডলার এন্ডোরস করতে নিয়ে গেলেন পাশেই ডাচ-বাংলা ব্যাঙ্কের একটা শাখায়। ওখানে উনাকে বেশ সমীহের সাথেই দেখল ব্যাঙ্কের সবাই। বুঝলাম উনার পদটা বেশ ভারি! তারপর পাসপোর্টে ১১০০ ডলার এন্ডোরস করলাম।
কাহিনীর ধারাবাহিকতা রাখতে যাইয়া কাহিনীর মধ্যে তিনটা ইম্পরট্যান্ট ইভেন্ট মিসিং গেছে।
কাহিনী এক
যখন সবকিছু ঠিকঠাক হইয়া গেল তখন আমারে আর কে পায়। বেশ চামের উপ্রে আছি, ক্যাম্পাসে আছি, ক্লাসে যাইতেছি না মাগার গায়ে হাওয়া লাগাই বেড়াইতেছি। কি মজা! কিছুদিন থাইকা সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে। আস্তে আস্তে কইরা বিদায় নেওয়া শুরু করলাম সবার কাছ থেকে। হলে ছিলাম সবাই ভাইয়ের মত। বড় ভাইরা আমাদের ছোটভাইদেরকে অনেক স্নেহ করত আর আমরা ছোটরাও ব্যাপক রেস্পেক্ট করতাম বড়দের। মারামারি কাটাকাটি ছিল না আমাদের মধ্যে। পলিটিক্সও তেমন খুব একটা ছিল না আমাদের ফ্যাকাল্টিতে।
কিন্তু এক বড় ভাই আগের ছাত্রলীগ নেতাদেরকে ট্রাম্প কইরা ক্যাম্পাসের মাথা হইয়া গেলেন কিছুদিন আগে। ওনার ডাঙ্গাত বামহাতেরা আবার আমাদের এলাকার। খালি মিছিলে যাবার জন্য ডাক দিত আর কিচ্ছু না। বেশ নিরাপদেই ছিলাম। যাইহোক হল ছাড়মু এপ্রিলের ১৪ তারিখে, ঠিক পহেলা বৈশাখের দিনে। আগের দিনে আমাদের ব্যাচের ফ্রেন্ডদের নিয়া হাল্কা একটা মিলাদ দিলাম, আমাদেরই কয়েকজন আবার ডেডিকেটেড তাবলীগ হইয়া গেছিল, তারাই দুয়া পরিচালনা করল। সবকিছুই নাইস্লি শেষ হইল। আড্ডা হইল প্রচুর!
মিলাদের কয়েকদিন আগে, রাতে নিচে পেপার দেকতে যাওয়ার সময় নেতা ভাইয়ের এক চেলার সাথে সিঁড়িতে দেখা। উনি বললেন, কিরে শুনলাম তুই নাকি আম্রিকা যাইতেছিস, বড়ভাইদেরকে কিছু মিষ্টি টিস্টি খাওয়াবি না? আমি মনে করলাম উনি জোক করতেছেন, ওই সময় সবাই মিষ্টি খাইতে চাইতেছিল সো ব্যাপারটারে তেমন গুরুত্ব দিই নাই। কইলাম খাওয়ামু ভাই। দিয়া চুপচাপ। কারন হলের সবাইরে মিষ্টি খাওয়ান আমার পক্ষে সম্ভব না।
মিলাদের দিন রাতে আবার উনার সাথে রাতে সিঁড়িতে দেখা, এইবার উনি আমারে শাসাইতে লাগলেন, কিরে তরে না কইছি বড় ভাইরে মিষ্টি খাইবো, টাকা দিতে? দ্যাস নাই কেন? রুমে আইবি, আইসা পচিশ হাজার টাকা দিয়া যাবি। এইবার উনার টোন শুইনা আমি ভড়কাইয়া গেলাম। উনি দেখি সিরিয়াস। টাকা দেওয়াই লাগবো নাকি? ক্যাম্পাসে তখন উনারাই বাপ-মা বনে গেছেন। উনারা যা বলেন তাই আইন। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম অক্কে ভাই আইতেছি। এরপরে ঘটনাটা আমার ফ্রেন্ডরে জানাইলাম, হ্যারাও চিন্তিত হইয়া পরল। আমরা ফার্স্ট ব্যাচ হওয়াতে কারো পাওয়ার সেই লেভেলে পৌছায় নাই। সো উনার রুমে না যাইয়া চুপ থাকার সিদ্ধান্ত লইলাম (পরদিন ক্যাম্পাস থেইকা ভাগতেছি)।
পরদিন, পহেলা বৈশাখ! পুরা ক্যাম্পাসে উৎসবের আমেজ। বিশাল পদযাত্রা হইল, ছেলেপেলেরা আলপনা আঁকতাছে। আমার এক ফ্রেন্ড সদ্য ভর্তি হওয়া জুনিয়র মাইয়ারে দিয়া আমার গালে পহেলা বৈশাখ লিখাইয়া দিল! সেইরাম ফিলিং...। মজাও করলাম অনেক। ফ্রেন্ডদের কাছ থেইকা ফাইনাল বিদায়টাও নিয়া নিচ্ছিলাম। এরমধ্যে ওইখানে আবার ওই ভাইয়ের দেখা, উনি বলেন কিরে তরে না রুমে আস্তে বলছিলাম, আসিস নাই ক্যান, রুমে আসবি। ওইখানে লোকজন থাকায় উনি কিচ্ছু বলতে পারেন নাই। ভয় পাইলাম আবারো। কিন্তু উনার দৌড় এইখান থেইকাই মুটামুটি শেষ। কিছুক্ষনের মধ্যেই সবাইরে বাই দিয়া বাসে উইঠা এই বান্দা পগারপার। উনার জন্য নিজের আপন একটা ক্যাম্পাস থেকে আমারে চোরের মত কইরা পালাইতে হইছিল।
আম্রিকা আইসা কিছুদিন পড় শুনলাম, সেই বড় ভাই কিছুদিন পরেই টাকার কোন্দলে পইড়া মাইর খাইয়া দুনিয়াছাড়া হইয়া গেছেন। উনাকে দিয়াই আমাদের ক্যাম্পাসের খুনখারাবি শুরু হইছে। যদিও মানুষ মারা যাওয়ার মধ্যে আনন্দের কিছু নাই, কিন্তু যেইদিন আমি শুনলাম উনারে কুপাইয়া মাইরা ফালানো হইছে ওইদিন আমি নিজের মধ্যে একটা চাপা উল্লাস ফীল করছি।
(চলতে থাকপে......।)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:৩৩