ইতিহাস বিকৃ্তি করে কাউকে খুব বড় বা খুব ছোটো বানানো হলে আগেও যেমন লাভ হয়নি, এখনতো ডিজিটাল যুগে আরো অসম্ভব। বরং এসব যারা করে ,অবশ্যই তাদের কোনো ধরনের উদ্দেশ্য আছে।
যাই হোক আনন্দবাজার পত্রিকা গতকাল প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইশানুল করিমকে বরাত দিয়ে যে ইতিহাস ছাপিয়েছে,তা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাসই মিথ্যা হয়ে যাবে।
হাসিনা-অরূপ বৈঠক শেষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইশানুল করিম জানান, প্রধানমন্ত্রী হাসিনা মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বিমানবাহিনীর অবিস্মরণীয় ভূমিকার কথা আলোচনা করেছেন। আকাশপথে প্রবল আক্রমণ চালিয়ে ভারতীয় বিমানবাহিনী যেভাবে পাক সেনাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিল, হাসিনা তার প্রশংসা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাবা মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আত্মগোপন করে ছিলেন হাসিনারা। যুদ্ধের প্রায় শেষ দিকে পাকিস্তানের সেনার উপর ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক ভয়ঙ্কর আক্রমণের দৃশ্য গোপন আশ্রয় থেকে কীভাবে দেখেছিলেন বঙ্গুবন্ধু মুজিবুর, হাসিনা এবং গোটা পরিবার, সে কথাও উঠে আসে হাসিনা ও অরূপ রাহার আলোচনায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানাবে দিল্লি, ভারতীয় বায়ুসেনার প্রশংসায় হাসিনা
এই ইতিহাস পড়ে হাসবো ,না কাদবো? ছোটোবেলা থেকেই জেনে এসেছি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাক হানাদাররা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমণ্ডির বাসা থেকে বন্দী করে নিয়ে যায় ।আর ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।
যদি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে তার পরিবার আত্মগোপন করে থাকেন এবং পাকিস্তানের সেনার উপর ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক ভয়ঙ্কর আক্রমণের দৃশ্য গোপন আশ্রয় থেকে দেখে থাকেন ,তাহলেতো আওয়ামী লীগ যে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালন করে থাকে,তা মিথ্যা হয়ে যায়।
এবার আসি,সে সসময় ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর পরিবার কোথায় ছিলেন,সেটা জানি।নিচের অংশটুকু কায় কাউস ভাইএর সৌজন্যে।
"... একদিন মনজুর (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু - বন ও পরিবেশ মন্ত্রী) বাসা থেকে সমন এলো। আমি আল্লাহর নাম স্মরণ করে মনজুর বাসাতে পৌঁছে দেখি সেখানে জেনারেল ওমর বসে আছেন। জেনারেল ওমর বোধহয় তখন পাকিস্তানের আই.এস.আই'র প্রধান। সৌজন্য বিনিময়ের পর জেনারেল ওমর সরাসরি মূল বিষয়ে চলে আসেন। নিরাপদ আশ্রয়ের বিষয়ে দুইটি সম্ভাব্য স্থানের কথা উল্লেখ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো বড় শহর বা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কোনো বাসা। আমি ভাবীর (বেগম মুজিব) সাথে আলোচনা না করেই দুটো প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিলাম। জেনারেল ওমর তখন বল্লেন, "ঠিক আছে, আপনাদের পছন্দসই কোন বাড়ি দেখিয়ে দিন, সেখানেই আমরা ঠিক করে দেব। কিন্তু আমাদের প্রহরাধীনে থাকতে হবে। তা আপনারা কি কোনো বাড়ি দেখেছেন?"
"না, আমরা কোনো বাড়ি দেখিনি" আমি বল্লাম। "ঠিক আছে, চলুন আমার সঙ্গে কোন এলাকা আপনার পছন্দ সেখানেই যাব।" জেনারেল ওমরের কন্ঠস্বরের পরিবর্তন হয়েছে। কি করবো, বেশি বাড়াবাড়ি করলে হয়তো আমাকে ধরে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যাবে। আমি ধানমন্ডি এলাকাতেই বাড়ি খুঁজতে বেরুলাম জেনারেল ওমরের সঙ্গে। অনেকগুলো বাড়ি দেখার পর ১৮ নম্বর সড়কে একটা বাড়ি পছন্দ হলো। বাড়িটা একতলা, উঁচু বাউন্ডারি ওয়ালে ঘেরা, পেছনে বেশ জায়গা, সামনে সুন্দর গেট। জেনারেল ওমর বল্লেন, "কোই বাত নেই, হাম লে লেতে ইয়ে মাকান, তোম আভি যাকে তোমহারা ভাবী কো লেকে আও"। আমাকে ধানমন্ডিতে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি চলে গেল।
একরাশ দূর্ভাবনা নিয়ে বাসাতে ফিরে এলাম। কি কুক্ষণেই না ভাবীর নির্দেশে কামালের খোঁজে গিয়েছিলাম, তা না হলে তো এখনও নিশ্চিত থাকতে পারতাম। ভাবীকে সব বল্লাম। ভাবীর প্রথম মন্তব্য হলো, "তা হলে তো আমাদের এখানকার আস্তানা গুটিয়ে পালাতে হয়।" আমি বল্লাম, "আর কোথায় পালিয়ে যাব। তাছাড়া ওরা যখন টের পেয়েছে, পরে আমাদেরকে ধরতে পারলে অবস্থা আরো খারাপ হবে।" ভাবী বল্লেন, "আমি একবার মনজুর বাসাতে যাব, কিন্তু তার আগে তুই মইনুল ইসলাম ভাইর সঙ্গে দেখা করে আয়।" মইনুল ইসলাম মামু তখন থাকতেন শান্তিনগরে। তার বাসাতে গিয়ে তাকে সব কিছু খুলে বল্লাম। মামু আঁতকে উঠলেন, "সর্বনাশ, আরতো কোন উপায় নেই।" মামুর কাছ থেকে ফিরে সেদিনই ভাবীকে নিয়ে মনজুদের বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি জেনারেল ওমর বসে আছেন।
ভাবীকে দেখে যথারীতি সম্মান দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন - আমরা কি তক্ষুণি ১৮ নম্বর বাসাতে উঠছি কি না। ভাবী আমাকে বলতে বল্ল যে, আমরা সেই রাতে ৩২ নম্বর থেকে প্রায় এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছি। তাই আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আনতে ৩২ নম্বর বাসাতে যেতে হবে। জেনারেল ওমর বল্লেন, "ঠিক হ্যায়। মগর জলদি করনা।" বুঝতে পারলাম তিনি আমাদেরকে নতুন বাসায় নজরবন্দী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই ইসলামাবাদে ফিরতে চান। তারপর জেনারেল ওমরের গাড়ির সাথে সাথে আমি আর ভাবী ৩২ নম্বরে এসে পৌঁছলাম।
গোটা মার্চ মাস জুড়ে যে বাড়ি মুহুর্মুহু 'জয় বাংলা' ধ্বনিতে ধ্বনিতে আর বিজয়ের উল্লাসে মুখরিত থাকতো, সেই একই বাড়ি যেন পঁচিশে মার্চ রাতের বিভীষিকার স্বাক্ষর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নির্জন, নিথর পরিবেশ, সব কিছু তছনছ, ভেঙ্গেচুরে একাকার করা হয়েছে। এক দারুণ প্রতিহিংসার ছাপ রেখে জল্লাদ বাহিনী মিঞাভাইর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গৃহীত সমস্ত বাঁধানো ফটোগুলি চুরমার করে দিয়েছে। সারা ঘরব্যাপী কাচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। বেশ কিছু সময় ভাবী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। বোধহয় ভাবছিলেন কী নেব আমি, কি-ই-বা নেবার আছে। একটা ঘরে দু-তিনটা চেক বই দেখলাম। একটা মিঞাভাইর ইস্টার্ণ মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আমিন কোর্টের উল্টো দিকের শাখার চেক বই। ভাবী ওটা নিয়ে নিতে বল্লেন।
বাইরে এসে জেনারেল ওমরকে চেক বইটা দিয়ে বল্লাম, "এই ব্যাংকে হয় তো মিঞাভাইর কিছু টাকা আছে। আমাদের হাতে তো টাকা-পয়সা নেই, এই একাউন্ট থেকে কিছু টাকা উঠাতে হবে।আপনি শেখ সাহেবের কাছ থেকে একটা অথরিটি লেটার আনিয়ে দিন।" জেনারেল ওমর আমাকে অথরিটি লেটার বানাতে বলে চলে গেলেন।
ভাবীকে বাসায় নামিয়ে আমি বেরুলাম অথরিটি লেটার টাইপ করাতে। এমন অবস্থা চারদিকে - একটা চিঠি টাইপ করাবো তাও সহজসাধ্য ছিল না। ছুটলাম আবার সবার দৃষ্টি এড়িয়ে ইসলাম ভাইর (শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম) অফিসে। ইসলাম চেম্বারে তখন আবুল এহসান, মামু মইনুল ইসলাম, নূরুদীন ভাইর সঙ্গে রফিকুল্লাহ চৌধুরী বসতেন। তিনি আমার কাছ থেকে চেক বইটা নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই একটা অথরিটি লেটার টাইপ করিয়ে দিলেন। অথরিটি লেটার নিয়ে বাসায় পৌঁছে দেখি ভাবী বেঁকে বসেছেন, "না, আমরা ধরা দেব না, চল আমরা সবাই এখান থেকে পালাই। ভাডি, পারবি না আমাদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে।" ( আমি বল্লাম, "আপনার হুকুম শিরোধার্য, কিন্তু ভাবী আর একবার চিন্তা করে দেখুন।"
হাসিনা, ভাবী সবাই মিলে আলোচনা করলাম। দুপুরে খাবার টেবিলে বসে যখন একই কথা আবার বলছি সবাই, হঠাৎ দেখি দুটো জিপ ভর্তি পাক সেনাদল এসে বাসার চারপাশে পজিশন নিয়ে নিলো। তাদের কমান্ডার বোধ হয় মেজর র্যাঙ্কের একজন কর্মকর্তা, এসে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। কে কে থাকে এখানে, শেখ মুজিবের স্ত্রী কোথায়, তাকে আসতে বলুন। ভাবী, হাসিনা সবাই এলো। ওয়াজেদ ছিল কিনা এই মুহুর্তে আমার মনে পড়ছে না। মেজর বলতে শুরু করলো, "এভাবে থাকা আপনাদের পক্ষে নিরাপদ নয়, যে-কোন সময়ে দুষ্কৃতিকারীরা আপনাদের ওপর হামলা চালাতে পারে। । তাই আমরা অন্যত্র আপনাদের থাকার জায়গা ঠিক করেছি। এক্ষুণি আপনাদেরকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।"
আমাদের কোন গত্যন্তর নেই, মেজরের নির্দেশ মানতে হলো। প্রায় সেই অবস্থাতেই সবাইকে নিয়ে আমার গাড়িতে উঠি। আগে পিছে সামরিক বাহিনীর জিপ, এক সময়ে এসে থামি ধানমন্ডি এলাকার ১৮ নম্বর সড়কের সেই বাড়ির সামনে, যেটা আমি জেনারেল ওমরকে দেখিয়েছিলাম। আমরা এ বাসাতে প্রবেশের সাথে সাথে বাসায় মিলিটারি চৌকি বসে গেল। সঙ্গে আনতে পারিনি কিছুই। মেজরকে বলে আমি আবার মগবাজারের বাসায় এসে বিছানাপত্র ও কিছু জিনিসপত্র নিয়ে এলাম। কিন্তু রাতে খাবারের কোনো ব্যবস্থা করতে পারলাম না। হঠাৎ দেখি আমাদের এই নতুন বাসস্থানের উল্টো দিকে আমার সম্পর্কে নাতজামাই থাকেন। গোপালগঞ্জের নামী কন্ট্রাক্টর আলতাফ হোসেনের পুত্র। আমাদের পরিবারের বাচ্চাদের জন্য ওই বাসাতে গেলাম দুধ ও কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু নাতনী ফজু আমাকে দেখে খুশি হয়ে বাচ্চাদের খাবার ও চা-টা পাঠিয়ে দিল। আমার সঙ্গে সৈনিকদের দেখে নাতজামাই শঙ্কিত হলেন। রাতটা এভাবেই ফ্লোরের উপর শুয়ে কাটাতে হলো।
সকালে উঠে দেখি সামনের বাসা একদম খালি, কেউ নেই। "শেখ মুজিবের পরিবার সামনের বাসাতে থাকেন" - বাসা বদলানোর জন্য এর চাইতে জোরালো যুক্তি বোধহয় আর কিছু ছিল না তখন। বাসার বারান্দাতে দাঁড়িয়ে ভাবছি আরো কী রয়েছে সামনে, কে জানে। অন্তরীণ অবস্থা তো সবে শুরু হলো, কতদিন থাকতে হবে, আবার নতুন করে সংসার পাততে হবে, হাঁড়ি-পাতিল, প্লেট-গ্লাস সবকিছু আবার সংগ্রহ করতে হবে। সমস্ত চিন্তাশক্তি যেন শেষ। ॥"
- মমিনুল হক খোকা / অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জল : বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আমি॥ [ সাহিত্য প্রকাশ - আগস্ট, ২০০০ । পৃ: ১৫৯-১৬১]
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১১:৫৫