somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপসৃয়মান

২৯ শে জুন, ২০১৪ দুপুর ২:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গল্প ১/

জীবনে কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের সাথে সম্পর্কগুলোর কোন নাম নেই। আত্মীয় তো নয়ই এমনকি বন্ধু বলেও চালিয়ে দেয়া যায় না। অথচ তাদের উপস্থিতি সিংহভাগ সময় জানান দিতে থাকে। নাহ! মুর্ত নয় বরং বিমুর্ত তাদের উপস্থিতি। মুর্ত হলেই বরং নানা সমস্যা দেখা দেয়। একধরণের অনুভুতি হয় ভোতা নাকি সুতীক্ষ্ণ জানি না। কিছুদিন ধরেই আমি খেয়াল করছি বাইরে বের হলে আমার বাসায় যেতে ইচ্ছা করে না এবং বাসায় থাকলে বাইরে বেরুতে ইচ্ছা করে না। এবং ছাদেও যেতে ইচ্ছা করে না। ইদানিং পারতপক্ষে আমি বাসা থেকে বেরই হই না। সপ্তাহে দুদিন কলেজে যাই। এটুকুই। এই ইচ্ছে না লাগাটা অবশ্য বাসা থেকে বের হয়ে চৌ রাস্তার মোড় পর্যন্তই আর চৌ রাস্তার মোড থেকে বাসার গেইট পর্যন্তই। তবুও এই ইচ্ছে না লাগাটার মুখোমুখি হতে ইচ্ছা করে না। চৌ রাস্তার মোড় পার হওয়ার পর অবশ্য সবকিছু স্বাভাবিক। ফোন বাজছে।
- হ্যালো।
- কি হ্যালো কোথায় তুই?
- বেরুচ্ছি বাসা থেকে।
- এতক্ষণ লাগায় কেউ? কখন থেকে ওয়েট করছি।
- বেরুচ্ছি তো।
- তারাতারি বের হ। ক্যাফেতে চলে আয়। দেরী হলে বল আমি এই ফাঁকে একটা কাজ সেরে আসি।
- দেরী হবে।
- আচ্ছা।
রাগ করে ফোন রেখে দিয়েছে অনু। কথায় কথায় রাগ। গিয়ে দেখবো সে কোথাও যায়নি। চেহারায় রাগ ফুটিয়ে ক্যাফেতেই অপক্ষো করছে। আমি দ্রুত বেরুলাম। বাসার গেইট পার হয়েই শুরু হলো সেই নাম না জানা অনুভুতিটা। অনুভুতিটা আমাকে খুব যন্ত্রনা দিচ্ছে। গেট থেকে বেরুনো মাত্র বড় বড় কদমে একজন চলে আসবে জানি। ফোনফ্যাক্সের দোকানটার সামনে আমার সাথে দাড়াবে। তারও অবশ্য খুব তাড়া। ফোনফ্যাক্সের দোকানটার সামনে দাড়িয়ে পরিচিত রিকশাওয়াকে ফোন দিবো। এই সময়টায় সে কখনো বেশী দুরে থাকে না। দশ পনেরো মিনিটে চলে আসে। এই দশ পনেরো মিনিট একজোড়া চোখ আমার আশেপাশেই থাকে আমি জানি। একজোড়া গভীর বাদামী চোখ। আমি তার চোখের দিকে একবারই তাকিয়েছি অবশ্য। কয়েক সেকেন্ডের জন্য। আচ্ছা সেই চোখ কি কোন অনুভুতি ধারণ করে? তার সাথে কথা হয়না কখনো। আর হলেও খুব অল্প।

- কি ব্যাপার শান্তা, আজকে এত দেরী করে যাচ্ছেন কলেজে?
- হ্যাঁ। আজকে একটু লেট হয়ে গেল।
- ষোল মিনিট ঊনত্রিশ সেকেন্ড লেট হয়েছে।
- কি জানি!
- ভাববেন না আমি ঘড়ি ধরে বলেছি।
- অনুমান করে বলেছেন?
- নাহ! এমনি বলে দিয়েছি। মাথায় যেটা এসেছে।
- ও আচ্ছা।
- রাগ করলেন নাকি?
- রাগ করার কি আছে আশ্চর্য!

অনুর ফোন ধ্যান ভাঙলো আমার। কেটে দিলাম। আজকে সে কোথায়? আসেনি কেন? কেমন জানি খারাপ লাগতে থাকে আমার। ওদিকে অনুর রাগত চেহারাটা চোখে ভাসছে। রিকসাওয়ালাকে ফোন দিলাম।
আজকে বাসায় আসার সময়ও ফোনফ্যাক্সের দোকানের সামনে ইচ্ছে করেই আধাঘন্টা ওয়েট করেছি। উহু সে আসেনি। আজকে কেন জানি ছাদে যেতে ইচ্ছা করছে। অনেক আগে ছাদে লাগানো গোলাপের টবগুলো কেমন আছে কে জানে! আসলেই কি গোলাপের টবগুলো দেখতে যাচ্ছি? মাসখানেক পানি দেয়া হয়নি হয়তো মরে গেছে গাছগুলো। আসলে আমার মনে হচ্ছে হয়তো সে ছাদে আছে এখন। নাম কি তার? ও হ্যাঁ অর্ক। অর্কর চেহারা ছেলেমানুষী, চুলগুলো এলোমেলো আর চোখগুলো গভীর বাদামী। অর্ক সে, যার পিঠের ব্যাকপ্যাকে সবসময় গিটার থাকে। অর্ক সে, যে সবসময় হেয়ালী কথা বলবে হঠাৎ করেই উদাস উদাস ভাব ফুটে উঠবে অর্কদের চেহারায়।
ছাদে উঠলাম। কি আশ্চর্য টবে গোলাপের গাছগুলো সতেজ, গাড় সবুজ পাতা। ডালের ডগার কচি পাতাগুলো লালচে। বড় বড় তিনটা লাল ফুল ফুটে আছে গাছে। আমি টবগুলোর কাছে গেলাম।
অর্কদের বাসায় ছাদে অর্ক গিটার বাজাচ্ছে। সুন্দর কণ্ঠ তার। পাশে বসা একটি মেয়ে খুব হাত পা নেড়ে নেড়ে কথা বলছে। অর্ক কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে আর মাঝে মধ্যেই গিটারে একটা আওয়াজ করছে। আমি টের পেলাম ভিতরে একটা ঝড়ের। যে ঝড়ে কোন একটা কিছু উলটপালট হয়ে যায়। হাত দিয়ে গোলাপের কাটাওয়ালা ডালটা কখন ধরেছি জানি না। গোলাপের কাটা এত তীক্ষ্ণ হয় কেন কে জানে!



গল্প ২/

ব্যয়বহুল প্রাইভেট ক্লিনিক গুলো ঝকঝকে তকতকে হয়। এয়ার ফ্রেশনার দিয়ে অসুস্থ পরিবেশটাকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করা হয়। বাথরুমগুলোতেও ফিনাইলের গন্ধ থাকে না। চারিদিকে একটা হোটেল হোটেল পরিবেশ থাকে। হয়তো ইচ্ছা করেই করা হয়! বড়সড় ওয়েটিং রুমটায় শুধু ছয়জন বসে আছে। সবার হাতে প্লাস্টিকের সিরিয়াল কার্ড। আমার হাতের কার্ডটার নাম্বার চব্বিশ। সাদা প্লাস্টিকের উপর লাল অক্ষরে লেখা চব্বিশ। মনে পড়ে গেল ক্লাশ এইটের কথা। ২য় সাময়িক পরীক্ষায় অঙ্কতে চব্বিশ পেয়েছিলাম। সাদা প্রোগ্রেস রিপোর্টটায় অঙ্কের ঘরে লাল কালি দিয়ে লিখা ছিল চব্বিশ। বাসায় ফিরছিলাম আর প্রতিবার প্রোগ্রেস রিপোর্টে তাকানোর সাথে সাথে বুক ধ্বক ধ্বক করছিল। তবে এখন আর বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে না। চব্বিশ নাম্বার রুগী হিসেবে বসে আছি। চব্বিশ সিরিয়াল যখন আসবে সামনে একটা বড় মনিটরে লেখা উঠবে চব্বিশ। আশেপাশে তাকালাম। পাশে অল্পবয়েসী একটা মেয়ে পাংশু মুখে বসে আছে। সাথে কঠিন চেহারার এক মহিলা। মহিলার মুখের কাঠিন্য আর্দ্র হয়ে আসা চোখকে লুকাতে পারছে না। মেয়েটার বয়স খুব বেশী হলে তেরো চৌদ্দ হবে। নির্ঘাত রেইপের শিকার মেয়েটা। নাহলে এত অল্প বয়সে এবরশান করাতে আসবে কেন! এই ওয়েটিং রুমে শুধু মেয়েরা বসে আছে। অপেক্ষা করছে নিজের ভেতরে জন্মানো আরেকটি প্রাণকে হত্যা করার জন্যে। কেউ ওই অল্পবয়েসী মেয়েটির মতো পাংশু মুখে, কেউ বা সবার কোণায় বসা কালো মেয়েটির মতো কাঁদতে কাঁদতে। কেউ বা আমার মতো ভাবলেশহীণ মুখে। পেটে হাত রাখলাম। রিফাতের একটা অংশকে নিজের ভিতর বড় করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। মনে হচ্ছে আমি এবরশান করাতে আসিনি মনে হচ্ছে পেটের ভেতরের একটা বিষাক্ত টিউমারকে ফেলে দিতে এসেছি। কিন্তু এখন কেন জানি ভেতরে জন্ম নেয়া প্রাণটার জন্যে মমতা বোধ করছি। ওর অস্তিত্বে কেবল রিফাতের নয় আমারো সমপরিমাণ অংশ আছে। তেইশ নাম্বার সিরিয়ালের মেয়েটিকে স্ট্রেচারে করে কোথাও নেয়া হচ্ছে। মনিটরের দিকে তাকালাম। মনিটরে ভেসে উঠলো টুয়েন্টিফোর।
চারিদিকে সবকিছু অপরিচিত ঠেকলো হঠাৎ করে কেন জানি। তবে আমি স্বাভাবিক ভাবে উঠে দাড়ালাম। পাশের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দিই। মেয়েটির মুখের পাংশু ভাব কমে না গিয়ে যেন বেড়ে যায় হঠাৎ করে। ও দিকে আর তাকালাম না। সামনে তকালাম। প্রতিটা কদমে আমি ডাক্তারের কেবিনে যাচ্ছি আর কিছু একটা অনুভব করতে পারছি। কি সেটা? ভেতরে জন্ম নেয়া ভ্রুণটির বয়স পাঁচ সপ্তাহ। এই পাঁচটি সপ্তাহ যা অনুভব করিনি এখন এই পাঁচ মিনিটে কেন করতে পারছি? লম্বা একটা টেবিলে শুয়ে পড়ার আগমুহুর্তে মনে হলো চিৎকার করে সবকিছুকে না করে দিতে। কিন্তু বাধ্য মেয়ের মতো শুয়ে পড়লাম। গভীত মমত্ববোধ জেগে উঠলো কেন জানি! আমি জানি অনুভুতির জন্মই হয় রূপ পাল্টাতে। মমত্বের অনুভুতি কিছুক্ষণ পরেই গভীর অপরাধ বোধে পরিবর্তিত হবে। আমি চোখ বন্ধ করলাম। চোখ থেকে শুধু একফোঁটা জল বেয়ে পড়লো কেন জানি। যেই জল অতি পবিত্র। সন্তানের জন্যে গভীর মমতা মাখানো জল। অপবিত্র আমি ওই জল স্পর্ষ করেনি সাহস হয়নি!



( পরীক্ষার মাঝখানে লিখার চেষ্টা করেছিলাম। ফলাফল অসম্পূর্ন দুটো গল্প। আমার জীবনের অনেক কিছুর মতো এই দুটোও অসম্পুর্ণই থেকে যাক না হয়... )
২৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×