মেয়ে আমার! তোমার সেবা, তোমার চলা, তোমার চিন্তা, তোমার বলা পুরুষ জন-সাধারণের ভিতর যেন এমন একটা ভাবের সুষ্টি করে ÑÑ যা’তে তারা অবনত মস্তকে, নতজানু হ’য়ে, সসম্ভ্রমে, ভক্তি গদগদ কন্ঠে Ñ ‘মা আমার, জননী আমার! বলে মুগ্ধ হয়, বুদ্ধ হয়, তৃপ্ত হয়, কৃতার্থ হয়, তবেই তুমি মেয়ে, তবেই তুমি সতী। ’
শ্রীশ্রীঠাকুর, তাঁর জীবনে একটি মাত্র গ্রন্থ স্বহস্তে লিখেছেন, তা হলো সত্যানুসরণ। এই সত্যানুসরণকে আধুনিক যুগের জীবনাচরণের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সেই সত্যানুসরণের এ বছর ১০০ বছর পূর্তি । আমি এখানে সকলকে গ্রন্থটি সংগ্রহ করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।
এই অমর গ্রন্থ সত্যানুসরণে শ্রীশ্রীঠাকুরের সহজ সরল ঘোষনা:
“প্রত্যেক মাÑই জগজ্জননী। প্রত্যেক মেয়েই নিজের মায়ের বিভিন্ন রুপ, এমনতর ভাবতে হয়। ”
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ছিলেন জীবন্ত ও মূর্ত বেদ। আর তিনিই এ মহান সত্যটি জগতের সামনে আবার সহজ সরল ভাষায় তুলে ধরেছেন।
সনাতন ধর্ম পৃথিবীর সেই প্রাচীন ধর্ম , যেখানে নারীকে বসানো হয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার মাতৃরুপী দেবীর আসনে। সনাতন ধর্মে যুগে যুগে আবির্ভূত সকল সাধক মহাপুরুষগণ নারীকে মা সম্মোধনে মহিমান্বিত করেছেন। সনাতন ধর্মের দৃষ্টিতে নারী শুধু নারীই নয়। সে যে জগজ্জননী, আদ্যাশক্তি, ব্রহ্মময়ী মা।
শ্রীমদভাগবত গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
“গঙ্গা গীতা চ সাবিত্রী সীতি সত্যা পতিব্রতা
ব্রহ্মাবলী বহ্মবিদ্যা ত্রিসন্ধ্যা মুক্তি গেহিনী”
অর্থাৎ, গঙ্গা, গীতা, সাবিত্রী, সীতা Ñএই সকল নাম যিনি প্রত্যহ একাগ্র চিত্তে জপ করেন, তিনি জ্ঞাণে সিদ্ধি লাভ করেন এবং অন্তে পরম পদ প্রাপ্ত হন। প্রতিটি নতুন দিনেই পাপ-তাপ দৈবদূর্বিপাক থেকে মুক্তি পেতে উপরোক্ত নামগুলো ত্রি-সন্ধ্যা জপই হলো আর্য্য কৃষ্টির অঙ্গ। প্রাত:স্মরণীয় এ নামগুলো স্মরণ করার ধর্মীয় বিধি ব্যবস্থায় বলে দেয় সনাতন ধর্মে দেবীরুপ নারীত্বের অবস্থান কতখানি মর্যাদার।
সনাতন ধর্মে ভিন্ন ভিন্নরুপে মাতৃময়ী নারী দেবীরুপে আবির্ভূতা। কখনো সন্তান বাৎসল্যে আবির্ভূতা দেবী দূর্গা, আবার কখনো সৃষ্টি-স্থিতি বিনাশিনীরুপে কালী, কখনো বা জ্ঞাণ সমুদ্রের অধিষ্টাত্রী দেবীরুপে স্বরসতী, ঐশ্বর্য্য প্রদায়িনী লক্ষ্মী, পতি-প্রাণা সীতা-সাবিত্রী, কিংবা স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপার প্রেমরসের প্রণয়িনীরুপে দ্বাপর যুগে আবির্ভূতা দেবী রাধা। যার নাম নিয়ে ‘হা রাধে হা রাধে’ বলে মাতোয়ারা হয়ে উঠতেন পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ। এমনকি এ যুগে মনুষ্যজীবনের পরমপ্রাপ্তির উপায় হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে এই রাধা নামকে। এ যুগে আমরা দেখতে পায় শ্রীশ্রীঠাকুরের ললিা সঙ্গিনী শ্রীশ্রীবড়মা।
যেখানে সমাজ রাষ্ট্র, পরিবার , ধর্ম আমাদের এ মর্যাদায় বসিয়েছে, সেখানে আমাদেরও নিশ্চয় অনেক দায়িত্ব রয়েছে।
পরমপুরুষ স্বামী স্বরুপানন্দ বলেছেন, “নারীর একটা মর্যাদা আছে, আছে গৌরব। সে মর্যাদা তাঁর মনুষ্যত্বে নয়, তার দেবত্বে। মানবীত্ব নারীর গৌরব নয়, নারীর প্রকৃত গৌরবের মূর্ত্তি ফুটে উঠে তখন, যখন সে দেবী হয়। এ দেবীতের দুয়ার খুলবার উপায় হচ্ছে ভগবানের নাম গান। যে যত ভগবানকে ডাকে, ভগবানের জন্য উতলা হয়, তাঁর ততই স্বার্থবুদ্ধি কমে হীনতা ও নিচতার অবসান হয়, হৃদয়ের প্রসার ঘটে।”
মানব কল্যানে ধর্ম তথা জীবন বৃদ্ধিই ধর্ম। তাই এ ধর্মের যা কিছু প্রায়োগিক, যা কিছু তাত্ত্বিক সবই যেন অনুকরণযোগ্য, অনুসরণযোগ্য। অতি সাধারণ একটি মেয়ে যখন তার অন্তর্গত ভক্তি আর জ্ঞাণের সমন্বয় ঘটিয়ে আচারনিষ্ঠ জীবন যাপনে উদ্দীপিত হয় তখন এক বাক্যে সবাই তাকে লক্ষ্মী বলে সম্মোধন করে।
শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন, লক্ষ্মী কথাটা এসেছে ‘লক্ষ্মা’ ধাতু থেকে। যার অর্থ হলো আলোচনা, চিহ্নীকরণ, অঙ্কন, জ্ঞাণ, দর্শণ Ñ এ সব গুণ যাদের আছে তারাই লক্ষ্মী।
মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই সবদিক দিয়ে দক্ষ করে তুলতে হয়, যাতে তারা সুলক্ষণা মূর্তিমতি লক্ষ্মীরুপে গড়ে উঠতে পারে। লক্ষ্মী কথাটার সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত একটি শব্দ ‘সদাচার’। শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, “সদাচারে বাঁচে বাড়ে লক্ষ্মী বাধা তার ঘরে।”
সদাচার মানে বাঁচার আচার। যে আচার মানুষকে সুন্দর সমৃদ্ধশালী জীবনের পথ দেখায়। সদাচার একটি আচার প্রক্রিয়া যাতে নিজের অজ্ঞাতসারেই ইষ্টের উপর নেশা ধরে যায়। অপরদিকে, সদাচারবিহীন জীবনের পদে পদে ধ্বংস অনিবার্য। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ অত:পর রাষ্ট্রব্যবস্থায় ডেকে আনে অনিবার্য পতন।
সা¤প্রতিক সময়ে আমাদের সমাজে কিছু কিছু কুসংস্কারের যেমন আধিক্য দেখা যায়। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংস্কার না মানার প্রবণতাও। সময়ের গতির সাথে তাল মিলাতে গিয়ে কিংবা অতি-মাত্রায় আধুনিকতা দেখাতে গিয়ে অথবা অলসতা যে কারণেই বলুন না কেন, আমাদের মাতৃসমাজ প্রাত:কর্ম থেকে শুরু করে সন্ধ্যায় সন্ধ্যা প্রদীপ দেওয়ার মত আর্য্যকৃষ্টিগুলো কতটুকু মানছেন তা অনেকখানিই প্রশ্নের সম্মূখীন। অথচ, সাস্থ্যের জন্য, জীবনের জন্য, শান্তির জন্য একটি পরিবারে মা, বোন কিংবা পতিপ্রাণা স্ত্রীই পারে সর্ব কল্যানার্থে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। এখানে একটি কথা পরিষ্কার করে বলতে চাই, এ মাতৃসম্মেলণের উদ্দেশ্য তথাকথিত নারীবাদীত্বের প্রচার বা প্রসারণ নয়। নারীর প্রকৃত স্বরুপ ও করণীয় তুলে ধরায় এ মাতৃসম্মেলণের উদ্দেশ্য।
আজকের সময়ে রাস্তায় নেমে যারা নারী প্রগতির নামে নারী অধিকারের স্লোগান তুলেন তাদের উদ্দেশ্যেই শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন, নারীকে রাস্তায় নেমে তার অধিকার আদায় করতে হয় না। সেবামূখর চলন দিয়ে, পরিবারের সকলের ভাল-মন্দ, আপদ-বিপদের দূর্গতিনাশিনী হয়ে পরিবারের কর্ত্রী হয়ে উঠায় নারীর স্বাধীনতা।
তাই বলি, পিতাকে, ভাইকে, স্বামীকে অশ্রদ্ধা করে, তাদের সাথে প্রতিযোগীতা করে যে নারী অধিকার তা আপনারা চান? নাকি, শ্রীশ্রীঠাকুরের বলা সেবামূখর চলন দিয়ে সকলের অন্তরের জগদ্বার্থী হয়ে উঠে পরিবারের সম্রাজ্ঞী হওয়াটা আনন্দের? একবার নিজেকে প্রশ্ন করবেন?
শ্রীশ্রীঠাকুর স্বাধীনতার সংজ্ঞা দিয়েছেন, সকলে মিলে মিশে, এক অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে, সেবামূখর যে জীবন চলনা তাই স্বাধীনতা। আমার মনে হয় তাতেই আনন্দ।
এখানে যারা আছেন তাদের একটি কথা আমি দুহাত জোড় করে বিনীতভাবে বলি, সভা-সেমিনারে ভাষণ দিয়ে নয়, শুধুমাত্র ইষ্টের প্রতি ভালবাসা আর সেবামূখর জীবন চলনা যখন প্রতিটি নারীর বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠবে তখনই প্রতিটি পরিবারে শান্তি আসবে। তাই হয়ত শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন, “আচারে না থাকলে ধর্ম . কথার ঝিঁকিমিঁকি”
নারীর জীবনে সুখ তখনই আসে যখন সে দেখে তার স্বামী ভাল আছে, তার সন্তানেরা মানুষের মত মানুষ হয়েছে। আর তা যদি আমাদের কাম্য হয় তাহলে আমাদেরকে আরো সেবাপ্রাণ হতে হবে।
সা¤প্রতিক কালের সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয় নারী শিক্ষা। আমাদের মেয়েদের তথাকথিত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে এতটাই মজেছি যে পরবর্তীতে দেখা যায় সেই শিক্ষাটাই তার ভবিষ্যৎ জীবনের পথে সচ্ছন্দে চলার পথে কাটা হয়ে দাড়ায়। আপনারা হয়ত আমাকে একটু সংকীর্নমনা এবং রক্ষণশীল ভাবছেন তাই না? এটা ভাবাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনার আশে পাশের চিত্রটা একবার ভাবুন। তাহলেই আপনি উত্তর পেয়ে যাবেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র নারী শিক্ষাকে অবহেলা তো করেননি বরংচ নারী শিক্ষার উপর তিনি জোর দিয়েছেন। কিন্তু তিনি বলেছেন গাহর্স্থ্য অনুচর্য্যার ভিতর দিয়ে শিক্ষিত হওয়ার জন্য।
এর অন্যথা হলে কি ঘটে:
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেন, মেয়ে যতই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেতাবশালিনী হোক না কেন, আর তার বিদ্যার জৌলুস দেখে মানুষ যতই অবাক হোক না কেন, যদি সে স্বামীতে কেন্দ্রায়িত হয়ে শ্বশুড়-শাশুড়ি এবং পরিবার পরিজনের সেবায় সার্থক হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়, আয়, ব্যয়, পরিবার নিয়ন্ত্রণ, আপদ বিপদ ও রোগীর সেবায় উপস্থিত বুদ্ধি সম্পন্না না হয়, যদি নিজের আচরণের মাধ্যমে সবাইকে খুশি করে তুলতে না পারে, তাহলে বিশ্বদ্যিালয় বা শিক্ষার জৌলুস থাকলেও সে মেয়ে এখনো কেন্দ্রায়িত হয়ে উঠতে পারিনি। তাই বলি সত্যিকারের মেয়েই সত্যিকারের মা।
সবার উদ্দেশ্যে বলি, নারীই মানবের ধাত্রী, পাত্রী, নেত্রী, জনয়েত্রী ও প্রসবিণী। তাই, মানব কল্যানের কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে গেলে সর্ব্বাগ্রে নারীকে তার সাত্বত গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত করতে হবে। কারণ, জীবজগৎকে যেমন টিকে থাকতে হয় জীবধাত্রী ধরিত্রীর বুকে ভর করে, মানব সমাজকেও তেমনি তার অস্তিত্বের অক্ষুন্নতা ও উদ্বর্দ্ধনের জন্য একান্তভাবে নির্ভর করতে হয় মাতৃজাতির উপর। আদর্শ নারী চরিত্রের যে আলোক সুন্দর বাস্তব সম্মত চিত্র আমরা শ্রীশ্রীঠাকুরের দর্শণে দেখি, তার প্রতিরুপ যদি সমাজে ফুটে ওঠে, তাহলে দেখতে দেখতে যে দেশ ও দুনিয়ার রুপ বদলে যাবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। আর শ্রীশ্রীঠাকুরের নারী বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি আমরা দেখতে পায় শ্রীশ্রীবড়মাকে। তাই তার জীবনাচরণ সম্পর্কে আমাদের জানা উচিত।
আমরা সেই শুভ লগ্নের প্রতিক্ষায় আছি Ñ যেদিন পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুরের এই অমৃত আদর্শ ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে, বিশ্বের নারী সমাজ যেদিন সুচলনায় চলে নিজেদের সুগঠিত করে তুলতে ব্রতী হবে।
পরিশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,
“বারে বারে তুমি আপনার হাতে সাজে সৌরভে গানে
বাহির হইতে পরশ করেছ অন্তর মাঝখানে ”
এভাবেই পরমপিতা আমাদের সহায় হোন সত্য সুন্দরের পথে এগিয়ে যেতে। সেই শুভলগ্ন তরান্বিত করাই আমাদের সাধনা আর এ লেখার উদ্দেশ্য। বন্দে পুরুষোত্তমম্
লেখক: রিন্টু কুমার চৌধুরী
পরিচালক, শ্রেয় অন্বেষা
(শ্রীশ্রীঠাকুরের আদর্শবিষয়ক একটি গবেষণা প্রতিষ্টান)