আমার একটা পরিচিত মানুষ আছে। ঠিক মানুষ না, বন্ধু অথবা ধরা যাক মানুষই। সুনীলের কবিতা পড়তে পড়তে তারও একটা কিছু কেনার ইচ্ছা হয়েছিলো। সুনীলের মত তারও টাকার জন্য আটকাত না। আসলে কবিদের টাকার জন্য কিছুই আটকায় না, কিনা? অন্যমনস্ক মানুষটি এবং আমার বন্ধুটি একদিন হুট করে মরে গিয়েছিলো। ভিড়ের মধ্যে। সবাই বুঝতেই পারেনি। ফুটপাথে, বৃষ্টি নামলে, হঠাৎ দেখা গ্যাল জল ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। আমি জানতাম, এটা তার ইচ্ছামৃত্যু। সে ফুটপাথ কিনতে চেয়েছিলো।
তার সমগ্র পরিশ্রমের সম্পদটুকো দিয়ে একটা প্রান্তহীন এবং বিস্তৃত ফুটপাথ কিনতে চেয়েছিলো। ফুটপাথে জীবন থাকে, জীবিকসহ। তার সকল সম্পদ আহরণ ছিলো এই ফুটপাথ থেকেই। এখানে সে ভালবাসা বেচেছিলো। যদিও ভাল দাম পাওয়া যায়নি। আমাকে গোপনে একদিন বলেছিলো, সে আসলে দামই নিতে চায়নি। শুধু বড়ই করুণ স্বরে দাবী করেছিলো ফুটপাথটি তাকে দিয়ে দেওয়ার জন্য। অথচ সে ফুটপাথ পেল না। এক জীবনের ভালবাসার বিনিময়ে ফুটপাথ কি বেশি মূল্যবান ছিলো?
যার ঘর আছে এবং যাদের, ঘরহীন লোকগুলো বড্ড বোকা। যেখানে চাইলেই বিস্তৃত ফুটপাথ এবং সমগ্র আকাশ দাবী করতে পার অথবা চর দখলের মত করে দখল নিতে পারো, কেন, কিসের আশায় তুমি ঘর বেছে নিতে চাও? এই প্রশ্ন তুলতেই ঘরের ভিতরের লোকগুলো বাহিরে চলে আসল, তারাও বুঝে নিতে চায় জাদুকর সময়ের ফুটপাথ এবং দিগম্বর আকাশ। অনিবার্য প্রেমে ভালবাস থাকে না। কামনা থাকে না। ঠিক তেমন করেই ঘরহীন লোক এবং ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসা লোকগুলো বেছে নিল যুদ্ধ। সেখানে ভালবাসার আবাদ হয়নি। ফুটপাথ কেবল নিরব দর্শক ছিল।
মুছে গ্যালে দুর্দিনের ব্যাথা, আমার বন্ধু যেমন চলে গিয়েছিলো, ফুটপাথ আমাকে সঙ্গ দিয়েছিলো। স্বপ্ন দিয়েছিলো। স্বপ্ন এক প্রবাহমান নদীর মত। উজান থেকে ভালবাসা নিয়ে আসে তার ভাটির প্রেমিক এর জন্য। মাঝখানে ডাকাতি হয়ে গ্যালে ভালবাসা, ডাকাতও হয়ে যায় মহান প্রেমিক। এ এক আজিব জাদুকর। নদী এসে মিশে যায় ফুটপাথেই, শেষ পর্যন্ত। ডাকাত প্রেমিকও আসন খোজে। ঘর ছেড়ে লোকজন মিশে যায় ঘরহীন মানুষের সাথে। চোখের সীমানায় পুরোটায় হয়ে উঠে ফুটপাথ। আজম্ম লালিত স্বপ্ন বয়ে যায় যুগান্তরের উত্তারাধিকারের বিপ্লবী কাধে। বিপ্লব এবং প্রেম যুগল বন্দী হয়ে হাটে সমগ্র ফুটপাথের চরাচর ধরে। মধ্যাহ্নের জোছনায় ছায়ায় ফুটপাথ হয়ে উঠে ফসলি। দোআশ তার বুকে। ছুয়েঁ দিলেই ফুটে চন্দ্রমল্লিকা, শিমুল আর শিউলি। ফুটপাথ আচ্ছাদিত হয়ে যায়। ক্রমশঃ দীর্ঘ ছায়ারা জুড়ে থাকে ফুটপাত জুড়ে, কিন্তু নিঃশেষ হয় না।