আমার শৈশবের প্রায় অর্ধেকটাই কেটেছে চক্রবর্তী পরিবারের সাথে। বাসায় মা হালুয়া রুটি বানালেও মাসিমার রান্না ঘরে গিয়ে চা দিয়ে টোস্ট বিস্কুট খাওয়াই লাগত। দুপুরে কচুর লতি, শাক ভাজি আর সরিষা ইলিশ। কিংবা বড়দার থাল থেকে মুরগির রানটা ভাগাভাগি করে খাওয়ার স্মৃতি মুছে যায়নি। বড়দা বেঁচে নেই, বিয়ে, একটা সন্তান হবার পর আকস্মাৎ মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান।সেই সন্তানের অন্ন প্রাসনের দিনটির কথাও মনে আছে। মাসিমার খিচুড়ির একটা খ্যাতি ছিল, সাথে বেগুনের চাকা ভাজি রাখতে ভুলতেন না। কিংবা পূজোতে মুড়ির লাড়ু আর নারিকেলের বরফির জন্য আমরা মুখিয়ে থাকতাম।
মাসিমার স্বামীকে ভাইয়া ডাকতাম, বাদাম কিনে দিতেন বলে বাদাম ভাইয়া।ঠাকুর ঘরে ঢুকলেই উনার পাশে বসে সুর মিলিয়ে নমঃ নমঃ করতাম। ঠাকুর ঘরে বিশেষভাবে রাখা চিনি বা মিষ্টান্নের ব্যাপারে আগ্রহটাই ছিল বেশি। হিন্দুদের বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান হলে তাই মাসির বাসায় আসা অন্য পিচ্চিদের সাথে পড়ে থাকতাম। মাতা কালির সংহারী মূর্তির ছবি দেখে আতঙ্কিত হতাম , অন্যান্য পিচ্চিরাও দেব-দেবী ছবি দেখিয়ে বিভিন্ন পাপ-ভয়ের কথা শোনাতো।
আমাদের উচ্চশিক্ষিত মহল্লায় কখনও কাউকে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা, অবজ্ঞা নিয়ে বেড়ে উঠতে দেখিনি, অন্তত জিনিসগুলোর সাথে আমার জ্ঞানত পরিচয় ছিলনা। ওরা হিন্দু, ওখানে যেওনা, ওখানে খেওনা ---এমন শিক্ষা কোন ভাবেই কোনদিন আমাদের দেয়া হয়নি। তার উপর বাবার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন 'সেন' হিন্দু, উনার ছেলের মেডিক্যালে চান্স পাবার সুবাদে বাবাও বলতেন, দেখ দেখ উনার ছেলের মত তোকেও হতে হবে।শহরের ৫০ ভাগ হিন্দু, অনেক মন্দির-আশ্রম, প্রায় সব রাস্তার নামকরণ হিন্দুদের নামে। পূজা-রোজা একসাথে হলে ইফতারের সময় হিন্দুরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে ঢোলের শব্দ বন্ধ রাখতেন।
সময়ের সাথে সাথে নিজের একটা সম্প্রদায়গত 'অবস্থান' অনুভব করতে থাকি এবং সেটা অবশ্যই কোন বিপরীত মতাদর্শকে "অপছন্দ, অবজ্ঞা" করে নয়, যে তাকে 'সাম্প্রদায়িকতা' বলতে হবে। আরো দেখি শুধু 'ধর্ম বিশ্বাসের' তফাতের কারণে সাম্প্রদায়িক সংখ্যা গুরুত্ব, লঘুত্বের মত ব্যাপার গুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি, ছাত্রদলের ঘাটি বলে শ্লোগান দিলে অপরাপর ছাত্র সংগঠন গুলো অস্তিত্বগতভাবে কোণ ঠাসা হয়ে পড়বে এটাই সত্য। আমার হিন্দু বন্ধুদের মাঝে এমনি একটা কোণঠাসা হয়ে থাকার ভাব দেখতাম।
কাজেই, ভাব বিনিময়ের ব্যাপারে একটা বাড়তি সতর্কতা কাজ করতো। যে ধরনের ঠাট্টা স্বধর্মীয় বন্ধুদের সাথে করতাম, সেটি অন্যদের সাথে করার আগে দশবার ভাবতে হত। খুব বিচ্ছিন্ন বা কাকতালীয়ভাবে বিধর্মী বন্ধুর সাথে মশকরা করলেও যদি সে সেটার "ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ" থেকে আঘাত ভেবে বসে!বিদেশে এসে এ উপলব্ধিটা অনুভব করলাম। কোন অপরিচিত সাদা লোক তার নিজের স্বভাব বশত কর্কশ স্বরে কথা বলে উঠলে সেটিকে 'বর্ণবাদ' ভেবে মনটা খচখচ করতে থাকে। অথচ স্বাভাবিকভাবে নিলে দেখা যাবে লোকটি এমন স্বরে হয়ত সাদা-কালো সবার সাথেই কথা বলেন। ভিন্ন ধর্মের পাশাপাশি ভিন্ন বর্ণের হবার কারণে বিদেশিদের মাঝে উঠা বসা, চলাফেরায় কতটা অস্বস্তি , কোণঠাসা অনুভব করতে হয়, এখন বুঝি।
ব্যাপার গুলো এতদূর পর্যন্ত মানিয়ে নিতে পারলে হত। উচ্চ শিক্ষিত হিন্দু বন্ধুরা প্রায় কেউই ব্যক্তি ধর্ম তেমন পালন করেননা। তাদের ধর্মীয় অংশগ্রহণটা বার্ষিক কিছু পূজোর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে, যেটিকে 'সামাজিক উপলক্ষ' হিসেবেই নেন অনেকে। সেক্ষেত্রে অন্যান্য ধর্মের লোকদের ধর্ম পালনের বিষয়টি তাঁরা সতর্কভাবে লক্ষ্য করেন। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের ব্যাপারে যে কড়াকড়ি করে, সেটিকে কারো কাছে বাড়াবাড়ি বলে মনে হতে পারে। নামায পরেও কিছু ধর্মীয় 'বেশ-ভূষা', 'বই-পুস্তক' হাতে নিলে বিধর্মীদের মনে সেটিকে 'চরমপন্থার' অনুগত হওয়া মনে হতে পারে। এমন কি মামুলি ব্যক্তিধর্ম পালনের বিষয়টিও "সম্ভাব্য সন্ত্রাসী জঙ্গি গোষ্ঠীর সমর্থক" হিসেবে প্রচন্ড সন্দেহের উদ্রেক করে।পুরোপুরি ব্যক্তি ধর্ম পালনে আন্তরিকতা (ধর্মীয় গন্ডির মাঝেই অনুশাসন গুলো শক্তভাবে মেনে চলার চেষ্টা)দেখানো মানেই কারো 'জঙ্গি হবার' বা 'জঙ্গি মনোভাব' ধারণ করা।এ আতঙ্কটা ঢালাওভাবে ঢুকে পড়ার বিষয়টি ক্ষেত্র বিশেষে নিরাপরাধী লোকজনকেও বিব্রত, বিড়ম্বনায় ফেলে দেয়।
অথচ আবেগবশত কেউ যদি 'আমার ধর্ম সেরা' নামের কোন ফেইসবুক গ্রুপে যোগদান করে, সেটিও বিধর্মীদের কাছে বিব্রত, বিরক্ত হবার জন্য যথেষ্ঠ কারণ। যদিও ব্যক্তিধর্ম পালনে বাড়তি আন্তরিকতা, বা ধর্মীয় আবেগবশত নিজ ধর্মের 'ধ্বজাধরাটা' আক্ষরিক অর্থে অন্য ধর্ম বিশ্বাসকে ধ্বংস করা বা ঘৃণা ছড়ানোর নিমিত্তে নয় । অন্যান্য ধর্মের তুলনায় নিজের ধর্মকে 'সেরা' ভাবে বলেই মানুষ তার নিজের ধর্মে অটল থাকে। কিন্তু এই 'সেরা ভাবনাটা' অন্য ধর্মকে 'খাট' করার অভিপ্রায়ে নয়। সেক্ষেত্রে মুহাম্মদের ধর্মে বিশ্বাসী একজনের পক্ষে 'সব ধর্ম সমান', 'ধর্ম একটা হলেই হল' এ ধরনের মতবাদ প্রচার করা তার 'ব্যক্তি ধর্মের' মৌলিকতার পরিপন্থী।
মুহাম্মদের ধর্মের সাথে অন্য ধর্মের এই বিকট দূরত্বটা লক্ষণীয়। মুহাম্মদী ধর্ম ব্যাপারে কঠোর বিদ্বেষী নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক ভি এস নাইপলের মত কথাটা মুখ ফসকে অনেকেই বলেন। প্রচলিত অর্থে ধর্ম বলতে যা বুঝায় মুহাম্মদের ধর্ম মোটেও সেরকম কিছুনা। এমনকি অন্যান্য ধর্মের সাথে মুহাম্মদের ধর্মের মিথস্ক্রিয়তারও কোন সুযোগ নেই। এর কারণ, উৎস, প্রসঙ্গ গুলো বুদ্ধিমান পাঠক মাত্রই ধরতে পারবেন। এখন প্রচলিত সভ্যতার সাথে টিকে থাকতে এবং সন্ত্রাসবাদের অপবাদ রুখতে মুহাম্মদের ধর্মের একটা নতুন জাকালো নাম দেয়া হয়েছে, 'শান্তির ধর্ম'। মুহাম্মদের ধর্মের মৌলিক বিধি নিষেধগুলো খুব পরিষ্কার, এখানে সংযোগ, বিয়োগের কোন অবকাশ দেয়া হয়নি। এমনকি আরবি কোরআনকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করলেও ভিন্ন ভাষার সেই পুস্তকটিকে আর কোরআন বলা হয়না। আবার প্রগতিশীল যেকোন বিশ্বাসের লোকেরা চান একটা 'মৌলবাদমুক্ত' মুহাম্মদী ধর্ম।
আমি বিশ্বাস করি সূর্য একদিন পশ্চিমে উঠবে, এটা একান্তই আমার বিশ্বাস। বিশ্বাস করার, স্বপ্ন দেখার, কল্পনা করার অধিকার নিজের নিজের। এখানে যুক্তি দিয়ে খন্ডন করতে যাইনি, বিশ্বাসকে অপযুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে কোন জাকির নায়েকের দারস্থও হইনি। নেহায়েত ব্যক্তি বিশ্বাসের কারণে একজনকে খুব সহজেই 'ছাগু ট্যাগিং' করে ফেলা যায়। তৎক্ষণাৎ, সেখানে 'যুক্তি' দিয়ে নিজের 'অন্ধ বিশ্বাসের' কার্যকারণ চাওয়া হয় অবিশ্বাসী মহল থেকে। 'যুক্তি বনাম বিশ্বাসের' একটা বিষম বিতর্ককের পাটাতন গড়তে বিশ্বাসীদের পাশাপাশি অবিশ্বাসীদের ভূমিকা বরাবরের মতই উগ্র। ঠিক তখনই জাকির নায়েকের মত চরিত্রদের টেনে আনা হয়, আরেক দফা গালাগাল, শোরগোল উঠে।
আমি আমার পিতৃপুরুষের ধর্মে বিশ্বাস রাখতে পারিনি দেখে চাই অপরাপর ধর্মালম্বী লোকেরাও তাদের ধর্ম পালন 'সীমিত' করুক, আরো ভাল হয় অপরাপর ধর্মারম্বীরা যদি তাদের 'ধর্ম পালন ত্যাগ' করেন। ধর্ম জিনিসটা পুরোপুরি বিলোপ করে দেবার প্রস্তাব ওঠে শুধু 'বিশ্বাসগত ফারাকের' কারণে মানুষের ঘটানো 'রক্তপাত ও অন্যায়' দেখিয়ে। পুরোপুরিভাবে ধর্ম পালনের চেষ্টাটা অনেকের সংজ্ঞামতে 'ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি' এমনকি কারো ক্ষতি না করে সম্পূর্ণ নিজের ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধর্ম পালন হলেও। আমরা আমাদের পিতৃপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে সদলবলে 'যুক্তিশীল-অবিশ্বাসী'দের খাতায় নাম লিখিয়েছি ।এখন সংজ্ঞামত 'সভ্য মানুষ' হতে হলে আপনাকেও তাই করতে হবে, নচেৎ আপনি প্রগতিবিরুদ্ধ 'ছাগু'।
অবিশ্বাসীদের কাছে বিশ্বাসীদের ধর্ম পালন নেহায়েৎ অর্থের অপচয়, সময় নষ্ট করা, "সুবিধাবাদী মূর্খ মানব সৃষ্ট" অপবিশ্বাস লালনের নামে মানবধর্ম বিরোধী চর্চা।তারপরেও কিছু কিছু প্রগতিশীল/সুশীল বিশ্বাসীকে তাদের অবিশ্বাসী বন্ধুগণ "ভালা পান"। ঠিক কতটা ধর্মমুক্ত, (অপ) বিশ্বাসমুক্ত 'যৌক্তিক পন্ডিত' হতে পারলে "মৌলবাদী ছাগু"র খাতা থেকে নাম কাটা যাবে এবং অবিশ্বাসীদের আস্থাভাজন হওয়া যাবে, এটা বিশ্বাসীদের জানা দরকার। বিশ্বাসীরা কতটুকু ও কীভাবে তাদের বিশ্বাস ধারণ করবে সেটিও অবিশ্বাসীদের বলে দিতে হবে গালিমুক্ত থাকার জন্য। কারণ যুগটা তো অবিশ্বাসী, বিজ্ঞান মনষ্ক, যৌক্তিক প্রগতিশীলদের, তাদের প্রতিষ্ঠিত 'চেতনা'র দাসবৃত্তি না করে কী উপায়!