পড়াশুনা শেষের দিকে ভাবলাম বিদেশ বিভূঁইয়ে জীবনের ইতি টানার সময় হয়েছে । পড়াশুনার শেষে বেকার থেকে দেশ ও জাতির গাঁড়ে বোঝা হিসেবে থাকতে আমি নারাজ । তাই মাস্টার্সের শেষ সেমিস্টারের আগেই পিএইচডিতে ভর্তি হলাম কানাডাতে । পি,এইচ,ডি করার খুব যে ইচ্ছে তা নয় যাতে বেকার না থাকতে হয় তার জন্যই মূলত এই পন্থা অবলম্বন করলাম ! মাঝখানে স্যামসাং একটা চাকরির ইন্টার্ভিউ দিলাম, যদি লাইগা যায় ! মাস দুয়েক পর রেজাল্ট দিল চাকরিটা হয়ে গেছে বাংলাদেশ ব্যাঞ্চে জয়েন করতে হবে সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেব। আমি দোটানায় পড়ে গেলাম পিএইচডি করব নাকি চাকরিতে জয়েন করব এই নিয়ে !
বুদ্ধির গোরায় পানি ঢালতে বাসায় ফোন দিলাম সৎপরামর্শের জন্য । বাসা থেকে কড়া ভাষায় হুশিয়ারি উচ্চারণ করে জানিয়ে দেয়া হল কাভি নেহি, দেশে আসার দরকার নেই, বাহিরেই থাক! তবে আমি দমে যাবার পাত্র নই দ্বিগুণ উৎসাহে বন্ধু-মহলে ফোন দিলাম, সবার একই কথা এই ভুলটি জীবনেও নাকি করা যাবে না! দেশ বসবাসের জন্য উপযোগী নহে । আমি হতাশ হবার পাত্র নই , সবার বারণ অমান্য করে মনে মনে ভাবলাম দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করা দরকার। অবশেষে পিএইচডি করার চিন্তা বাদ দিয়ে ব্যাক টু দি প্যাভিলিয়ন মানে দেশে প্রত্যাবর্তন করলাম।
আন্ডার গ্রাজুয়েট এবং মাস্টার্স শেষ করে ফিরেছি দেশে, সময়টা খুব কম নয়, সবকিছুই যেন পরিবর্তন হয়ে গেছে। দেশে যেই বাতিজা এবং ছোট ভাই-ব্রাদার রেখে গেছিলাম তারা এই ক-বছরে বেশ ডাঙর-ডুঙুর হয়ে গেছে। দেশে ফিরে এসেছি বাসার লোক জন কোনমতে মেনে নিলেও পাড়া প্রতিবেশী এবং আত্মীয়স্বজন যেন কিছুতেই মানতে পারল না ! সবার এক প্রশ্ন দেশে কেন আসলাম ! আমি অবাক হলাম, দেশে ফিরলাম আমি অথচ সবার এত মাথা ব্যথা কেন !
এক আত্মীয় বাসায় আসলেন আমাকে দেখতে ! এসেই বললেন একে বারেই চলে এসেছ আমি মাথা নেড়ে বললাম আজ্ঞে হ্যাঁ ! দেশে চাকরিতে নাকি জয়েন করেছ ? আমি মাথা নেরে সম্মতি জানালাম । বেতন কত ? বেতন এর কথা বলতে আমার অস্বস্তি লাগে, তবে ভদ্রমহিলা নাছোড় বান্ধা । না শুনে ছাড়বে না ! আমি বললাম । ভদ্র মহিলা বেতন শুনে মনে হল আহত হলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ১ লাখও না! তোমাকে দিয়ে এটা আশা করি নাই ! তোমার মত ব্রিলিয়েন্ট পুলা এই বেতন নিয়া দেশে আসছ । আমি প্রথম বুঝতে শিখলাম যেই দিনার বেতন পাই তা আর দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করা যাবে না !
রাস্তা ঘাটে পাড়া প্রতিবেশী যেই দেখে সবার প্রথমে একই প্রশ্ন দেশে আসলা কেন ? বেতন কত ? আমি মনে মনে বলি ইয়া খুদা তুমি দড়ি ফালাও আমি উইঠা যাই ! একবার এক ভদ্র লোকের সাথে রাস্তায় মোলাকাত। আমি বড়সড় একটা সালাম দিয়ে মোলায়েম ভাষায় বললাম শরীরটা ভাল চাচা ? চাচা আমার কথার উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করলেন না । আমাকে হুশিয়ারি ভাষায় জানিয়ে দিলেন দেশে ফিরে আমি কতটা আহাম্মকের কর্ম সম্পাদন করেছি । আমাকে ঝাঁঝালো ভাষায় বলল এই দেশে কি মানুষ থাকে ? মানুষ লক্ষ লক্ষ দিনার খরচ করে দেশ ছারে আর তুমি লাফাতে লাফাতে দেশে চলে এসেছ !
ভাবলাম বন্ধু মহলে একটু ঢু মারা যাক । বন্ধু সম্প্রদায়ের সাথে দেদারসে আড্ডা না দিলে এক সময় পেটের ভাত হজম হত না !সকাল বেলা ক্রিকেট নিয়ে বের হতাম সেই সন্ধ্যা নাগাদ বাসায় ফিরতাম । বন্ধু সম্প্রদায়ের সাথে অনেক দিন পর দেখা হবে ভেবে পুলকিত হলাম। আড্ডায় মেট্রিক-ইন্টারে দুই তিন বার ডিগবাজি দেয়া বন্ধু থেকে শুরু করে দেশে পড়াশুনা শেষ করা বন্ধুবান্ধব সবাই গম্ভীরভাবে বুঝিলে দিল আমি কতটা মূর্খ! বন্ধুবান্ধবের বক্তব্য শুনে আর স্থির থাকতে পারলাম না, মনে হল রেইসলার দ্যা রক এবং আন্ডার টাইগারের আত্মা ভর করেছে আমার উপর ! মনে হল ধুমধাড়াক্কা দুই চারটা উত্তম-মধ্যম দিয়ে দেই, অবশেষে নিজের রাগ সংযত করলাম।
আমি হতাশ হয়ে আড্ডা-স্থান ত্যাগ করলাম। পথের মধ্যে দেখা হল এলাকার এক সময়ের কুখ্যাত এক হেভি-ওয়েট হিরোঞ্চির সাথে। অসহায় মানুষের শত্রু,গরীব দুখীদের ত্রাস এবং উঠতি চাঁদাবাজ ,ইভটেজারদের নয়নের মনি এবং আদর্শ হিসেবে এলাকায় তার কু-পরিচিতি ছিল একসময়ে। বাসার বদনা বা লোটা যাই চুরি হোক না কেন সবার প্রথমেই সন্দেহের তালিকাতে থাকতেন তিনি। কপাল দোষে অত্যন্ত পরিশ্রম করে চুরিচামারি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন বর্তমানে তবে নেশা-পানি করাটা এখনও অত্যন্ত সফলতার সাথে চালিয়ে যাচ্ছেন। তার সমসাময়িক অনেক হিরোঞ্চি এবং গাঞ্জট্টি ইতিমধ্যেই অল্প বয়সে পটল তুলে ফেলেছেন। তার চেহারা মোবারকে আগের সেই লাবণ্য এবং জৌলুস নেই, ভেঙ্গে গেছে। আমাকে দেখে তার চিনতে খুব বেশী অসুবিধে হল না, ওখানেই বিয়ে সাদি করে থাকার সুযোগ ছিল না মোলায়েম সুরে বললেন! আমি উত্তর না দিয়ে রাস্তা মাপলাম নিজের।
অবশেষে আমি উপলব্ধি করলাম জাতি হিসেবে আমরা যে অন্যের ব্যাপারে শুধু নিজের মাথা ঘামাই তা নয় বরং পুরো শরীরটাই ঘামাই। দেশের ফেরার প্রথম দিককার কাহিনী এগুলো । তবে পরবর্তীতে এই সমস্যাগুলো আর সম্মুখীন হতে হয় নাই। সবাই যে নিরাস করত তা নয় অনেকেই অনেক উৎসাহ উদ্দীপনাও দিয়েছে। আমাদের দেশের মানুষগুলোর মধ্যে একটা ধারনা দেশের বাইরে মনে হয় অনেক সুখ শান্তি আর কারি কারি দিনার পরে আছে সেখানে। দেশের দিনমজুর এবং গরিব মানুষগুলো এখনও অনেক পরিশ্রমী তবে অনেক দূর যেতে হবে আমাদের।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৭ দুপুর ২:১৮