somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতি সিদ্ধার্থ

০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কী নামে তোমায় ডাকব তা এখনও ভেবে দেখিনি। যে নামে তোমায় সবাই ডাকে তা অনেক সুন্দর হলেও ঐ নামে তোমাকে সম্বোধন করতে ইচ্ছে করে না, মনে হয় অন্য কোন নামে ডাকি। তাই কোনরুপ সম্বোধন ছাড়াই লিখা শুরু।

আজ আমি তোমাকে যেখান থেকে লিখছি তা তোমার থেকে মাইল হিসেবে অনেক দূরে। এত দূরত্ব স্বত্বেও মনে হচ্ছে লিখা শেষে যে কগজটা চিঠি হয়ে যাবে তা ছোট্ট একটা কাগুজে জাহাজ বানিয়ে হাওয়ায় ভাসালেই তা এ বারান্দা ও বারান্দা করে তোমার বারাব্দায় যেয়ে পড়বে। তুমি বারান্দা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এক পলকে চিঠিটা পড়ে নিবে। কিন্তু দুরত্ব যেহেতু মাইল হিসেবে, তুমি বরং তোমার ডাকপিয়নকে বলে রেখ, সে যেন প্রত্যেক মাসে তোমাকে একটা করে চিঠি পৌঁছে দেয়।

এই কদিন আগেও ভাবিনি যে তোমার আমার জানাশোনা হবে, ভাব বদল হবে বা তোমাকে এভাবে চিঠি লিখব। এইতো সেদিন, তুমি যদি না আমাকে তোমার বাসায় ডেকে নিয়ে না যেতে, সামান্য একটা কাজের ছলে আমাকে এক কাপ চা না খাওয়াতে বা সাহস করে না বলতে 'আরেকদিন আসবেন কিন্তু' তাহলে তুমি আমি তেমনটিই থাকতাম যেমনটি ছিলাম প্রতিবেশী হিসেবে এতগুলো বছর। এমন করে আমি আগে কখনও ভাবিনি জান? পারিবারিক কলহ, মিছে আশা, দুঃস্বপ্ন, নিত্য প্রতিযোগিতা, শহরের দাঙ্গা হাঙ্গামা, ঝঞ্ঝাট, জঞ্জাল, বেকারত্বের অভিশাপ, মানুষের কপটতা, টাকা কড়ি শুন্য পকেট আর ক্ষুধার্ত জীবন সবকিছুর সাথেও কেউ একজন থাকতে হয় যার সাথে দুঃখ কষ্ট ভাগাভাগি করা যায়, মন খুলে দুটো কথা বলা যায়। তুমি এলে, অনেক দিনের চেনা তোমাকে নতুন করে চিনলাম। কিন্তু বেশি করে কথা বলার সুযোগ আমাদের হলনা। নতুন চাকরি সুবাদে কলকাতা শহর ছেড়ে চলে এলাম এই মফস্বলে, তোমাকে, তোমাদের সবাইকে ছেড়ে।


বলেছিলাম পৌঁছেই একটা চিঠি লিখব। এখানে আপাতত একটা হোটেলে ঊঠেছি, অবশ্য হোটেল বলতে তুমি যা বুঝ তার কিছুই এটিতে নেই। মফস্বল এই এলাকা সম্পর্কে আমি যা ভেবেছিলাম এটি তাই। জনমানুষের কমতি না থাকলেও এখানে এদের কোন তাড়া নেই। কলকাতা শহরকে যদি আধুনিক শহর বলি তাহলে আমি আমাদের ঐ পুরাতন ভাঙ্গা ভাড়া বাড়িটিতে এইসব আধুনিকতার বাইরেই ছিলাম এতদিন। তাই এই মফস্বলের পশ্চাদপদ জননিবাসে আমার তেমন কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। শুধু ঐ বন্ধুবান্ধবদের মিস করা হবে আর কি। তবে এখানে আসার পর এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে যা আমি তোমাকে এই চিঠির শেষে গিয়ে বলব।

এখানে যে চাকরিটা আমি করব তা হল একজন মেডিক্যাল সেলসম্যনের কাজ। এই এলাকাকে কেন্দ্র করে আশেপাশের ৪০ মাইল এলাকার ডিসপেন্সারিগুলোতে ঔষধ সাপ্লাই দিতে হবে। মাসিক বেতন ১২০০ টাকা, এছাড়া কমিশন রয়েছে। আমার চলে যাবে কিন্তু আমি ভাবছি পরিবারের বাকিদের কথা। বাবার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হব। সেই স্বপ্নের সুবাদে মেডিক্যালে ভর্তি হলাম। দু'বছর পর বাবা মারা গেলেন। পড়াশুনা ওখানেই ছেড়ে দিতে হল। তারপর দু'বছর ধরে আমি বেকার। পথে পথে হন্যে হয়ে ফিরেছি একটি চাকরির জন্য। পাইনি। শেষবার যখন ইন্টার্ভিউ দিলাম, তুমি বলেছিলে চাকরিটা হবে। কিন্তু হলনা। কি করে হবে? ইন্টার্ভিউতে আমাকে জিজ্ঞেস করা হল- What is the most significant event of the last decade? আমি উত্তর দিলাম- The war of Vietnam. প্রশ্নকর্তা বলল- Do you think the war of Vietnam is more significant than the Moon landing? আমি বললাম- Actually sir, Moon landing is scientifically significant but The War of Vietnam is significant for human life, it ends thousands of killing & murders through an illegal war imposed by the American. আমার উত্তর শুনে প্রশ্নকর্তা বলল- are you a communist? আর তখনই বুঝলাম যে আমার এ চাকরিটাও হবে না। তারপর সেখান থেকে সোজা প্রকাশ বাবুর অফিসে চলে গেলাম। উনি আমার এক বন্ধুর দাদা হন। আমার পারিবারিক অবস্থা বিবেচনা করে তিনি আমার জন্য এই চাকরিটার অফার দিয়ে রেখেছিলেন। এতদিন আমি তার কাছে যাইনি। ভেবেছিলাম নিজ যোগ্যতায় একটা চাকরি কি আমি পাব না। কিন্তু দেখলেতো পেলাম না। শেষ পর্যন্ত এই চাকরিটার ভরসা করে কলকাতার বাইরে চলে এলাম।

কলকাতার বাইরে চলে আসতে কিছুতেই মন চাইছিল না। কিন্তু কিছু আর করার নেই। এই চাকরিটা না নিলে আমাদের আর চলার কোন উপায় থাকতো না। প্রতিবেশী হিসেবে আমাদেরকে তুমি সামান্যটুকুই জান। বাবা একটা সরকারী অফিসের কেরানি হিসেবে কাজ করছিলেন। তার অল্প আয়ে আমাদের খুব ভালভাবে না হলেও চলে যাচ্ছিল কোনরকমে। এর মধ্যে আমি আর আমার দু'বছরের ছোট এক বোন পড়াশোনা করছিলাম, সেসব খরচের ব্যাপারও ছিল। বাবা অসময়ে মারা গেলেন আর আমাদেরও দুঃসময়ের শুরু। মেডিক্যালে পড়া আর হলনা। ভাবলাম যাই কিছু হোক, একটা কিছু করে সংসার চালাব। মা বড় অসহায় হয়ে পড়লেন, বাবার পেনশনের সামান্য টাকা দিয়ে কিছুদিন চললো আমাদের। আমি কিছুতেই একটা চাকরি জোগাড় করতে পারছিলাম। এর মধ্যে আমার ছোট বোন পারু, মেট্রিক পাশ সার্টিফিকেট দিয়ে ওর একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে টাইপিস্ট এর চাকরি হয়ে গেল। ওর চাকরিতে আমাদের কিছুটা স্বস্তি এলেও এখন ওর চাকরিটাই আমার আর মার সবচেয়ে অস্বস্তির কারণ। শুরুতে ও ভালই করছিল। ওর উপর ওর অফিসের বসের নজর পড়ে। তারপর সে টাইপিস্ট থেকে এখন বসের অ্যাসিস্ট্যন্ট। নিয়মিত অভার টাইম করতে হয়। অনেক রাত্রি অবধি অফিসে না হয় কোন পার্টিতেই তার কাজের গুরুত্বই বেশি। আমি ওর দাদা, সে আমায় দাদা বলে ডাকে। আমি কতবার ওকে বারণ করেছি, বলেছি চাকরিটা ছেড়ে দিতে। সে বলে 'এখন আর চাকরি ছেড়ে কী হবে দাদা, আমিতো আর তোর ছোট্ট নই, আমি এখন একটা অফিসের অ্যাসিস্ট্যন্ট সেক্রেটারি'। আমি মুখ বুজে সহ্য করি। এতদিন কাউকে কিছু বলিনি। ভাবলাম তোমাকে বললে হয়ত কিছুটা হালকা হতে পারব। কিন্তু পারছি না।


আমি অনেক কষ্ট পাই। অবশ্য তোমার কষ্টের কাছে আমার কষ্ট কিছুই না। আগে ভাবতাম তোমাদের মত বড়লোকদের বুঝি কোন কষ্ট নেই। এই তোমাকে দেখেই জানলাম, মনের কষ্ট বড়লোক ছোটলোক মানে না। যা হোক, আর কিছু লিখতে পারছি না। একটা ঘটনার কথা বলব বলে শুরুতে বলেছিলাম। এটা বলেই শেষ করব...

কলকাতায় আসার আগে আমরা একটা গাঁয়ে থাকতাম। সেখানে আমি আর আমার বোন পারু একটা পাঠশালায় পড়তাম। প্রতিদিন একসাথে পাঠশালায় যাওয়ার সময় আমরা একটা পাখির ডাক শুনতে পেতাম। এত সুন্দর ছিল সেই পাখির ডাক। ঘন গাছগাছালির মধ্যে থেকে সে পাখিটিকে কখনও দেখা যেত না। যেদিন পাখিটির ডাক শুনতাম সেদিনটি আমদের খুব ভাল যেত। যেদিন শুনতে পেতাম না সেদিন আমাদের দু'জনেরই খুব খারাপ লাগতো। কলকাতায় চলে যাবার পর সেই পাখিটিকে আর কখনও পাইনি। আমি যখন পারুওকে বলতাম তার চাকরিটা ছেড়ে দিতে, সে বলত-'দাদা, আমাকে সেই পাখিটা এনে দিতে পারবি? সেই পাখিটা পেলে আমি চাকরি ছেড়ে দিব।' তারপর কত খুঁজেছি ঐ পাখিটাকে। নাম জানিনা শুধু এর শিষটা মনে আছে। আমি সারা কলকাতার কোথাও পাইনি। কিন্তু গতকাল যখন এখানে পৌছুলাম, এই হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিলাম, তখনই হঠাৎ সেই পাখিটার ডাক শুনতে পেলাম। আমি যে কি আনন্দ পেয়েছি তা তোমাকে বুঝাতে পারব না। এই ডাক শুনার জন্যে আমি এতটা দিন অধির অপেক্ষায় ছিলাম। এখন আমি পারুকে বলব- 'পারু, এই নে তোর পাখি', আমরা আবার সে পাখির ডাক শুনব। তুমি বলে দাও আমাদের দিন কী ভাল যাবে না?

ইতি
সিদ্ধার্থ
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:০২
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেসবুক বিপ্লবে সেভেন সিস্টার্স দখল—গুগল ম্যাপ আপডেট বাকি

লিখেছেন মহিউদ্দিন হায়দার, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩০




কিছু তথাকথিত “বাংলাদেশি বিপ্লবী” নাকি ঘোষণা দিয়েছে—ভারতের সেভেন সিস্টার্স বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে! সহযোগী হিসেবে থাকবে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী আর পাকিস্তানি স্বপ্ন।শুনে মনে হয়—ট্যাংক আসবে ইনবক্সে। ড্রোন নামবে লাইভ কমেন্টে। আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২৬

বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের দম আছে বলতে হয়! নির্বাচন ঠেকানোর প্রকল্পের গতি কিছুটা পিছিয়ে পড়তেই নতুন টার্গেট শনাক্ত করতে দেরি করেনি তারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ঘিরে নতুন কর্মসূচি সাজাতে শুরু করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×