৫ জানুয়ারি নির্বাচনোত্তর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকারের মন্ত্রিপরিষদ শপথ গ্রহণ করেছে ১২ জানুয়ারি । কীভাবে নির্বচান বা কাদেরকে নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হল তা নিয়ে সিংহভাগ মানুষের যেটুকু ভাবনা, তারও চেয়ে তাদের বহুগুণ বেশি ভাবনা নতুন সরকার কীভাবে দেশ পরিচালনা করবে তা নিয়ে। কারণ মুষ্টিমেয় কতিপয় লোকজন বাদে দেশের আপমর জনসাধারণ রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে উন্নয়ন, সুশাসন ও শান্তি-শৃংখলা বিরাজমান দেখতে ও সেসবের সুফল ভোগ করতে চায়। এই চাওয়া তাদের নাগরিক অধিকার এবং রাষ্ট্রের পক্ষে তা নিশ্চিত করা সরকারের মুখ্য দায়িত্ব ও কর্তব্য ।
’৪৭-এর পূর্বে না গিয়েও বলা যায়- বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ড, অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের চাহিদা পূরণে পাকিস্তান সরকার ব্যর্থ হয়েছিল বা তারা ইচ্ছাকৃতভাবে পূরণ করতে চায়নি বলেই এ দেশের জনগণ ক্রমে-ক্রমে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ব্রিটিশদের কাছ থেকে সদ্য স্বাধীন এ অঞ্চলের বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রাণের চাহিদা ছিল- তাদের মায়ের ভাষা ‘বাংলা’কে পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আসীন করবে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী সেই চাহিদা পূরণে অনিহা প্রকাশ করলে ভাষা আন্দোলনের মধ্যমে বাঙালিদের প্রথম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এরপর ক্রমাগত পাকিস্তানীদের শাসন, শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার ও নির্যাতনের ফলে ৫৪’র নির্বাচন, ৬২’র শিক্ষা ও ৬৬’র ৬-দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৭০-এর নির্বচানের মাধ্যমে এ দেশের গণমানুষের ক্ষোভ থেকে চেতনা জাগ্রত হয়- যার মূল ভিত্তি ছিল ‘বাঙালি’ জাতীয়তবাদ। এই চেতনাকে কেন্দ্র করেই এ দেশের গণমানুষের সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা আবর্তিত হয়- যেসবের মধ্যে রয়েছে- গনতান্ত্রিক ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ। পাকিস্তানীরা এসব চেতনাবোধের প্রতি কোনো প্রকার গুরুত্বতো দেয়-ই নি, বরঞ্চ তারা বাঙালিদের প্রতি নানাভাবে বঞ্চনা, অত্যাচার, নির্যাতন চালিয়ে যায়। ফলে বাঙালিরা স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয় এবং শেষমেষ তাতে বিজয়ী হয়। পরবর্তীতে, বিশেষত ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সামরিক হস্তক্ষেপ এবং সরকারি ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগুলো একের পর এক বিসর্জন দেয়া হতে থাকে। ১৯৯৬, ২০০৯ এবং অতিসম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক রাষ্ট্র এবং সরকার পরিচালিত হয়েছে বা হচ্ছে তা বলা যাবে না। কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফিরে যাবার পূর্বশর্ত হচ্ছে- ’৭২ এর মূল সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন করা । তাতো করা যায়নি!
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক দেশ পরিচালিত হওয়া বা না হওয়া নির্বিশেষে যে বিষয়টি নিগূঢ় সত্য, তা হচ্ছে বর্তমানে গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে তাদের চাহিদামাফিক সরকার দেশ পরিচালনা করবে। কী সেইসব আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা!
এ প্রসঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যের ‘পঞ্চতন্ত্র’ গল্পগ্রন্থে মুদ্রিত সে যুগের বিখ্যাত লেখক বিষ্ণুশর্মা কর্তৃক রচিত ‘তিন মুনি’ গল্পে বিবাহকালে বর নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিভেদে ভিন্ন-ভিন্ন পছন্দ বা চাহিদাসংক্রান্ত একটি শ্লোক রূপক অর্থে প্রণিধানযোগ্য-
“কন্যা কাময়তে রূপং মাতা বিত্তং পিতা শ্রৌতম্।
বান্ধবাঃ কুলমিচ্ছন্তি মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ।।”
শ্লোকটির বাংলা তর্জমা হচ্ছে- কন্যার কমনা বরের রূপ, মাতা চান বিত্ত, পিতা চান যশখ্যাতি, আত্মীয়-স্বজনরা চান উচ্চবংশ, আর বাকি প্রত্যেকেই চান মিষ্টান্নভোজন। এখানে মিষ্টান্নভোজন বলতে মূলত উৎকৃষ্টমানের খাবারে তুষ্ট হওয়ার কথাই বুঝানো হয়েছে।
রাষ্ট্র এবং সরকারের ক্ষেত্রে কে বা কারা বর, কনে, মাতা, পিতা এবং আত্মীয়-স্বজন হিসেবে বিবেচ্য হতে পারেন তা এই আলোচনার মুখ্য বিষয় নয়, মুখ্য বিষয় হচ্ছে- রূপক ঐসব চরিত্রের বাইরে দেশের বাকি প্রত্যেকটি মানুষ, অর্থাৎ আমজনতার চাহিদা- যা প্রবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে।
আমজনতার চাহিদা পূরণে সর্বক্ষেত্রে ত্বরিত উন্নয়ন অপিহার্য। এ সবের মধ্যে রয়েছে- পদ্মাসেতু, বিশ্বমানের নতুন বিমান বন্দর ও ঢাকা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সারা দেশের অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন, মাঝারি ও ভারী শিল্প স্থাপন, জ্বালানি ও বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, কৃষিখাতের আধুনিকায় সারা দেশকে তথ্যপ্রযুক্তি মহাসড়কের ইন্দ্রজালের অধীনে নিয়ে আসা ইত্যাদি। বিশাল এই প্রতিটি কর্মযজ্ঞ সুসম্পন্নকরণে সুশাসনের কোন বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আদালতে বিচার এবং অযোগ্য ও অকর্মণ্যদেরকে অব্যাহতিদান সর্বোত্তম ব্যবস্থা হতে পারে। অন্যদিকে দেশে দ্রুত উন্নয়ন সাধন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় শান্তি-শৃংখলা রক্ষা অতীব জরুরি। শান্তি-শৃংখলা বিঘ্নিত হয় এমন যে কোনো কর্মকাণ্ড কঠোরহস্তে দমন করা অপরিহার্য। হতে পারে তা রাজনৈতিক, মৌলবাদ, ধর্মীও উস্কানি কিংবা সাম্প্রদায়িক হামলা। উল্লেখ্য, দেশের নগণ্যসংখ্যক কিছু মানুষ শান্তি-শৃংখলা বিঘ্ন ঘটিয়ে আসছে এবং তারা চিহ্ণিত। এই চিহ্ণিত উচ্ছৃঙ্খল এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া শুরু করলে খুব স্বল্প সময়েই দেশে শান্তি-শৃংখলা স্থাপিত হবে- এ কথা নিশ্চিত বলা যায়।
বাংলাদেশকে ২০২১ সালে মধ্যম আয় এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত করার সরকারি ঘোষণা বাস্তবায়নে সুশাসন প্রতিষ্ঠিতার মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহতভাবে পরিচালনা করা অপরিহার্য। আর সবচেয়ে বড় কথা- ধর্ম, বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষ যাতে দিনশেষে শান্তিতে ঘুমাতে পারে সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ও লেখক অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় যেমনটি বলেছেন- “পদ্মাসেতু থাকুক, ডিজিটাল বাংলাদশে থাকুক, বছরের প্রথম দিন ছেলেমেয়েদের হাতে বই পৌছে দেয়া চলুক। সবচেয়ে বেশি জরুরি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যেন শান্তিকে ঘুমাতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা”।
১২ জানুয়ারি গঠিত নতুন মন্ত্রিপরিষদ সম্পর্কে সর্বমহলের কমবেশি অভিতম হচ্ছে- এই মন্ত্রিপরিষদ পূর্বতন মন্ত্রিপরিষদের চেয়ে যোগ্যতর। তবে তা একমাত্র প্রমাণিত হবে এই মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের পারঙ্গমতার মাধ্যমে, তাদের যশ, নাম, অতীত রাজনৈতিক সফলতা বা অভিজ্ঞতার ঝুলির বিচারে নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধে যেমনটি বলেছেন- “কথায় বলে ‘মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ'; ভাণ্ডারে কী জমা আছে তাহা আন্দাজে হিসাব করিয়া বাহিরের লোকের কোনো সুখ নাই, তাহাদের পক্ষে মিষ্টান্নটা হাতে হাতে পাওয়া আবশ্যক”।