somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাহবুব কবিরের ফুলচাষি মালি যাই বলো

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৩:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লিপ্তি ও নির্লিপ্তির টানাপোড়েন
ফিরোজ এহতেশাম


মাহবুব কবিরের বলার ভঙ্গিটা খুব সাধারণ, ক্যাজুয়াল। তিনি তাঁর কবিতায় মেকি কোন কাব্যিক ভঙ্গি আরোপ করেন না, শব্দ আর ছন্দ নিয়ে খেলা করেন না। তাঁর কবিতা বক্তব্য প্রধান। ফুলচাষি মালি যাই বলো বইটির কবিতাগুলিও এর ব্যতিক্রম নয়। যেকোনো বিষয় এমন সহজ, স্বাভাবিকভাবে শুরু করেন, যেন তিনি কবিতা লিখছেন না ঘরোয়া কোনো আড্ডায় কথা বলছেন। কিন্তু যখন বলা শেষ করেন তখন আমরা বুঝে উঠি, কোনো এক কলা ও কৌশলে আমাদের অজান্তেই তা কবিতা হয়ে উঠেছে। এবং এটাই তাঁর শক্তি। অর্থাৎ কবির অর্ন্তজগতে শিল্পের এমন এক ছাঁকনি বসানো আছে, যার মধ্য দিয়ে যা-ই তিনি গ্রহণ করেন না কেন, তা-ই বর্জ্য পদার্থ ব্যতিরেকে বেরিয়ে আসে শিল্পরূপে।

আমরা সাধারণত বাস্তব ক্ষেত্রে যে পক্রিয়ায় ভাবতে কিংবা দেখতে অভ্যস্ত, মাহবুব কবির থেকে-থেকেই সেইসব প্রতিষ্ঠিত ও স্বতঃসিদ্ধ মনে হতে থাকা ভাবনা ও দর্শনপ্রক্রিয়ার যুক্তিশৃঙ্খলকে ভেঙে ফেলেন এবংআবার এমনভাবে জোড়া দেন, যেন তা ভিন্নমাত্রার নতুন কোন বন্ধনের জন্ম দেয়। এক্ষেত্রে তাঁর কাব্য-পরিবেশ একটি লণীয় বিষয়। যেমন ‘ডোবা’ কবিতার দিকে ল্য করা যাক- ‘ঘরের পাশে ছোট্ট ডোবা।/ গেল বর্ষায় আমার হারিয়ে যাওয়া চোখ ভেবে/ কুড়াতে গিয়ে দেখি-ডোবাজুড়ে আমারই টোটেম,/ অজস্র তিতপুঁটি-/ তাদের পুচ্ছে, পিঠে, কানকোর কাছে তীর-ধনুক আঁকা।/ এই শীতে তিতপুঁটিগুলো ডোবাজুড়ে ঘাসলতাপাতা/ হয়ে যায়।/ আমি ঘাসফুল হাতে নিয়ে দেখি-/ এটা আমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া নাকফুল।’

তিনি রোমান্টিকতাকে আঘাত করেন তীব্রভাবে। কবিদের রোমান্টিক বিষয়ের আধার যে ‘চাঁদ’ তাকে নিয়ে ‘কে প্রথম’ কবিতায় তিনি লেখেন, ‘কে প্রথম চাঁদেও মাটিতে হিসু করেছে?/ কে প্রথম?/ কে?’ আবার ‘রোমান্টিক বিষয়ে খসড়া’ কবিতায় স্বপ্নবর্ণনার পর কবি লেখেন, ‘এটুকু শুনে এক পাগল আমাকে বলে,/ স্বপ্নগুলো বেশ রোমান্টিক আর/ ঘুমের মধ্যে মরে যাওয়া আরো গভীর রোমান্টিক ব্যাপার।’

তিনি হঠাৎ হঠাৎ অনুসিদ্ধান্তের মতো কিছু বাক্য বলেন, যেমন- ‘লোকাল বাস একটি সমকাম বিদ্যালয়’ (গন্তব্য), ‘ঘুমের মধ্যে মরে যাওয়া দারুণ ব্যাপার’ (রোমান্টিক বিষয়ে খসড়া), ‘মানুষ ও জন্তুর শীৎকার একই’ (পাকা ধানে মই) এ রকম আরো উদাহরণ দেওয়া যায়।

কবিতায় বস্তু, উদ্ভিদ কিংবা প্রাণিজগতের উপর ব্যক্তিত্ব আরোপ করেন তিনি। অন্যভাবে বলা যায়, এদের সঙ্গে তিনি একাত্ম হয়ে যান। এদের চোখ দিয়ে দেখতে থাকেন জগতে ঘটে যাওয়া নানা দৃশ্য, অসংগতি এমনকি নিজেকেও। এ যেন অন্যেও চোখে আত্মদর্শন। ‘পাকা ধানে মই’ কবিতায় ওঝা তার শিষ্য-সহযোগে ভূত তাড়াচ্ছে হিস্টিরিয়া-আক্রান্ত এক মেয়ের, ভরাট যৌবনের প্রতীকরূপে যার অঙ্গজুড়ে পাকা ধান। আর মেয়েটি -থাবা থেকে শিকার ছুটে যাওয়া হিংস্র জন্তুর মতো- রাগে গরগর করছে। এই দৃশ্য, কবির জবানে- ‘আমি বাস্তুসাপ সিলিং থেকে দেখছি-/ পালানোর পথ পাচ্ছে না চাঁড়াল ভূত,/ তারা তাকে ঠেসে গিলাচ্ছে ওঝার মুত।/ আমি টিকটিকি দেয়াল থেকে দেখছি।’

এই কবি পরিবেশবাদী, ‘সবুজ সন্ত্রাসী’। তাঁর মধ্যে একই সঙ্গে জেগে থাকে বিলুপ্তপ্রায় সবুজের জন্য হাহাকার আর আশাবাদ। ‘গাছভাই’ কবিতায় একটি গাছ রাস্তা ক্রস করে কবির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আসে, চা খেতে খেতে গল্প জুড়ে দেয়। বৃবিহীন দেশে গাছভাইকে পেয়ে কবি ও চা-ওয়ালা দুজনেই খুশি। কিন্তু একটু পরেই পুলিশ এসে গাছভাইকে টেনেহিঁছড়ে গাড়িতে তুলতে থাকে। কবি আর্তনাদ করে ওঠেন, ‘কী করেন, কী করেন!/ পুলিশ খেঁকিয়ে ওঠে,/ শালা সবুজ সন্ত্রাসী।/ একটু আগে মরুমন্ত্রীর বাসায়# সবুজের দাবীতে /হামলা চালিয়েছে সে।/ আমি থ। অসহায় তাকিয়ে থাকলাম।/ পুলিশের গাড়ি সাঁই করে চলে যায়।’ এটি একটি স্বপ্নদৃশ্য। ঘুম ভেঙে গেলে কবি বলছেন তাঁর বউকে, ‘বলি গাছভাইয়ের জন্য মন খারাপ লাগছে।/ চা হাতে বউ হাসে, তুমি একটা পাগল।’ কবির বউয়ের এই প্রশ্রয়পূর্ণ হাসির পর পাঠকের মধ্যে যেন আরো গভীরভাবে সংক্রমিত হয় কবির সেই মন খারাপ লাগাটা।

উদ্ভিদ কিংবা প্রাণিজগতের প্রতি তাঁর মতো এমন আত্মলীন হয়ে, এত মনোযোগ আর মমতা নিয়ে তাকানোর ভঙ্গিটি বাংলা কবিতায় বিরল।
মাঝে মাঝে মনে হতে পারে, এই কবিকে বহির্জগতের কোনো কিছুই স্পর্শ করছে না; খুবই অন্তর্মূখী তিনি, নিলির্প্ত। অথচ পরণেই সচকিত হয়ে উঠবেন পাঠক তাঁর বিদ্রুপের চাবুকের আঘাতে, সচেতন বহির্মুখিতায়। আর এভাবেই তাঁর কাব্যজগতের মধ্যে চলতে থাকে লিপ্তি আর নিলির্প্তিও টানাপোড়েন।

তাঁর কবিতায় উইট যেমন আছে, আছে স্যাটায়ারও। কিন্তু কোনোটাই তেমন প্রকটিত নয়। এসব তাঁর ক্যাজুয়াল ভঙ্গিও আড়ালে অন্তঃপ্রবাহের মতো বয়ে চলে। কিন্তু যে রসিক সে ঠিকই আস্বাদন করে নেয় সেই রস, এই ক্যামোফেজ, অনেকটা রাজহাঁসের মতো- যে রাজহাঁস দুধমিশ্রিত পানি থেকে দুধটুকু তুলে নিতে জানে।

আসলে, যদি একটি ফলের বর্ণনা দেওয়া হয়, আপনি হয়তো তার আকৃতি, রং, রূপ, রেখা, সৌন্দর্য প্রভৃতি কল্পনা করতে পারবেন, কিন্তু তার স্বাদটি আপনার কাছে অনাস্বাদিতই থেকে যাবে, যতণ পর্যন্ত না আপনি সেই ফলটি খেয়ে দেখছেন। কবিতার ক্ষেত্রেও ঠিক তা-ই। তাই পাঠক, মাহবুব কবিরের একটি পুরো কবিতাই, নাম ‘গন্তব্য’ আপনাদের সামনে পরিবেশন করি- ‘করুণ ভ্যাবাচ্যাকা মার্কা, এক চোখ কানা, বেশ ক’টি দাঁত ভাঙা,/ কান কাটা, থ্যাবড়ানো নাক,/ ফুটবলের ফুটো ব্লাডারের মতো চুপসে যাওয়া গাল./ হাড় জিরজিরে,/ ধুলোবালি-কালিতে কিম্ভূতকিমাকার./ চূর্ণ বিচূর্ণ কশেরু ঝালা-জোড়া দেওয়া./ নিজের নাম এবং বাপ-দাদার নাম ভুলে যাওয়া,/ য়রোগী একটি বাসের টেপে কসরত কৌশলে ঢুকে গেলাম।/সে আমাকে পৌঁছে দেবে গন্তব্যে!/লোকাল বাস একটি সমকাম বিদ্যালয়।’

ফুলচাষি মালি যাই বলো : মাহবুব কবির; ফেব্র“য়ারি ২০০৯, অ্যডর্ন, ঢাকা; প্রচ্ছদ : শাহীনুর রহমান; পৃষ্ঠাসংখ্যা : ৪৮ মূল্য : ৬৫ টাকা

এই লেখাটি দৈনিক প্রথম আলোয় ৫ জুন ২০০৯ ইং তারিখে প্রকাশিত হয়। লেখাটি পূনমুদ্রণ করা হলো।
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নেতানিয়াহুও গনহত্যার দায়ে ঘৃণিত নায়ক হিসাবেই ইতিহাসে স্থান করে নিবে

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:৩৮

গত উইকেন্ডে খোদ ইজরাইলে হাজার হাজার ইজরাইলি জনতা নেতানিয়াহুর সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে।
দেখুন, https://www.youtube.com/shorts/HlFc6IxFeRA
ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে নেতানিয়াহুর এই হত্যাযজ্ঞ ইজরায়েলকে কতটা নিরাপদ করবে জনসাধারণ আজ সন্দিহান। বরং এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×