তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি। মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়েদের স্বপ্ন থাকে তাদের সন্তানেরা বড় হয়ে ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হবে। সন্তানদের ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চাওয়ার শক্তিশালী একটি লজিক আছে, তাদের ধারণা ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়াররা মালপানি বেশী কামায়।উপরওয়ালা যদি সব বাবা মায়ের এই স্বপ্ন পূরণ করত, তাহলে বাংলাদেশের প্রতিটা পরিবারেই কমপক্ষে একজন করে ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ারা থাকতো। যাইহোক এই লোভেই কিনা জানিনা আমার বাসা থেকে কড়া ভাষায় জানিয়ে দেয়া হল আমাকে বিজ্ঞান নিতে হবে, এবং ভবিষতে একজন ডাক্তার হতে হবে।
আমিসহ আমাদের ক্লাসের অনেকেই বিজ্ঞান নিলাম। ক্লাসে আমরা বিজ্ঞান-ওয়ালারা তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। কয়েকদিন পর অবস্থার বেগতিক দেখে আমাদের এক স্যার ক্লাসে এসে বিরাট এক বয়ান দিলেন। টেবিলে ডাস্টার রেখে ভরাট কণ্ঠে বললেন বাবারা তোমরা বিজ্ঞান নিও না। স্যারের বানী শুনে পুরো ক্লাস চুপ, শুনশান নীরবতা। তারপর ধরা গলায় বললেন বিজ্ঞান পড়া অত্যন্ত কঠিন কর্ম। আবেগে স্যারের গলা কাঁপছিল। যারা যারা বিজ্ঞান নিয়েছি, আমাদের সবার বিষয়ে স্যার ভবিষ্যৎ বানি নিক্ষেপ করলেন, আমাদের কারো পড়তে পড়তে প্যান্টের হুক নাকি থাকবে না, কেউ পড়ার চাপে বেহুশ হয়ে যাব, আবার কেউবা কিছুদিন পরে বলব ছেড়ে দাও বিজ্ঞান বাবাজি কেধে বাঁচি। আমার সম্পর্কে স্যার অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন আমি কয় দিন পর স্কুলে আসার পথে রাস্তায় মাথা ঘুরে পরে যাব।
স্যারের কথায় যথেষ্ট পরিমাণ পুষ্টি ছিল, পরের দিন ক্লাসে গিয়ে দেখি আমরা বিজ্ঞান-ওয়ালারা ছিলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ আর হয়ে গেলাম সংখ্যালঘু। আমার উপর স্যারের কথার আছর পরেনি কারণ একটা কথা আছে পরাজয়ে ডরে না বীর, আমি নিজেকে বীরই ভাবি!! তবে স্যারের ভবিষ্যৎ বানী মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে আমি কখনও মাথা ঘুরে রাস্তায় পরে যাইনি। স্যারের বিজ্ঞান নিতে নিরুৎসাহিত করার করার শানেনযুল ছিল তার কোচিং বাণিজ্য। স্যার ছিলেন হিসাব বিজ্ঞানের মস্তান লোক, কমার্সের পোলাপান কম হলে তার কোচিং-মোচিং করিয়ে দিরহাম ইনকাম বন্ধ হয়ে যেত।
আমার ডাক্তারি পড়া হয়নি, এর প্রধান কারণ ডাক্তারির উপর আমার কোন খাস নজর ছিল না। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি। যাইহোক, যেটা বলতে চেয়েছিলাম, উপরের ঘটনাটায় আমাদের দেশের শিক্ষকদের একটি অনৈতিক চিত্র ফুটে উঠেছে। তবে আমাদের দেশে যে নীতিবান শিক্ষক নেই তা নয়, আমি জীবনে এমন কিছু জানু শিক্ষকের নেক নজর পেয়েছি যাদের কথা মনে হলেও শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়, যাদের বিভিন্ন সু-পরামর্শই ছিল এক সময় আমার প্রধান খাদ্য।
এবার মূল কথায় আসা যাক, একটি জাতী গঠনে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের গুরুত্ব থাকে, তবে বিজ্ঞান ভিত্তিক সমাজ গঠন করতে হলে সেখানে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করার মানুষ দরকার, যাদের দায়িত্ব হবে দেশে গবেষণা করা, জন কল্যাণমুখী প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা এবং জাতীর সংকট মোকাবেলায় নিজস্ব বুদ্ধি খরচ করে জাতিকে পথ প্রদর্শন করা। অর্থাৎ পেটের ভিতর বিজ্ঞানের এলেম থাকতে হবে। আর এই রকম বিজ্ঞানের খাটি আলেম তৈরি করার জন্য দরকার স্কুল থেকেই ছেলে মেয়েদের বিজ্ঞানে আকৃষ্ট করা। তবে আফসোসের বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশে বিজ্ঞানে ছেলে মেয়েদের আগ্রহ কম এবং স্কুলগুলোতে বিজ্ঞানের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য ভাল কোন ল্যাবরেটরি নাই। তার উপর বিজ্ঞানের শিক্ষকের স্বল্পতা, এবং শিক্ষকদের মাঝে উচ্চমর্গীয় রাজনিতির জন্য কচি কচি ছেলে মেয়েরা বিজ্ঞানে পড়ার প্রতি ভিতি এবং অনীহা অনুভব করে। আমি অনেক স্কুলে দেখেছি বিজ্ঞানের শিক্ষকের অভাবে, আর্টস এবং কমার্সের শিক্ষকেরা সেখানে বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের তালিম দেন। তাই এই ধরণের ঠেকায় পরে হওয়া বিজ্ঞানের শিক্ষকদের এলেম নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার যথেষ্ট কারণ আছে। এই ধরণের ব্যাপারগুলো বরদাশত করে জাতিকে খাদে ফেলে দেয়া হচ্ছে।
যে কোন দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার আঁতুড়ঘর হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে পশ্চিমের দেশগুলোতে বিভিন্ন সংকট মোকাবেলায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কাজ করে যায়, যেমন করোনা নিয়ে অনেক বিদ্যালয়গুলো নিরলস-ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের দেশে ভূরি ভূরি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও এরা জাতিকে এই দুর্দিনে কোন পথ দেখাতে পারছে না, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যস্ত আছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং সাবান শ্যাম্পু বানানো নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই ধরণের সাবান শ্যাম্পু বানানো অবশ্যই কাবিলে তারিফ, কিন্তু এগুলো যে কোন রকেট সায়েন্স নহে এটা তাদের কে বুঝাবে!! বিজ্ঞানের প্রতি যেই পর্যন্ত দরদ দেয়া না হবে, বিজ্ঞানকে রুট লেভেল থেকে যত্ন না নেয়া হবে, বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী বাড়ানো না হবে, গবেষণায় বরাদ্ধ না বাড়ানো হবে ততদিনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সত্যকারের বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠবে না।
প্রকৃতি কোন কিছুরই অপূর্ণতা পছন্দ করে না, বিজ্ঞান চর্চা যেই সমাজে বিরাজ করবে না সেখানে অ-বিজ্ঞান এসে ছুড়ি চালাবে। সম্প্রতি আমাদের দেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরকে দেখলাম গবেষণা করে বের করেছে কোন ইথানল বা মিথানল খেলে নাকি করোনার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। বাস্তবে এটা খেলে করোনার ভবলীলা সাঙ্গ হবার সাথে সাথে যে খাবে তারও ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেতে পারে। এখনই সময় আমাদের নাবালক শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন করে, স্কুল পর্যায় থেকেই ছেলেমেয়েদের সত্যিকারের বিজ্ঞান চর্চার চেতনা জাগ্রত করা। এদের মধ্য থেকেই একসময় জানু জানু সব বিজ্ঞানী তৈরি হবে। আজ মানব জাতির বিপক্ষে বোলিং করছে করোনা, কাল হয়ত অন্যকোন ভাইরাস বোলিং করবে। তাই বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি দরদ দিতে হবে আমাদের। সত্যিকারের বিজ্ঞানের আলেম তৈরি করতে হবে যারা সত্যিকারের বিজ্ঞান চর্চা করবে, ক্ষতিকর ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়াকে পরাস্থ করার ক্ষমতা অর্জন করবে।
পৃথিবীর এই দূর্দিনে ঘরে থাকুন, নিজে বাচুন, দেশকে বাচান।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১:১০