somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শূন্য দশকের ৫ টি কবিতার বই তানভীর আশিক

২৪ শে জানুয়ারি, ২০১০ দুপুর ১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
ঘুম এক নিঃশর্ত প্রেমের দেশ : মাদল হাসান

প্রকাশক: সমুত্থান
প্রকাশ কাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৬
প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান

এটি কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থটির ৫০ টি কাব্যে তাঁর যাপিত জীবনের সাবলিল গৃহস্থলি ভাবনা-চিন্তা থেকে কবিতা তুলে আনার প্রয়াস দেখিয়েছেন কবি। কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘সুচ’ এ নিজেকে তুলে ধরেছেন-
“খড়ের গাদায় হারানো আমি এক সূক্ষ্ম সোনামুখী সুচ
পবিত্র পাঠক তুমি আমাকে খুঁজে নাও” (সুচ, ঘুম এক নিঃশর্ত প্রেমের দেশ/ মাদল হাসান)

বস্তুত তাঁর কবিতায় সরল শব্দ গাঁথুনিতে সরল জীবনের সরল চিন্তাই খুঁজে পাই; কোমল ও মোলায়েম তাঁর কাব্য ভাষা। কোথাও রূঢ়তা নেই, বেদনা বোধ নেই। কবিতায় নিছক ভাবের প্রকাশ -
“মাঝরাতে একট্রেন মৃত্যু এসে দাঁড়ায় স্টেশনে
ধোঁয়ার নিঃশ্বাস ছাড়ে
আমি সেই ট্রেনের ছাদের থেকে শিস দিয়ে উঠি
রাত-কোকিলের মতো। ” (বার্ধক্য, ঘুম এক নিঃশর্ত প্রেমের দেশ/ মাদল হাসান)
‘শামুকযাত্রা’ কবি মাদল হাসানের এই কাব্যগ্রন্থের চমৎকার একটি কবিতা।
“দূষিত সমুদ্র ছেড়ে অভয়সমুদ্রে যাচ্ছে শত শত বিপন্ন শামুক
পাড়ি দেবে বিপদসংকুল মহদেশ, পথ চিনে চিনে লবণ জলের গন্ধে
যেতে হবে শান্ত, ধীর ছন্দে-
তাদের প্রার্থনা-সারাপথে তুমুল বৃষ্টি নামুক!” (শামুকযাত্রা, ঘুম এক নিঃশর্ত প্রেমের দেশ/ মাদল হাসান)

জীবনানন্দ দাশ ও বিনয় মজুমদারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় কখনো কখনো কয়েকটি ছত্র:
যেমন:
‘মনে রেখো - তাঁর সোনালি পালক মাথার দু’পাশে গুঁজে নিলে
তবেই যেতে পারবে নিঃশর্ত প্রেমের দেশে”-
সমুদ্র-ঘুঘুরা একস্বরে মিলে
এইসব বলেছিল হেসে হেসে।’ (ঘুম এক নিঃশর্ত প্রেমের দেশ, ঘুম এক নিঃশর্ত প্রেমের দেশ/ মাদল হাসান)
“--- আমলকী মূলত বিস্বাদ কিন্তু খাওয়ার একটু পরে পানি খেলে মিষ্টি লাগে।” (আমলকী, ঘুম এক নিঃশর্ত প্রেমের দেশ/ মাদল হাসান)

‘বাঁশিঅলা’, ‘চাঁদের বুড়ির পান চুরির গল্প’, ‘আঙুর’ ইত্যাদি কবিতায় তিনি রূপকথার গল্পগুলোকে বেস করে দাঁড় করিয়েছেন তাঁর চিন্তা।
‘আঙুর’ কবিতায় ‘মেয়ে’দের যেভাবে দেখতে চান বলে তিনি জানিয়েছেন ঠিক বিপরীত ভাবনা ধরা পড়ে-
‘পুড়িয়েছি স্মারক-রুমাল’ আর ‘ফসল তোলার গান’ কাব্যে।

কবি মাদল হাসানের কিছু কবিতা বেশ ভালো কিন্তু ‘জালালী কবুতর’, ‘মহাখ্যান’, ‘আগুন’, ‘কে দেয় আনন্দ তবে কে দেয় বিষাদ’ ইত্যাদি কবিতা দারুনভাবে হতাশ করে। কবির আরো গভীর বোধ ও শিল্পিত কবিতা আশা করি।


নিদ্রাসমগ্র : জাহানারা পারভীন

প্রকাশক: সময়
প্রকাশ কাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৫
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ


স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের কথা কবি জাহানারা পারভীন তুলে ধরেন তাঁর ‘নিদ্রাসমগ্র’-এ। আমরাও পাঠ নেই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতায় ব্যর্থতার আর অনুতাপের সুর:
‘দিঘি থেকে আমার শ্যাওলা তুলে আনার কথা ছিল
আমি তা আনতে পারিনি।
সেই অনুতাপ এখনো বিন্দু বিন্দু ঘাম হয়ে ফুটে আছে ত্বকে।’ (দিঘিকাব্য, নিদ্রাসমগ্র, জাহানারা পারভীন)
প্রতিটি ব্যর্থতা জন্ম দিতে পারে নতুন উদ্যেগ। আর সেই নতুন কণ্ঠই শুনি কবির কণ্ঠে-
‘আমি পুরাতন কুয়োর জলে সঁপে দিয়েছি অনিদ্রার সব পাথর’ (নিদ্রানামা, নিদ্রাসমগ্র, জাহানারা পারভীন)।

বর্তমান পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতি কবির ক্ষোভ ধরা পড়ে। কোথাও পারিবারিক দ্বন্দ্বকেও কবিতায় তুলে আনেন।
‘পিতৃতান্ত্রিক মেঝেতে বসে আমাদের মায়েরা সবজির ছলে কাটেন নিজেদের আয়ু ...’ (পারিবারিক, নিদ্রাসমগ্র, জাহানারা পারভীন)।
‘বেহুলাকথন’ ও ‘কাজলরেখা’ কবিতায় তুলে আনতে চেয়েছেন নারীর বিপরীতে নারীর প্রতি পুরুষের আচরণ। কখনো কখনো তুলেছেন সময়ের প্রয়োজনীয় বিনীত স্বর, চেয়েছেন অসময়ের ক্ষত নিরাময়ের ঔষধ।
‘.... আহত শালিকের ভাঙা ডানা ফেরি করে বেড়ায়
নিঃস্বার্থ কবিরাজ, ওষধি গাছেরা আজ অনশনে যাবে।

আজ তাই মলম চাই, চাই সুখী মানুষের জামা।’ (সুখী মানুষের জামা, নিদ্রাসমগ্র, জাহানারা পারভীন)।
খুব বেশি মোহিত করে ‘সেই থেকে খোলা রাখি গুড়ের বয়াম’ কবিতার কয়েকটি লাইন-
‘তখন আকাশে মৃত জ্যোৎস্নার শোক, বাতসের ঘায়ে
অজস্র পাকাবেল ঝরে পড়ে টিনের চালে, সে কী বিকট শব্দ
সমবেত পায়ের আওয়াজে কেঁপে উঠছিল পাড়া। কারো
কিছুই করার ছিলো না, একদল পিঁপড়ে শুধু পা বেয়ে
উঠে গিয়েছিল রাজাকারের শিশ্নে।’

কিছু কিছু কাজ যেমন খুব অসাধারণ মনে হয়েছে। তেমনি কোথাও কোথাও পেয়েছি ভাষা ও ভাবের পতন। যেমন-
‘ডালিমের দানার মতো মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে
কাঁকড়া মন শুষে নেয় স্যাভলনের ঘ্রাণ।’ (গাবফুলের গ্রাম, নিদ্রাসমগ্র, জাহানারা পারভীন)।
ডালিমের দানার উপমার পর স্যাভলনের ঘ্রাণ আমার অস্বস্ত লেগেছে।
‘কোনো কোনো ক্ষমা পাপের চেয়েও দীর্ঘ’ কবিতার শুরু থেকে বিস্তার অসাধারণ লাগে আমার। মুগ্ধতায় বুদ হতে হতে হতাশ হই শেষ লাইনে।
আপস মেনে নেয়া যায় না।
‘পরাজিত উইয়েরা কেটেছে গ্রন্থের প্রতিটি অক্ষর,
আমরা তাদের সঙ্গে বসে চা কফি খাচ্ছি.....’ (কোনো কোনো ক্ষমা পাপের চেয়েও দীর্ঘ, নিদ্রাসমগ্র, জাহানারা পারভীন)।
জাহানারা পারভীন ‘প্রস্থানের আগে’ কবিতায় নেন রুখে দাঁড়ানোর পাঠ: ‘আর কোন পতনের গল্প নয়, এবার শুধু রোদের প্রসঙ্গ/ দীর্ঘশ্বাসকে ঝাটা বানিয়ে ঝাড়– দেব পৈত্রিক ভিটে,’ অথচ ‘অপনা মাঁসে হরিণা বৈরি’ কবিতায় তিনি আপসের সুরে বলেন, ‘সেদ্ধ ডিমের কুসুম হয়ে বসে আছি প্লেটে’।

কবিতার দুঃসময়ে কবি জাহানারা পারভীনের ‘নিদ্রাসমগ্র’ থেকে পেয়েছি চিন্তার খোরাক। কিছু অসাধারণ শব্দগুচ্ছ বোধ হয়ে করেছে বিনোদিত। তাঁর পরবর্তী কাজ আমাদের কতটুকু দগ্ধ করতে পারে, আছি তার অপেক্ষায়।

শাদা প্রজাপতি : এহসান হাবীব

প্রকাশক: পাঁচিল
প্রকাশ কাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৯
প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান


‘শাদা প্রজাপতি’ ইচ্ছে হলেই সাজানো যায় যেমন খুশি তেমন রঙে। কবি এহসান হাবীবের ‘শাদা প্রজাপতি’ মূলতঃ শাদা নয়, পাঠেই নিয়ে নেয় একেক রং। দৃশ্যতঃ শাদা প্রজাপতিটিই কবির গভীর ভাবে হয়ে ওঠে বিচিত্র রঙের ধারক। কোন কোন প্রজাপতি উঠে আসে নীল হয়ে বিষাদে, কোনটি গোলাপি হয়ে ওঠে প্রেমে, কোনটি হলুদ ডেকে আনে নিঝুম বৈরাগ, কোনটি লাল ক্ষোভে। আবার কোনটি আদতেই শাদা বর্ণহীনতায়। একচল্লিশটি কবিতা সাজানো হয়েছে তিনটি পর্বে। প্রতিটি পর্বের রয়েছে পূর্বপাঠ। প্রথম কবিতা প্রদর্শনীতেই কবি দেখিয়ে দেন নতুন মাত্রা: পাঠ করো ভিন্ন স্বরে-
‘দাড়ি কেটে কেটে লুকিয়ে ফেলি শাদা সময়
দাড়ি কেটে কেটে নিজেকে লুকাই।’ (প্রদর্শনী, শাদা প্রজাপতি, এহসান হাবীব)
পাঠ করি ‘অন্ধকার’ কবিতাটি। মনে হলো আমাদের চারপাশের অন্ধকারের কথা, আমরাও কী অন্ধকারে ডুবে নেই মেকী ভালোর ভনিতার নীচে? অথচ অন্ধকার ভালোবেসে সাধু বসে আছে হাতড়ালে ছুঁতে পারে পৃথিবীর মুখ। এরকম অদ্ভুত দ্বিমুখিতায় আমার মনে হয় কবি অন্ধকারকে নতুনভাবে দেখতে শেখান।

‘অন্ধকারে কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না
এককাঠি চুরুট, একবাক্স দিয়াশলাই
শিশ্নের অগ্রভাগ, প্রিয় নাম, মুখ!’ (অন্ধকার ১, শাদা প্রজাপতি, এহসান হাবীব)

‘আলো তো রঙের বাহার: মুখোশের কারসাজি,
নিয়েছি নকলের অমিত প্ররোচনা...’ (অন্ধকার ৩: শাদা প্রজাপতি, এহসান হাবীব)

কবি দ্রোহে ও সাহসে সমাজের গলিত রূপে থুথু ছিটিয়ে দিয়েছেন। কখনো টেনে ছিঁড়েছেন কুৎসিতের সুন্দর মুখোশ। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে তোয়াক্কা না করার অমিত সাহসের উচ্চারণ পাই তাঁর কবিতায়। যেমন:
‘হৃদগভীরে ঘাইমারা অনুভূতিগুলো’ কবিতায়-
‘.....তখন কী করে বুঝাই
অর্ধ-শিতি অধ্যাপিকার বকবকানি শুনার চেয়ে ছাত্রী হস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে টাঙ্কি মারা কত পুণ্যময় আর রিয়েলিস্টিক।

বাৎসায়ন জেনেছি আমি জনমের দোষে তাই থোড়াই কেয়ার ঐ অধ্যাপিকা-
গুরুজনে ভক্তি নেই, চোখ বিঁধে আছে সহপাঠিনীর স্তনে।’


‘শীত’ কবিতায় ধারণ করে আছেন শুদ্ধ প্রেমিকের সত্য বয়ান: ‘অথচ কাল সকালে তোমার গোসল হবে ভেবে/ আজ রাতে ভয়ানক কেঁপে উঠেছি বেদনার শীতে।’
‘কাচখণ্ড’, ‘বিরূপাক্ষ’, ‘শিকার’ কবিতাগুলোর ভাব আমাদের বহুমাত্রিক চিন্তার যোগান। প্রথম পর্বের কবিতাগুলোতে দ্রোহ, দ্বিতীয় পর্বের কবিতাগুলোতে প্রেম আর যাপিত জীবনের গভীর ভাবএবং তৃতীয় পর্বের কবিতাগুলোতে সিদ্ধান্ত অথবা জীবন দর্শন উঠে এসেছে।
‘অর্ধেক সময় বাজী রেখে যে টেবিলে দাঁড়িয়ে আছি
অসমাপ্ত খেলার মোহে; শাদা আর কালোদের বধে
আমরা ছিলাম নিস্ক্রিয় তথাপি পকেট শূন্য করেই ফিরতে হলো।

আমাদের ক্যাসিনো নেই ক্যারমই জীবন।’ (ক্যারম জীবন, শাদা প্রজাপতি, এহসান হাবীব)


ভিন্ন আঙ্গিকের বিচিত্র ভাবনার এই কাব্যগ্রন্থটিকে আমার অসাধারণ মনে হয়েছে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ হিসেবে। তরুণ কবির কণ্ঠের জোর কবিতার দুঃসময়ে আশার বাণী শোনায়। ভাষা প্রকাশে তাঁর সাহসিকতা, ভাবনার মৌলিকত্ব এই দশকে তাঁর অবস্থান মূল্যায়নে যথেষ্ট এগিয়ে।
কবি এহসান হাবীবের শুদ্ধ স্বর কতটুকু শুদ্ধতা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে তা দেখার প্রতীক্ষায়।

লখিন্দরের গান : কাজী নাসির মামুন

প্রকাশক: লোক
প্রকাশ কাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৬
প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান



একজন কবি হয়ে ওঠার প্রস্তুতির ঘ্রাণ, পরিপক্ক হয়ে ওঠা মেধার শিল্পিত রূপ ‘লখিন্দরের গান’। কবিতা ধরা দেয়া কবি যে কবি কাজী নাসির মামুন নন; বরং চিন্তা ও চেতনের কর্ষণে মেধার সর্বোচ্চ প্রয়োগে কবিতাকে তিনি রূপ দিয়েছেন তা সহজেই অনুধাবন করা যায় ‘লখিন্দরের গান’
পাঠে। চৌত্রিশটি কবিতার গ্রন্থ ‘লখিন্দরের গান’ খুলে পাঠ নেই প্রথম কবিতা ‘পরম্পরা’র।
‘যতটুকু ফেরা যায় সবটুকু রোদের গরিমা
কপালে মেখেছি। আজ শ্রমের অধিক
আলস্য মোড়ানো হাঁটা। চর্চিত পুঁথির পাতা
গলার মাদুলি।’

আমাদের লোকজ মিথ আর অনুভূতিগুলোর উপর ভর করে তিনি সাজিয়েছেন শব্দ, তৈরি করেছেন ভাবের ঘোর, হয়ে উঠেছে কবিতা।
‘চন্দ্রনাভিতে মুখ গুঁজে কখনো একটি কালো সাপ
কলঙ্কের মতো ফুঁসে ওঠে। ফণা দোলায়।
সেই সাপ ধরে ফেলতে ওঝার চাতুর্যে জেগে ওঠে
হরপ্পা-সমাজ।’ (মিয়াবাড়ির বৈঠকখানায় যজ্ঞবুড়ির গালগল্প, লখিন্দরের গান, কাজী নাসির মামুন)

কাজী নাসির মামুন মূলতঃ বাংলাদেশের মানুষের লোকাচার, পুঁথি সাহিত্যের চরিত্রগুলোকে কেন্দ্র করে সাজিয়েছেন তাঁর নিজস্ব কবিতার ঢং। তাঁর কবিতায় যেমন এসেছে দেব-দেবীর কথা তেমনি এসেছে মাওলানা ও কোরআনের কথা। তিনি মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে ছিনিয়ে এনছেন আমাদের অতীত সভ্যতা। তাঁর কবিতা যেন প্রতœতাত্ত্বিক শিল্প।
‘সাদা চুল। কালো চুল। সাদাকালো জটে
যখন মহেঞ্জোদারো চুম্বনে শিকল ফাঁদে আপাদমস্তক,
তখন সময়-গর্ভে রপ্ত ডারুইন
মনে মনে কালাকানু-দগ্ধ, দর্পহীন।’ (কটাশ কটাশ কাটে বাঁশকাটা পাখি, লখিন্দরের গান, কাজী নাসির মামুন)

কাজী নজরুল লিখেছেন:
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ।
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র। (কাণ্ডারী হুঁশিয়ার, বঙ্গবাণী, জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩)
আবার জীবননান্দ দাশ লিখেছেন:
‘কাফের’ ‘যবন’ টুটিয়া গিয়াছে, ছুটিয়া গিয়াছে ঘৃণা,
মোসলেম বিনা ভারত বিকল, বিফল হিন্দু বিনা; (‘হিন্দু-মুসলমান’, বঙ্গবাণী, জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩)
এই দুই কবির কণ্ঠ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লাগবের জন্য যেমন উচ্চারিত হয়েছিল। তেমনি তারই ধারাবাহিকতায় যেন বাংলাদেশ ভূ-খন্ডের হিন্দু-মুসলমানদের স্নায়ু দ্বন্দ্বের নিরাময়ে কবি কাজী নাসির মামুন তাঁর ‘ধানগাছ চিরদিন থাকে না’ কবিতায় কণ্ঠ তুলেন-
‘শুধু গেরস্থের স্বপ্ন-দেখা ভোরে
মন্দিরের মঙ্গল হাঁক, আজানে সামান বলে পাগল মমিন।’ (ধানগাছ চিরদিন থাকে না, লখিন্দরের গান, ফেব্রুয়ারি ২০০৬)

‘হাইরোগ্লিফিক্স’, ‘ঝড় ও মরা কটালের দিন’, ‘লখিন্দরের গান’ কবিতাগুলোয় তিনি অসামান্য শিল্প নির্মান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে ‘লখিন্দরের গান’ সিরিজের দশটি কবিতায় দ্রোহ আর বিনির্মানের সুর চমৎকার সহচর।
‘আমার নিয়েছে সব উভচর ভাগ্য লীলাখেলা
বাদল খরায় আসে, দম্ভ করে অগ্নি চেলাপেলা
কাঠের ঠুনকো শিখা জ্বালো গো বেহুলা মুখে লাল
লখিন্দর জলো মাছ: সঙ্কটের বেকুব কপাল।’ (লখিন্দরের গান: ছয়, লখিন্দরের গান, কাজী নাসির মামুন)

‘নদী’, ‘ডুমুরের ফুল হয়ে আয়’, ‘ট্রাক ফেরাবার গান’, ‘জলসাঘর’, ‘আগুন’ ইত্যাদি কবিতায় পেয়েছি ভিন্নতর স্বাদ।
‘মাটির ঢেলায় সে-ও গুড়ো করে দেয়
উদ্ধত বুকের কাছে শ্রমের পেষণ
একটু তুমিও দাও,
কৃষাণী,
দ্বিধার নগ্ন উঠোন’ ( জলসাঘর, লখিন্দরের গান, কাজী নাসির মামুন)

শিল্প নির্মানে মগ্ন এ কবির কবিতায় মুক্তি আসুক বাংলা কবিতার নতুন ধারার।

শরিকানা চোখ : মোস্তফা তারেক


প্রকাশক: মিজান পাবলিশার্স
প্রকাশ কাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৮
প্রচ্ছদ: ফেরদৌস খান


কবির জীবন যাপন যতটা সরল হয় তাঁর ভাবনাগুলোও সরল ও শুদ্ধ হয়ে ওঠে। কবি মোস্তফা তারেক সেই সরল কবি। ভালোবাসা আর আবেগের অনুভূতিশীল কবিতা বন্দী তাঁর ‘শরিকানা চোখ’। ৩৯ টি কবিতায় তুলে এনেছেন জীবনের নানা অনুভূতির সহজ পাঠ। যে সকল কবি নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত তাদের প্রতি কটাক্ষ করেই যেন মোস্তফা তারেক প্রথমেই নিরাময় চাইছেন দূষিত সমাজের।
‘কত আর ভাসি বলো সড়কের কালো ঢেউয়ে
নিরাময় দাও, ঔষধিলতা গো ...
সারিয়ে তোল ভেতর কাহন’ ( ঔষধিলতা, শরিকানা চোখ, মোস্তফা তারেক)
আমাদের পরিবারগুলো ক্রমশঃ লোভ ও বিকৃত মানসিকতার প্রলোভনে নষ্ট হয়ে হারিয়ে ফেলছে স্বাভাবিকতা। আর এ সবই তিনি লিপিবদ্ধ করেন আত্মধ্যানে তাঁর কবিতায়:
‘এই উঠানে একটিও দায়ভাগী মানুষ আর নেই
পড়ে থাকে শুধু শরিকানা চোখ
................ তার বারো মাস
ইষ্টিকুটুম পক্ষির সুর আর বনৌষধি মন ছিলো
রোদ্দুরের গোড়ালী কামড়ে সোনা সোনা কত কথা
ধান ছিল মৌ মৌ উঠোনের প্রান্তর’( শরিকানা চোখ, শরিকানা চোখ, মোস্তফা তারেক)

‘আম্মার শাড়ীর আঁচল’ কবিতায় কবি তাঁর মায়ের আঁচল থেকে জন্ম দেন ভিন্নতর বোধের এবং ক্রমশঃ আমাদের মাঝে বিস্তার করেন আবেগে। ‘এই শহর ছেড়ে যেয়োনা কোথাও’, ‘মাসকান্দা’ কবিতায় নিজের শহরের প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রকাশ পায়। ‘একদিন’ কবিতায় চমৎকার ভাবে জড়িয়ে ফেলেন বোধ খুব সহজে:
‘তোমার পায়ের ছাপ কুড়াতে কুড়াতে
একদিন বিকালে যাবো তোমাদের বাড়ি
একদিন ভর দুপুরে, একদিন সন্ধ্যায়
একদিন খুব সকালে তোমাকে ঘুমে রেখেই’

পৃথিবীর সকল অন্যায় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ তোলেন ‘মানুষের ছদ্মবেশে’ কবিতায়। খুব চমৎকার ‘খেরো খাতার পদ্য’ শীর্ষক পাঁচটি অণুকাব্য।
‘লক্ষ্মীন্দরের নীল দাও
সাকী, সক্রেটিসের গরলে উপচাও পেয়ালা
হায়! সত্যের জন্যে হই অমর, মরে যেয়ে আমি একলা।’ (খেরো খাতার পদ্য, শরিকানা চোখ, মোস্তফা তারেক)
খুব আবেগ প্রবণ বলেই আরব আলী, আহেদ আলী সাধারণ মানুষের চরিত্রগুলো তাঁর কবিতায় ধরা দেয়। প্রিয় বন্ধু আবুর জন্য মনের কষ্ট ঝরে পরে কবিতার পৃষ্ঠা ভিজিয়ে।


আবেগী কবি মোস্তফা তারেকের কবিতার ভাষা আরো গাঢ়ো হলে তার ভাবনাগুলো পোক্ত হয়ে ওঠার অবকাশ পেত বেশ। যেমন: ‘আঙুল’ কবিতাটি পেয়েছে শৈল্পিক বিকাশ।
‘আঙুলগুলো আমার স্বাধীনতা চায়
নিজেরা নিজেরাই ওরা কতটা ছন্দবদ্ধ
সব বাধার দেখো কেমন শিল্পিত অতিক্রম
আঙুললতা আমার গেরিলা সন্ন্যাস’ (আঙুল, শরিকানা চোখ, মোস্তফা তারেক)

কবিতা চর্চা ও আরাধনার। কবি মোস্তফা তারেক আরো শুদ্ধতর সাধনায় হয়ে উঠবেন আগামীর- এই প্রত্যাশায়।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

লিখেছেন আবু ছােলহ, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৮

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

গুগল থেকে নেয়া ছবি।

সামুতে মাল্টি নিক নিয়ে অনেকেই কথা বলেন। অনেকের কাছে মাল্টি যন্ত্রণারও কারণ। শুধু যন্ত্রণা নয়, নরক যন্ত্রণাও... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×