১.
মা প্রায়ই বলে জন্মের পর আমার পরমাত্মীয়রা আমায় কোলে নিতেন না।আমি দেখতে ভীষন কালো ছিলাম তাই।শুনে আমার মন খারাপ হয়।জিজ্ঞেস করি মা আমি এমন কেন হলাম?মা বলে - "বোকা ছেলে, দেখিস একদিন তুই আলো ছড়াবি। আমি তোর গায়ে সেই আলো দেখতে পাই"।লন্ঠনের সেই আলো আধাঁরিতেই জন্ম আমার ।
এখন বুঝি মা কোন আলোর কথা বলেছেন।আমি আজো খুঁজি সেই আলো। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় - মা কোন আলো দেখিনা আমি আমার মাঝে। কেমন জানি নির্লিপ্ত জীবন যাপন আমার।বিকারহীন। ক্ষয়ে যাওয়া ভেতরের সবটুকু।
২.
ফেব্রুয়ারী০৩, রাত ২.৩০মি.
ভাবনাটা মাথায় চেপে বসেছে।কাল রাত থেকেই।আধখানা বাঁকানো চাঁদের সাথে পাল্লা দিয়ে সারারাত দেখেছি "কাল পুরুষ"। বুদ্ধদেব দাস গুপ্তের ছবি।নায়ক সুমন্তের যাপিত জীবন আমায় ছুঁয়ে যায়।দেনা পাওনার হিসেব চুকে গেলে ভালোবাসা আর ভালোবাসা থাকেনা- হয়ে যায় করুণা।নিজের স্ত্রীর পেটে অন্যের সন্তান কেও সে ভালোবাসে নিজের সন্তানের মতোই--সবকিছু জেনেও।পার্থিব ভোগ বিলাসের উর্ধে উঠে অন্য এক জীবনের খোঁজে সুমন্ত।জীবনের প্রতি বিশ্বাসই তাকে বাঁচার প্রেরণা দেয়।উচ্চাভিলাসী স্ত্রীর কাছে যে কিছুই হয়ে উঠেনা শেষ পর্যন্ত। কেননা হয়ে উঠার অর্থ অন্য কিছু তার কাছে-- স্ত্রীর সামনে সরল স্বীকারোক্তি- "তোমার এতো অন্যায়েও জীবন আটকায় নি আমার--বেঁচে থাকার সাধ আমার আজো ভীষন প্রবল"।
কী অদ্ভুত এই বেঁচে থাকা! একেকটা জীবনের বাঁক একেক রকম।প্রতিটা বাঁকের অনুভুতিও আলাদা আলাদা।বুঝি সে কারনেই সক্রেটিস বলেছিলেন- "প্রতিটা মানুষের মাঝে একটাই মিল খুঁজে পাওয়া যায়- আর সেটা হচ্ছে প্রতিটা মানুষই আলাদা আলাদা"। প্রতি নিয়ত আমরা হয়ে উঠি। সচেতন ভাবে কিংবা অচেতন ভাবে। অথচ বুঝে উঠিনা আমরা কি চাই।নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়ায় গড়মিল।কী আশ্চর্য আত্মপ্রতারণা! আমরা যা নই তাই হয়ে উঠার নিরন্তর প্রচেস্টা।
৩.
ফেব্রুয়ারি ০৩,ভোর ৫.৩০মি.
প্রায়শই ভোর রাতে ঘুম ভাঙ্গে।আজও তাই।ভোরের গভীর ঘন গন্ধে।জানালা খুলে দেখি ছাই রঙের আকাশ।বিষাদের রঙ।চাপ চাপ কালো মেঘের ফাঁকে তখনো অস্তিত্বের শেষটুকু নিয়ে আধখানা চাঁদ।ফ্যাকাসে।শেষ রাতের ভাবনা বুক চেপে ধরে।দমবন্ধ অবস্থার মতো।ভাবি এক একটা দিন খসে পড়ছে।লক্ষ বছর পুরোনো নক্ষত্রের মতো।নিঃশব্দে।কী আশ্চর্য!কোথাও একটুও কেঁপে উঠেনি।
বাবার হাত ধরে পড়তে শেখা।সুকুমার দিয়ে শুরু।মানিক থেকে মার্কেজ।জীবনানন্দ হয়ে এখন সুনীল-শক্তিতে।হাতের নাগালে বাদ যায়নি কিছুই।আফসোস! মৃত্যুর পরেও সৃষ্টি হবে কালজয়ী কিছু সিনেমা, দেখা হবেনা; লিখা হবে আরো দারুণ কিছু, পড়া হবেনা।বার্গম্যান-কুরোসাওয়া-গদার-সামিরা-মাজিদ মাজিদি কিংবা স্পিলবার্গ--নাহ্ এতো কিছুতেও কিছু হয়না আমার।নিশ্চল আটপৌঢ়ে জীবন।রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছিলেন-"জগতের সাড়ে পনেরো আনা মানুষ শুধু আসে-সন্তান জন্ম দেয়- চলে যায়।" আমি বলি বীরোচিত প্রস্থান।
৪.
ফেব্রুয়ারি ০৩,সকাল ১১ টা।
স্থান শহীদ মিনার। রিক্সায় চেপে আমি। গন্তব্য বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার অফিস।বই মেলার কারনে শান্ট হয়ে যাওয়া রাস্তায় ভীষন জ্যাম।ভাবনায় ছেদ পরে।সামনের রিক্সাওয়ালার সাথে তীব্র বাদানুবাদ হেলমেট পরিহিত তরুণ এক মোটরসাইকেল আরোহীর।রিক্সার সামান্য ধাক্কার ফলাফল।ডিজুস তারুণ্য ঠিকরে বেরুচ্ছে যুবকের উদ্দাম শরীর হতে।
আচমকা সেই তরুণ ঝড়ের বেগে নেমে এসে হেলমেট দিয়ে সজোরে আঘাত করলো সেই খেটে খাওয়া মানুষটির মাথায়।মুহুর্তেই রক্তাক্ত তার ঘামে ভেজা শরীর।তারুণ্যের জয় হোক।আহা! কি বীর! কামিনী রায় বেঁচে থাকলে খুশিতে ডগমগ করতেন।
আর এক রিক্সায় স্থাণুর মতো বসে আমি।দর্শক মাত্র।নির্জীব।মুখ দিয়ে শুধু অস্ফুট স্বরে উচ্চারিত হলো...ধন্যবাদ হে মানবতা...