পর্ব_১
"The relationship between philosophy, science, engineering and technology. "
- ঠিক এই টপিক টার উপর সকাল ৮.৩০ থেকে শুরু করে টানা ১ ঘন্টা লেকচার দেয়ার পর স্যার বললেন "Now its time for a 5 minutes short break" - বলেই হনহন করে AKK স্যার শ্রেণীকক্ষ ত্যাগ করলেন।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসে প্রথম দিনেই এমন কুপোকাত হবো ভাবতে পারিনি। আনুষ্ঠানিক পরিচিতিপর্ব শেষেই এই প্রফেসরের দর্শন, বিজ্ঞান, প্রকৌশলবিদ্যা, প্রযুক্তি সব মিলেমিশে একাকার.....দুচোখে কেবলই সরষে ফুল দেখছিলাম। দাঁতভাঙ্গা ইংরেজি শব্দ শুনতে আর লিখতে লিখতে সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত।
দিনটা প্রায় বছর পাঁচেক আগের জানুয়ারির একটি সুন্দর সকাল। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে শহরের একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসা। জানি এতে অনেকেরই দ্বিমত থাকবে, কারণ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে সাধারণত কাঠখড় পুড়াতে হয় না। সত্য বলতে কি খুব ভাল ফলাফল করে উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পরও প্রায় বছর-দুয়েক ধরে কই মাছের মতো এদিক ওদিক খাবি খাচ্ছিলাম। পরপর দুবার মেরিন একাডেমি – তে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পরও ভাইবা তে অনুত্তীর্ণ হওয়ার ব্যার্থতায় চুলোয় গিয়েছিল আমার উচ্চশিক্ষা। অবশ্য স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে ভর্তি থাকায় গোটাকয়েক টিউশন জোগাতে বেগ পেতে হতো না, পাশাপাশি শহরে বেশ কিছু কোচিং সেন্টার এ পূর্ণকালীন ও খন্ডকালীন খ্যাপ মেরে আমার চলে যেত বিন্দাস।
সে যাই হোক, কোন এক কোচিং এ ক্লাস নিতে গিয়ে কলেজের পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা। তার সাথে দেখা না হলে হয়তোবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াটাও হয়ে উঠতো না, কেননা প্রাইভেট ভার্সিটি মানেই মনে করতাম বিলাসিতা। সিটি কর্পোরেশন এর আওতাধীন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে এতো সুলভে পড়া সম্ভম তার কাছেই আশ্বস্ত হয়েছিলাম।
ইতোমধ্যেই এসব ভাবতে ভাবতে স্যার রোবটের মতো শ্রেণীকক্ষে ঢুকলেন। এসেই ঘোষণা দিলেন -“আমি তোমাদের গণিত-১ এর ক্লাসটি এডজাস্ট করে আগে নিয়ে এসেছি, ফিজিক্স-১ শেষেই শুরু হবে গণিত-১।”
খাইছে… আজকে তো শহীদ- সজোরে বলে উঠলাম আমি। মাত্রই পরিচিত হওয়া কিছু সহপাঠীরাও এককাট্টা হয়ে গেল, হবেনা স্যার হবেনা, ৪ ঘন্টা টানা ক্লাস করা সম্ভব না, আজকে প্রথম দিন… ১ ঘন্টা অন্তত মাফ করেন।
আমাদের স্বান্তনা দিয়ে স্যারও বোর্ডে লিখতে শুরু করে দিলেন। “ত্রি ইডিয়টস” এর ভাইরাসের কথা মনে পড়ে গেল আমার। মোটামুটি শ্রেণীকক্ষে সবাই কিছুটা ফ্রি হয়ে এসেছে আর স্যার বোর্ডের দিকে ফিরে লিখা আরম্ভ করা মাত্রই আমাদের পাশাপাশি কথোপকথন এর গুণগুণ শব্দ। ওয়ারিফ আমি আর জহিরের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ক্লাসে মাত্র ৩ টা মেয়ে কেন ?
ওয়ারিফ ছেলেটার সাথে আমার পরিচয় হয় ভর্তি পরীক্ষার আরো আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তার নাম আরিফ না ওয়ারিফ এইটা বুঝতে আমার আরো এক সপ্তাহ লেগেছিল। প্রথম থেকেই সে আমাকে ভরশা দিয়ে আসছিল। তার ভাষায়ঃ
- “প্রাইবিট ভার্চিটি বলি চিন্তা গরার কিছু নাই, সিডিএ মার্কেটে আমার বড় ভাই এর দোআন আছে… বেক ডইল্লে মোটর, পুশ, রিলে, সুইচ আছে অখানে। আমরা ক্লাস শেষ গরি অখানে গিয়ে কাজ শিখতে পারব। ”
তার এই ভাষ্যে মুগ্ধ হয়ে তাকেই আমি গুরু ভাবা শুরু করলাম- কেননা যে সময়টা নষ্ট করেছি তা সুদে-আসলে আমাকে উদ্ধার করতেই হবে, আর এজন্যে কারিগরী শিক্ষার কোন বিকল্প নাই। পরবর্তীতে অবশ্য সকাল-বিকাল ভার্সিটির টানা ক্লাস-ল্যাব আর কোচিং-টিউশন শেষ করে তার সেই বড় ভাই এর দোকানে যাওয়া হয়ে উঠেনি।
ক্লাস নিতে নিতে স্যার প্রায় পৌনে চার ঘন্টা পার করে আমাদের মুক্তি দিলেন। যাবার আগে বলে গেলেন-“ফার্স্ট সেমিস্টার এ সব ব্যাচেই এরকম ক্লাস ভর্তি ছাত্রছাত্রী দেখি, ৭ম-৮ম সেমিস্টারে গিয়ে দেখা যায় হাতে গোনা জনা-বিশেক। নিজেরাই ঠিক করে নেন কোন দলে থাকবেন আপনারা?”
“আমগোর উপর দিয়া ৪ ঘন্টা বুল্ডোজার চালাইয়া বুইড়া এখন কয় কি ?”- পেছন থেকে এক ছাত্রের মৃদ্যুস্বরে প্রতিবাদ।
শিক্ষক যেতে না যেতেই পুরো ক্লাস আবার গমগম করে উঠলো, যেন একঝাঁক ভেড়ার পালের অবিরাম ডাকাডাকি। এরই মধ্যে ছোট ছোট পরিচিতিপর্ব হয়ে গেছে। যে যার সাথে পারছে পরিচিত হচ্ছে… আমি নির্লিপ্তভাবে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে আরাম করছি আর যারা আসছে আমার হয়ে ওয়ারিফ আর জহির আমাকে তাদের মাঝে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।
লক্ষ্য করলাম… খুব লম্বা করে একটি মেয়ে, আর দুটি মেয়ে একটু বেটে করে প্রমান সাইজের। তাদের সাথে বন্ধুত্ব করার জন্যে তোড়জোড় চলছে সবার। খুব ফর্সা করে গুল্লু টাইপের একটু ওভার স্মার্ট দীপ্ত নামের একটি ছেলে দেখছিলাম তাদের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে খুব, সাথে আছে মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা মীর নামের একটি ছেলে। শ্রেণীকক্ষখানা বিশাল হওয়ায় পেছনে বসে সবকিছু দেখছিলাম আর মুখ টিপে টিপে হাসছিলাম। সময়ক্ষেপণের জন্যে মোবাইল তো পকেটে ছিলই। সবাই প্রচুর সেলফি তুলছিল… এভাবে ওভাবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্টাটাস দেবে হয়ত। আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা- এই বয়সটা আমি আরো দু-বছর আগে ফেলে এসেছি, এখন আমার এসব করা সাজেনা। পরে অবশ্য জানতে পেরেছি আমার চেয়ে সিনিয়র পাবলিক আরো আছে জনা-তিনেক এই ১৬তম ব্যাচে, যদিওবা দু-এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই আমি নিজেকে সবার মধ্যেই একজন হিসেবে আবিষ্কার করেছি।
প্রথম দিনেই কোন শ্রেণী প্রতিনিধি (CR) না থাকায় জহির দায়িত্ব নিয়ে ক্যামিস্ট্রি ল্যাব সেকশন এর গ্রুপ বিভাজন জানিয়ে দিল। জহির ছেলেটা খুবই ভদ্র, ধার্মিক আর দায়িত্বপরায়ণ। সেই প্রথম দিন থেকেই আমাকে ভাই বলেই ডাকছে …… আজও দেখা হলে ডাকে “সানি ভাই”।
সার্কিট-১ ক্লাসটিতে ম্যাম উপস্থিত না থাকায় সকলেই যে যার মতো বেরিয়ে পড়তে লাগল। কতিপয় সহপাঠী দল বেঁধে আড্ডা শুরু করল নিচতলার বিশাল ক্যান্টিনে। আমি তখনো সবার সাথে ভালভাবে মিশতে পারছিলাম না ওয়ারিফ , জহির আর জিগর ছাড়া । জিগর ছেলেটা ওয়ারিফের স্কুলের বন্ধু, খুবই ভদ্র, মিশুক আর দিলখোলা মানুষ। ওরে প্রশ্ন করলাম জিগর মানে কি-রে? প্রত্যুত্তরে বলল- “এইটা বোঝেন না ভাই, কলিজা কলিজা। কি করতে হবে জাস্ট বলেন। এই জিগর আপনার পাশে আছে।” – যাক, ছেলেটার নামের সাথে কাজের মিল আছে।
প্রথম দিনের ক্লাস আর হালকা কথোপকথন শেষে বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরলাম, কোচিং সেন্টার গুলোতে যেতে হবে। রুটিন এডজাস্ট করতে হবে পরিচালকের সাথে বসে। যেতে যেতে হঠাৎ একটা চায়ের টং থেকে ডাক পড়লঃ
-“এই মাম্মা, কি খবর? এদিকে আয়, বয় । চা খাবি ? ”
চায়ের ব্যাপারে আমার জুড়ি মেলা ভার, হোক কনকনে ঠান্ডা, বৃষ্টিস্নাত দিন কিংবা তপ্ত প্রখর রৌদ্রজ্জ্বল দুপুর। মাথা নিচু করে ঢুকলাম টঙঘরে। ছেলেটা বড্ড মিশুক, হাত মেলালাম।
-আমি নুহাশ, আজকে ক্লাসে দেখছিলাম তোকে।
-সুন্দর নাম। আমি সানি, দেখা হয়ে ভাল লাগল।
-সিগারেট কোনটা খাবি? গোল্ড লিফ, বেনসন না নেভী ?
-দুঃখিত, আমি আসলে সিগারেট খাই না। আমার চা-তেই চলবে।
-বুঝলি, ভার্সিটি তে আমার মামা আছে। এখানের ইইই-র ১ম ব্যাচ। এখান থেকে পড়ে এখানেরই লেকচারার হইছেন।
... ............খাইছে, এইখানেও মামা-চাচা- মনে মনে বললাম আমি।
পরে চা শেষ করে নুহাশের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জিইসি মোড় থেকে কাঠগড়ের বাস ধরলাম।
>>>>>>>>>>>>>>>>>চলবে>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>
#বিঃদ্রঃ আমার স্নাতকের সময়কার স্মৃতিগুলো পর্ব আকারে লিখার চেষ্টায় আছি। প্রতি সপ্তাহে একটি-দুটি বা তিনটি করে পর্ব প্রকাশের চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। সবগুলি পর্ব ব্লগ আকারে থাকবে আমারসাইটথাকবে। যদি আল্লাহ সুস্থ রাখে আশা করছি সুন্দর একটি সিরিজ উপহার দিতে পারব ইনশাআল্লাহ ।