যদি পেতে চাও রাশেদার আলোকিত বসুন্ধরা
তবে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বেলে - দাঁড়িয়ে তোমার দ্বারে
আহবান করি যে তোমায়
এসো এই আঙিনায়, মুক্তির মোহনায়।
লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পেলাম স্বাধীনতা
তবু কেন আজ মৃত্যুর দ্বারে কাঁদছে মানবতা
আমার সোনার দেশ গড়তে হবে
ষড়যন্ত্রের বাঁধা রুখতে হবে
সময় এসেছে ফের এগিয়ে যাবার।
শান্তি সুখের সোনালি সেদিন আসবে আবার
ফিরে ঐশি আলোয়, সাঁজবে সমাজ,
স্বপ্ন দুচোখ জুড়ে
বাঁধার প্রাচীর যত ভাঙতে হবে
সাম্য ন্যায়ের গান গাইতে হবে
আগামীর দিন শুধু সম্ভবনার ..
সন্দেহ নাই; প্রকাশের ধরন হিসাবে সংগীতের অবশ্যই 'নিজস্ব' খাসলত আছে। সেই খাসলত শিল্প বা নন্দনের থেকে পাওয়া। শিল্প বা নন্দনের পাল্লায় মাপজোখ করেই বলা হয়- এটা সংগীত হইছে, বা হয় নাই। কিন্তু সবসময় এই মাপজোখ করতে একই পাল্লা ব্যবহার করা চলে না। কারন, শিল্পের মাধ্যম হিসাবে সংগীত সবসময় একই ধরনের অর্থ বা ভাব বা আবহ তৈরি করার জন্য রচনা বা গাওয়া হয় না- কাজেই সংগীতের নান্দনিকতার মাত্রায় হেরফের হয়।
তাছাড়া শুধু শিল্প চর্চার জন্য ছাড়াও অন্যান্য লক্ষ্য পূরনের জন্যও সংগীত তৈরি হয়। শিল্প তো আর সবসময় শুধু শিল্পের জন্য করা হয় না। যেমন সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক থেকে শুরু করে অন্য যে কোনো প্রয়োজন পূরনের কথা মাথায় রেখে সচেতনভাবেই সংগীত তৈরি হয়। যেমন ধরেন, জাতীয় কৃষক দিবস পালনের জন্য একটা সংগীত তৈরি করা হতে পারে। তো এমন সব প্রয়োজনে, যেখানে শিল্প চর্চা প্রধান উদ্দেশ্য না- সেখানে সংগীত নির্মানের সময় সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয় লক্ষ্য পূরনের ওপর, বক্তব্যের ওপর।
যেমন উপরের বাকানো হরফের কথাগুলো হচ্ছে একটি 'রাজনৈতিক' উদ্দেশ্যে নির্মিত সংগীতের। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির-এর এবছরের (২০০৯) সালে সদস্য সম্মেলন উপলক্ষ্যে সংগীতটি নির্মিত হয়েছে, সম্মেলনের আবহ সংগীত হিসাবে। মানে হলো- সংগঠনটির সর্বোচ্চ স্তরের কর্মীদের, সদস্যদের বার্ষিক সম্মেলনের আবহ ধরে সংগীত টির বেড়ে ওঠা। একটা দেশের একটা রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সর্বোচ্চ সম্মেলনের আবহ সংগীত।
কিন্তু, সংগীতটিতে রাজনৈতিকতার আভাসমাত্র তালাশ করে পেতে বহুত কষ্ট করতে হচ্ছে।
১. 'আলোয় ভরা' 'আগামীর দিন' এর আশা জাগানো হচ্ছে সংগীতে, কিসের আলো ? অথবা আশা জাগানোওয়ালারা যখন 'আগামীর দিন' বলেন তখন কেমন দিনের কথা তাদের মাথায় থাকে? সেটা বোঝা যায়- আগামীর দিন মানে- 'রাশেদার আলোকিত বসুন্ধরা'। রাশেদা মানে খোলাফায়ে রাশেদা, আল্লার রাসুলের চারজন খলিফা, প্রতিনিধি, যারা রাসুলের মৃত্যুর পর ইসলামী জনপদসমূহের নেতা ছিলেন, পর্যায়ক্রমে।
তো, বলা হচ্ছে- আগামীর দিন যদি 'আলোয় ভরা' পেতে হয় তবে 'রাশেদার আলোকিত বসুন্ধরা' নামিয়ে আনতে হবে আগামীর দুনিয়ায়। মুশকিল এখানেই। বাংলাদেশে এই সময়ে দাড়িয়ে যে সংগঠনটি ছাত্রদের কাছে, তরুনদের কাছে সুন্দর সমাজ গঠনের কথা বলে, তাদের মাথায় ওই সমাজের নমুনা মানেই সেই আরবের নগর রাষ্ট্র মদীনা কিংবা পরবর্তীকালের স্বল্প সময়ের ইসলামী দুনিয়া।
সংগঠনটি বারবার ভুলে যাচ্ছে অতীতকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। শুধু অতীতের চেয়ে ভালো অথবা খারাপ সমাজই এখন বর্তমানে নির্মান করা সম্ভব। যে সমাজ না প্রাণে না প্রকৃতিতে আগের বা পরের কোনোটির মতো হবে।
২. বলা হচ্ছে- লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পেলাম স্বাধীনতা/ তবু কেন আজ মৃত্যুর দ্বারে/ কাঁদছে মানবতা/ যে স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে সেই বিষয়ে শিবির এখনো জনপরিসরে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। শিবিরের সবাই তরুন। স্বাধীনতার পরের প্রজন্ম। কিন্তু বাংলাদেশর জামায়াতে ইসলামী- যারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছিল- এবং এখনো জনপরিসরে কোনো বিপরীত অবস্থান নেয়নি- তাদের সাথে শিবিরের সম্পর্ক এখনো একাত্তরের স্বাধীনতার লড়াই ও লড়াইয়ের পেছনের চিন্তা ও দর্শন বিষয়ে শিবিরের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সে অবস্থায় 'স্বাধীনতা'কে 'পেলাম' বলা হচ্ছে । শিবিরের সবাই 'স্বাধীনতা'কে নিজেদের প্রাপ্য মনে করেন বলে কোনো প্রমান জামায়াতের সাথে সংগঠনটির সম্পর্ক আমাদের সামনে হাজির করে না।
৩. বলা হচ্ছে- আমার সোনার দেশ গড়তে হবে/ ষড়যন্ত্রের বাঁধা রুখতে হবে। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব থেকে শিবির এখনো বেরিয়ে আসতে পারে না। যা কিছু ঘটছে দুনিয়ায় সব কিছুকে বুঝতে না চেয়ে এখনো শিবির তালাশ করছে ষড়যন্ত্র।
৪. বলা হচ্ছে- ঐশি আলোর কথা। ভাষার ইতিহাস আর চিন্তুায় আল্লা এবং ঈশ্বর একই বিষয় না। শিবির আল্লার থেকে ইশ্বরকে পসন্দ করছে।
এসবই শিবিরের রাজনৈতিকতাকে প্রশ্ন করছে। এবং যেহেতু সংগীতে এসেছে এসব, তার দুটো মানে থাকতে পারে-
এক. শিবিরের এ সময়ের দলগত চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গী সংগীতটিতে এসেছে।
এটি যদি না হয় তবে
দুই. সংগীত যারা শিবিরে নির্মান করেন, শিবিরের সেই সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের লোকজন শিবিরের দলগত তৃনমূল চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে পরিচিত না।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১০ রাত ৮:৪৩