নিজের নিয়ম মেনে দেরি করে ঘুম থেকে উঠলাম তাও সেটা গাইডের চেঁচানিতে । আরেক পশলা উৎসবে তখন লেকপাড়া সরগরম । মনে হল সূর্যটা খুব ভয়ে ভয়ে পাহাড়ের চূড়া থেকে উঁকি দিতে চেয়ে খুব জোর ধমক খেয়েছে সেই নাম না জানা পাহাড়ের কাছে তাই এখন বাধ্য ছেলের মত জবুথবু বসে আছে । আমরা এই পাহাড়ের পাশের পাহাড়টাই উঠলেই হয়ত সূর্যটাকে ছোঁয়া যাবে ! নাশতা সেরে এবার আমরা কেওক্রাডং এর জন্য পা ফেললাম । এই লেক পাড়ার খাবারের প্রতি আমাদের সকলের কেমন জানি একটা আসক্তি এসে যাচ্ছিল । যাই হোক, আমাদের গন্তব্য ছিল কেওক্রাডং থেকে জাদিপাই ঝর্নায় গোসল সেরে আবার কেওক্রাডং এ ফিরে লাঞ্চ করে কটেজে ফিরব । সব মিলে ১২ ঘণ্টা হাঁটার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে নিলাম আমরা । হাঁটার ব্যাপারে আমি খুব পজিটিভ । বনানী থেকে মিরপুর ১০ পর্যন্ত হাঁটাটা আমার কাছে এমন কিছুই নয় কিন্তু অনভ্যস্ত পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে টের পেলাম এটা সেই বনানী-মিরপুর রুটের হাঁটা নয় । একপাশে পাহাড় আরেকপাশে খাদ সঙ্গে একটা কচি বাঁশ, এটা এই হাঁটা । কিন্তু আমার রক্তে রক্তে যে রোমাঞ্চের অনু পরমানু বয়ে যাচ্ছিল তার কাছে কোন ভয়, বাধা কিছুই ঠিক সুবিধে করতে পারছিল না । বড় বড় পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে বারবার নিজেদের কত অসহায় আর ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল । এখানের সবকিছুতেই কেমন জানি একটা বিশুদ্ধতা, পবিত্রতা মিশে আছে । আকাশের এমন কটকটে নীল রঙ আমি আর কোথাও দেখিনি, মাইলের পর মাইল সবুজ দেখতে দেখতে চশমাটা খুলে ব্যাগে রেখে দিলাম । ধুলোতে এলারজি, ব্যাক পেইন, ঠাণ্ডার এলারজি হেন তেন সব প্রব্লেম পায়ে মাড়িয়ে আমাকে সারাবছর বাঁচতে হয় । অথচ এখানে আসার সময় চাঁদের গাড়ির ৪৫-৬০ ডিগ্রী এঙ্গেলের আছাড়েও আমার কিছু হয়নি । কেজি কেজি লালচে ধুলো প্রতিমুহূর্ত নাক গলিয়ে মুখে ঢুকছিল অথচ একটা হাঁচিও আসেনি আমার । এটা হবে হয়ত আমার মনের উপর আমার বশীকরণ অথবা সব যুক্তির শেষ যেখানটায় ! এত মুগ্ধতা, এমন ফ্রেশনেস, কটকটে নীল, এত বিশালতা, সবুজের শামিয়ানা । মনটা বারবার আমাকে থামিয়ে দিয়ে মুগ্ধ হতে বলছিল কিন্তু দলের সবাই আর গাইডের অত্যাচারে এমন মন্ত্রমুগ্ধের মত আমার পাহাড় দর্শন ঠিকঠাক হলনা । তবু হঠাৎ থেমে কানে হাত দিয়ে জোরে একটা চিৎকার দিলাম । পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে আমার চিৎকার তখন আমার কানে, সামনে থেকে কয়েকজনের কড়া ধমকে আবার হাঁটতে শুরু করলাম । চারপাশে এত ছবি ছবি আর ছবি যে আমার নিজেকে নায়িকা মনে হল । দারজিলিং পাড়া নামটা শুনেই কেমন একটা উঁচুনিচু রাস্তা আর পাহাড়ি বাতাসের ছোঁয়া লাগছিল আমার ভেতরে বাহিরে । সমরেশ মজুমদারের প্রত্যেকটা চরিত্র কেমন জীবন্ত হয়ে আমার চারপাশে হইচই করছিল ! কেওক্রাডং এ উঠে ৩০ টা সেকেন্ড নিখাদ আমার নিজের জন্য, এটা নীরবতা, মুগ্ধতা, ক্ষুদ্রতা, দর্শন আর হারিয়ে যাওয়া নিজের ভেতরে । অনুভূতি গুলো এত ছাপোষা যে অন্য কেউ এটা উপলব্ধি করতে পারবেনা, তাই হয়ত বোঝাতে পারছিনা ।
এবার ঝর্না স্নান.।.।.। (পরবর্তী এবং শেষ পর্ব) [এবার আর দীর্ঘবিরতি না দেয়ার প্রতিজ্ঞা করলাম)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩১