somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টুথপেস্ট

০৭ ই জুলাই, ২০১৯ রাত ১২:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার খুবই প্রিয় একটা খাবার ছিলো টুথপেষ্ট। হ্যা টুথপেষ্ট, মানে দাত মাজার পেস্ট। জেল পেস্ট টা ছিলো আরো প্রিয়। দাত ব্রাশ করতে হবে- নিয়ে নিলাম প্রয়োজনের তুলনায় ৩-৪ গুন অতিরিক্ত পেস্ট। তারপর ব্রাশ থেকে মুছে হাতের তালুতে রেখে দিতাম পেস্ট। দাত ব্রাশ করা হয়ে গেলে কুলি করে সাথে সাথে হাতের তালুতে রাখা পেস্ট খেয়ে ফেলতাম।

সেই যে শুরু, তারপর দেখা গেল দিনদিন খাওয়ার নেশাও বেড়ে যাচ্ছে। ব্রাশ রাখতে গিয়ে খাচ্ছি, দুপুরে খাচ্ছি, রাতেও চুরি করে খাচ্ছি, কারনে অকারণেও খাচ্ছি । যেখানে পেস্ট পাই সেখানেই খাই। কাকীর ঘরে পেলেও খাই, কারো বাসায় বেড়াতেও গেলে খাই, আর নিজের ঘর হলে তো কথাই নাই-আরামসে যতক্ষন খাওয়া যায় ততক্ষন খাই। ব্যাপারটা এমন হয়ে গেলো যে সবাই আমার উপদ্রবে অতিষ্ঠ। ওদিকে আম্মা এই বদভ্যাসের জন্য মাইর দেওয়া শুরু করে দিলেন। খেতে দেখলেই কান মলে দিতো।

প্রথম প্রথম আম্মা বোঝাতেন পেস্ট খেলে পেট খারাপ হবে, পেটে কৃমি হবে (কৃমিকে আম্মা জুজু বলে ভয় দেখাতো), বেশি পেস্ট খেলে এই হবে সেই হবে বলে পৃথিবীর নানান খারাপ দিকগুলোর কুৎসিত বর্ননা দিয়ে আমাকে বোঝাতেন। আমি বিস্ময় নিয়ে ভাবতাম একটা পেস্টের এত খারাপ গুন কিভাবে থাকে। আর থাকলেই বা মানুষ এত পেস্ট ব্যাবহার করে ক্যানো? টেলিভিশনেই বা ক্যানো এত পেপসোডেন্ট, ক্লোজ আপ, হোয়াইট প্লাস, ফেশ জেল বা কোলগেটের মত পেস্টের এত মধুর মধুর বিজ্ঞাপন দেয়। বিজ্ঞাপন দেখলেই শুধু পেস্ট খেতে ইচ্ছে করে।

আম্মা যতই বোঝাক কে শোনে কার কথা। আমি খেতেই থাকি। আম্মা যতই ভয় দেখান ততই বেড়ে যায় খাওয়ার নেশা। বাবাও বোঝান, আমিও নির্বিকার থাকি। তখনই আম্মার কৌশলের পরিবর্তন আনলেন। দুমদাম থেরাপি। পেস্ট খেতে দেখলেই দুমদাম পিঠে পড়তো। আমার নেশা যেন ততই বেড়ে গেলো, মাইর খাওয়াটা আর তেমন কিছু মনে হতো না। আম্মার চিন্তা বেড়ে গেলো কিভাবে এই বদ অভ্যাসের পরিবর্তন আনবেন। ওদিকে আমার চিন্তাও বেড়ে যাচ্ছে- কিভাবে আরো পেস্ট খেতে পারি।

দাদী এসে বুঝ দেয়। বলে এগুলো খারাপ অভ্যাস, আমাদের বংশে তো কেউ এমন করেনি, কারো তো এমন খারাপ অভ্যাস ছিলো না। আমিও দাদী কে যুক্তি দেখাই - তোমাদের সময় কি পেস্ট ছিলো? দাদীও কম যান না। তিনিও বলেন থাকবেনা ক্যানো? তাহলে তখনকার পেস্টে এমন স্বাদ ছিলোনা, আমারো পাল্টা যুক্তি।

মা বাবা দাদী কেউ পারেনা এই বদ অভ্যাস থেকে ছাড়াতে। উপায়ন্তর না পেয়ে এবার আম্মা কঠোর হলেন। শুধু মাইর দিয়েই যখন আমার অভ্যাস তাড়াতে পারছিলো না তখন তিনি কৌশলগতভাবে কঠোর হলেন। কঠোর না হয়েই বা করবে কি। নতুন পেস্ট নিয়ে আসে ৪-৫ দিন যেতে না যেতেই পেস্ট শেষ। পেস্ট খাওয়াটা নাওয়া খাওয়ার মত অভ্যাস হয়ে যাচ্ছিলো দিন দিন। আম্মা পেস্ট লুকিয়ে রাখা শুরু করলেন। ভোরে আম্মা নামাজ পড়ার জন্য উঠতেন। নামাজ পড়ে কোরআন পড়তেন আমার বিছানার পাশে। চোখ মুছতে মুছতে উঠেই দেখতাম ব্রাশে পেস্ট লাগানো অবস্থায় আমার ব্রাশ টেবিলের উপর রাখা। আমি দাত মেজে ব্রাশ রাখতে গিয়ে দেখি সেখানে সবই আছে শুধু পেস্ট নাই।

দুদিন তিন দিন যায়, আমি আর পেস্ট খুজে পাইনা। আমার আর ওটুকু পেস্টে চলেছেনা। পেস্টের তৃষ্ণায় আমি ছটফট করি। আম্মা যখন রান্না করতে যায় আমি তখন ঘর তন্নতন্ন করে পেস্ট খুজি, কোথাও পাইনা। আমার কান্না চলে আসে। পেস্টের কি হাত পা গজালো নাকি? ঘর ছেড়ে কোথায় গেলো? একদিন তো আম্মাকে বলেই ফেললাম "অতটুকুন পেস্টে আমার দাত মাজা হয়না"। তাতে আম্মার যেন আমার কথা, আমার আকুতি শোনার জন্য বয়েই গেছে। রোজ সকালে আমার জন্য বরাদ্দকৃত পেস্ট সেদিন থেকে টেবিলে রাখা শুরু হয়ে গেলো।

এভাবে দিন যেতে লাগলো। পেস্ট না খেয়ে মনে হতো কতদিন কিছু খাইনি। এর মাঝে একদিন নানুবাড়ী গেলাম। যেন আমি আসমানের চাঁদ হাতে পেলাম। গিয়ে দেখি পেস্ট, ব্যাস আমারে আর পায় কে। দুদিনেই পেস্ট শেষ। নানুর আবার ৯ ছেলেমেয়ে। তারা সবাই তখন বাসায়। ছোট ছোট কাজিনরা সহ এত মানুষ যে পেস্ট আছে কি নাই সেই খোজটুকুও কেও করছে না। পরেরদিন দেখি নতুন প্যাকেট রাখা হয়েছে। আমিতো মহাখুশি। ওটাও দুইদিন যাবার আগেই শেষ। পরেরদিন দেখি পেস্ট নাই। খালামনিকে বলতেই খালা ব্রাশ নিয়ে রুমে গিয়ে পেস্ট লাগিয়ে আমার হাতে দিয়ে গেলো। পরেরদিন আবার তাই। আর পেস্ট কাছে পাইনা, নেড়েচেড়ে দেখবো সেই সৌভাগ্য হয়ে উঠছেনা।

দুইদিন তো ভালই যাচ্ছিলো হঠাৎ আবার পেস্ট লুকানোর বুদ্ধি কে দিলো খালামনিকে? আবার আমার খারাপ দিন শুরু হয়ে গেলো। একদিন ভোরে উঠে আমি আবার নানু বাড়ির প্রতিটা রুম তন্নতন্ন করে খুজি। কোথাও না পেয়ে শেষে খালামনির রুমে এসে কসমেটিকস এর মাঝে খুজতে লাগলাম। ব্যাস ফল হাতেনাতেই পেয়ে গেলাম। টুথপেষ্ট এখানেই আছে। পকেটে নিয়ে দরজার কাছে এসে দেখে নিলাম কেউ আছে কিনা। দরজা ভিড়িয়ে দিতেই অন্ধকার ঘর আরো অন্ধকার হয়ে গেছে। আমি পেস্ট এর ছিপি খুলেই আমার মুখ বরাবর ধরেই পেস্টের পেছন থেকে টেনে সব পেস্ট মুখের মধ্যে নিয়ে নিলাম। অনেকদিন পেস্ট খাইনি, এবার সব খেয়ে ফেলবো।

বিধি বাম। মুখের মধ্যে পেস্ট জিহবা, তালুতে লেগে যখন একাকার তখনো আমি আমার পরিচিত স্বাদ টা আর পাচ্ছিলাম না। মুখ দিয়ে উথলিয়ে ফেলে দিলাম। আমার জিহবা তালু সব অবশ হয়ে যাচ্ছিলো। আমি খকখক করেই যাচ্ছি। খালামনি এসে দেখে আমার চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে, আর খকখক করেই যাচ্ছি। আর হাতে পন্ডস স্নো ধরে আছি। খালা ভেবেই পাচ্ছেনা আমি এখানে স্নো হাতে এমন করছি ক্যানো।

তারপর খালার কাছে বিস্তারিত শুনে আম্মা বললেন পেস্ট মনে করে ও স্নো খেয়ে ফেলেছে। খালা বলে উঠলেন
এই পাগল পেস্ট আর স্নো'র পার্থক্য বুঝোনা?
আমি কাদো কাদো গলায় বলি ওর প্যাকেট টা পেস্ট এর মত ক্যানো?

তারপর অল্পকিছুদিন থেকে আমি বাসায় চলে আসি। সেবারই প্রথম স্কুলে ভর্তি হলাম। তারপর রোজ আম্মা রোজ সকালে জাগিয়ে দিয়ে কলের পাড়ে ডাকতেন। দেখতাম আম্মা ব্রাশের মাথায় পেস্ট লাগিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমায় ব্রাশ করিয়ে সকালের নাস্তা খাইয়ে ড্রেস পড়িয়ে দিতেন। তারপর সবশেষে মাথায় তেল লাগিয়ে আম্মা বাম হাত দিয়ে আমার থুতনি ধরে মাথা আওড়িয়ে দিতেন। আমি সুবোধ বালকের মত সোজা স্কুলে চলে যেতাম। এভাবেই স্কুল কলেজ শেষ করলাম। ততদিনে আমার পেস্টের নেশা অনেকটাই চলে গেছে।

আম্মাকে ছেড়ে একসময় ঢাকায় পড়তে আসলাম। কেউ আর সকালে ডেকে দেয়না, পেস্ট লাগিয়ে ব্রাশ নিয়ে কেউ আর অপেক্ষা করেনা। গোসল করে ড্রেস পড়ে যখন আয়নার সামনে আসতাম চিড়ুনি নিয়ে তখন আর থাকতে পারতাম না। টপটপ করে চোখ বেয়ে পানি পড়তো। বোধহয় চিড়ুনিই টা খারাপ ছিলো নাহলে ক্যানো আমি সোজা সিথি করতে পারতাম না। অথচ আম্মা একবার চুল আচড়িয়ে দিলেই একদম সোজা সিথি হয়ে থাকতো। এমন সোজাই থাকতো যে স্কুল থেকে এসেও দেখতাম অমন সিথি অমনই আছে।

সেবার ঢাকা আসার পর প্রথম মেহেরপুর থাকার পর যখন আবার ঢাকায় চলে যাবো- বাবা আমার প্রয়োজনীয় সব কিছু কিনে কিনে আনছে। আম্মা বাবাকে বলছে-বাবুর জন্য ক্লোজ আপ পেস্ট এনো, জেল পেস্ট ওর খুব পছন্দের।

ঢাকায় এসে ব্যাগ খুলে দেখি বাবা ক্লোজ আপ এর ৩ কালারের ৩ টা পেস্ট দিয়েছেন। একটা ভেঙ্গে একটু খেলাম। আগের মত আর খেতে পারিনা। তবুও খেয়ে যাই। অথচ কেউ আর বাধা দিচ্ছে না।

একটা সময় যেই যেই কাজগুলোর জন্য আম্মার হাতে মার খেয়ে মন খারাপ করতাম আজ এতদিন পরে এসেও সেই একই কাজগুলো করতে না পারার কারনে মন খারাপ হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে এইসব তুচ্ছ কারনে মন খারাপ এর পরিমাণ ততই বেশি হচ্ছে। সবকিছু আর আগের মত নেই, উল্টোটা যেন হয়ে যাচ্ছে দিনদিন অথচ পেস্টের স্বাদ তো সেই আগের মতই আছে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০১৯ সকাল ১১:৫২
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×