somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

**আলো ও অন্ধকারের গল্প**

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ৮:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি তমা ।
গায়ের রঙ কালো বলেই এই নাম রাখা হয়েছে বলে আমার ধারণা ।
জন্মের পর যদিও এত কালো ছিলাম না । কিন্তু দিন কে দিন কালো হচ্ছি বলে মনে হচ্ছে ।
আমার ছোট বোন ডলি । ও আমার থেকে চার বছরের ছোট ।
ওর নাম ডলি রাখারও কারণ আছে । ও খুব্বি সুইট । একদম ডল এর মত।
তাই সবাই ওকে ডলি বলে ডাকে ।
ডলি সোনা চাদেঁর কণা / ডলি মামনি কোথায় ?
কি সুন্দর করেই না ডাকে সবাই । আমাকে অবশ্য কেউ এত সুন্দর করে ডাকে না ।
রেগে গেলে মা আমাকে মা কালী বলে ডাকেন । আগে খুব কষ্ট পেতাম । একা একা কাঁদতাম ।
এখন আর কাঁদি না । কারণ মা প্রায় প্রতিদিন ই এই কথাটা বলেন ।
প্রতিদিন কি কান্নাকাটির সময় পাওয়া যায়?
আমাকে তো অনেক কাজ করতে হয় । এত মন খারাপের সময় কোথায়?
খুব ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছি ।
আমি এক রকম আদর পাই । আমার বোন এক রকম । আমি ভাবতাম আমি বোধহয় ভুল কিছু করি ।
তাই আদর পাই না । খুব ভাল হয়ে চলার চেষ্টা করতাম । মা যা বলত তাই শুনতাম । কখনো কিছু আবদার করতাম না । সবাইকে পুতুল দিয়ে খেলতে দেখতাম । মন খারাপ হত ঠিক ই কিন্তু মার কাছে চাইতাম না ।
তবুও আমার প্রতি ব্যবহারে কোন পরিবর্তন দেখি নি ।
আমাকে প্রায় ই বাসায় একা রেখে যেত ।
জন্মদিনের অনুষ্ঠান হোক,বিয়ে হোক মা আমাকে কোথাও নিত না ।
না নেয়াটা স্বাভাবিক । আমি দেখতে সুন্দর না ।
ডলি সুন্দর । ওকে কোথাও নিয়ে গেলে ওর গালে সবাই আদর করে দেয় ।
মাকে বলে "বাহ খুব সুইট তো আপনার বাচ্চা টি"। আমাকে নিলে উলটা কথা বলে ফেলে ।
আমি আট ন বছর বয়স থেকেই একা একা বাসায় থাকতাম । একটুও কাঁদতাম না ।
আলমারির উপরে রাখা কোরআন শরীফটির দিকে তাকাতাম ।
আর বলতাম "আমার সাথে আল্লাহ আছে। ভুত আমার কিচ্ছু করবে না ।" এই বলতাম আর ভয়ে কাপঁতে
থাকতাম । একটা সময় পর ঘুমিয়ে পড়তাম ।
আমার দাদু কথাটা শিখিয়ে দিয়েছিলেন । "যার সাথে আল্লাহ থাকে তার কোন কিছুর ভয় নেই ।"
দাদু মারা যাবার পর আমি আর কাউ কে পাই নি আমার সমস্যার কথা বলার ।
দাদু আমাকে আদর না করলে হয়ত ভাবতাম আমি "পালক মেয়ে" ।
অবশ্য আমার সাথে নাকি আমার মার অনেক মিল । মাও একটু শ্যামলা ধরনের ।
বাবা তো রীতিমত সুপুরুষ । লম্বা ,ফরসা । ডলি বাবার মত হয়েছে ।
আমার একদম ছোটবেলার টুকটাক কিছু ছবি আছে ।
( কালো মেয়ে বলে আমার তেমন ছবি তোলা হয় নি । ডলির অবশ্য প্রতিটি জন্মদিনের ছবি আছে ।
যখন বাসায় একা থাকি আমি মাঝে মাঝে দেখি । আহা কি সুন্দর আমার ছোট বোন টি । কিভাবে বড় হয়ে যাচ্ছে । )

আমাদের বুয়া আছে । তবুও রান্না আমাকেই করতে হয় । মা বুয়াদের রান্না খেতে পারেন না । আমার
পরীক্ষার সময়টুকুতে একটু কষ্ট হয় । না হলে রাঁধতে আমার অত কষ্ট হয় না । অনেক আগে থেকেই রান্না করি কিনা ।
রান্না খেয়ে মাঝে মাঝে বাবা বলে ফেলেন "বাহ আজকের টা তো বেশ মজা হয়েছে ।" তখন খুব ভাল লাগে ।
বাবা ও অবশ্য আমার সাথে কথা বলেন না । বাবা ব্যস্ত মানুষ । বাসায় থাকেন খুব কম ।
বাসায় থাকলে পিসির সামনে ।
আর কিছুটা সময় টিভির সামনে খবর দেখার জন্য ।
বাবা শেষ কবে আমাকে " মা" বলেছিল আমার মনে আছে । আমার ১০ম জন্মদিনে ।
কারো মনে নেই সে দিন আমার জন্মদিন ।
রাত ১২ টা বাজার পর আমি আমাদের রান্না ঘর থেকে একটা মোমবাতি নিয়ে জ্বালাচ্ছিলাম ।
নিজেই নিজেকে উইশ করছিলাম ।
বাবা হঠাৎ রান্না ঘরে চলে এসেছিলেন ।
"কিরে তমা এত রাতে কি করছিস?"
"কিছু না বাবা ।"
"কারেণ্ট আছে তো । মোম কেন জ্বালিয়েছিস ?"
"এমনি বাবা ।" আমার চোখে তখন পানি ছিল । সেই পানি তখন বোধহয় মোমের আলোয় বোঝা যাচ্ছিল ।
"কিরে তুই কাঁদছিস নাকি?"
"না বাবা চোখে কি যেন পড়েছে। "
বাবার হঠাৎ করে কিভাবে যেন মনে পড়ে গেল । "আজ জুলাই এর বার তারিখ না?"
আমি কিছু বলি না ।
"মারে! হ্যাপি বার্থ ডে ।আমার মনে ছিল নারে মা!আমি অনেক সরি। কালই তোকে নিয়ে বাইরে খেতে যাব ।
কাঁদিস না মা ।"
আমি কিছু বললাম না । বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম । অনেক দিন পর বাবাকে একটু ধরতে পারলাম ।
সে দিন অনেক খুশি হয়েছিলাম । সারা দিন কোথায় খেতে যাব ভাবছিলাম । মা ডলি কে নিয়ে অনেক জায়গায় যান ।
আমি যাই না তেমন কোথাও।
আর আমার স্কুলের মেয়েরা ও একটু গরিব টাইপ । (কেন জানি আম্মুর ধারণা আমাকে ভাল স্কুলে পড়ানোর দরকার নেই। তাই
আমার বোন কে ৬০ হাজার টাকা দিয়ে ভিকারুননিসায় ভর্তি করানো হলেও আমাকে আমাদের বাসার কাছে একটি মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছিল ।) তাই ওরাও তেমন ভাল কোন জায়গার নাম বলতে পারে না । আমিও জানি না ।
বাবা তো অনেক জায়গায় যান ।
বাবা নিশ্চয় ই খুব ভালো কোথাও নিয়ে যাবেন ।
স্কুল থেকে এসেই আমি আমার গত ঈদের জামাটা বের করি । খুব ভাল করে গোছল করি । আমার মেকআপ বক্সটা বের করি । এটা অবশ্য আমার না আম্মুর পুরনো একটা মেকাপ বক্স ।
তেমন কিছুই নেই । তবুও বক্সটার আয়নায় একটু নিজেকে দেখি । একটু পাউডার দেই ।
যাতে আব্বু কে শুনতে না হয় "এইটা আপনার মেয়ে?" । হঠাৎ মা ডাক দিয়ে বসেন ।"তমা একটু চা বসা তো ।"
"আসছি মা।" আমি তাড়া তাড়ি মুখটা মুছে চা বসাতে চলে যাই ।
চা নিয়ে আম্মুর কাছে গেলে আম্মু বলেন "মুখে কি দিয়েছিস?"
আমি একটু ভয় পেয়ে যাই । বলি "পাউডার তোমারটা দেই নি। পুরনো একটায় কিছু ছিল ঐটা দিয়েছি ।
"অ । এখন যা । টিভি দেখতে দে"
আমি আমার রুমে চলে আসি । হাফ ছেড়ে বাঁচি । ছোটবেলায় খুব মার খেয়েছিলাম । মার শাড়ি শুধু ধরেছিলাম বলে ।
এর পর থেকে মার কিছু আর ধরি নি । আমি বিকাল থেকেই ছটফট করছিলাম । কত দিন ঘুরতে যাই না ।দাদু শেষ একবার চিড়িয়াখানা নিয়ে গিয়েছিলেন ।
বার বার মুখ ধুচ্ছিলাম । চুল আচঁড়াচ্ছিলাম । দোয়া পড়ছিলাম ।
"আল্লাহ আমার এই জন্ম দিনটায় একটু আনন্দ দিও ।
আমি তো মার কথা শুনি ,ঘরের কাজ করি ,নামাজ পড়ি ,মিথ্যা বলি না । প্লিজ আল্লাহ । আমারে একটা দিন এক টু আনন্দ করতে দাও ।
কেক লাগবে না। ডলির জন্মদিনে তো কত মজা হল । কত ছবি তুলল । আমি কিছুই চাই না । শুধু বাবার সাথে একটু বেরুতে চাই। প্লিজ আল্লাহ । আমি এক শ রাকাত নফল নামাজ পড়ব। প্লিজ আল্লাহ । বাবার কাজ টা এক টু কমিয়ে দাও । প্লিজ আল্লাহ। "

বাবা সে দিন তাড়া তাড়ি আসেন নি । রাতে আসার পর ও তার মনে ছিল না আমার জন্মদিনের কথা ।
আমাকে সরি ও বলেন নি ।
আমি অবশ্য মন খারাপ করি নি । আল্লাহ নাকি সব দোয়া জমা করে রাখেন । আমিও অপেক্ষায় আছি ।

আজ আমার ২২ তম জন্মদিন । এখন রাত ১২ টা এক । এখন আর নিজের খুশির জন্য দোয়া করি না ।
এখন স্বপ্ন দেখি আমার একটা কালো মেয়ে হবে । ওর নাম রাখব আলো
ওকে আমি খুব ভালবাসব ।
ওর অনেক ছবি তুলব ।
ওর জন্মদিন করব ধুম ধাম করে ।
ওকে অনেক অনেক পুতুল কিনে দেব ।
ওকে একটু ও কষ্ট পেতে দেব না ।
ওর জন্য গান গাইব
"আলো আমার আলো ও গো আলোয় ভুবন ভরা..."
এই স্বপ্নটি নিশ্চয় ই পূরণ হবে । আমার অনেক দোয়া জমা আছে যে!

লেখকের কথা :
তমা মেয়েটির প্রতি তার মায়ের এই আচরণ অসম্ভব শোনালেও ঘটনাটি সত্য :(। আমি সেই মেয়েটিকে কখন ও দেখি নি । আমাদের পাড়ায় থাকত ওরা । মেয়েটির কথা আম্মু আর আমার ছোট বোন আমাকে বলেছিল । খুব কষ্ট লেগেছিল । লিখার সময় ও আমার খুব কষ্ট লেগেছে ।
প্রথম পুরুষে লেখাটা সব সময় মজার হয় না :(
ছবিটি আমার তোলা
সবাই কে ঈদ মোবারক । ঈদের আগে এমন একটা মন খারাপ করা পোস্ট দিলাম :( সরি :(
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ৯:০৫
৪৭টি মন্তব্য ৪৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×