ঢাকা শহর নাকি টু-লেটে ছেয়ে গেছে। অনেকের মুখে শুনি। নগরীর অনেক মানুষ রাজধানীতে বসবাসের যোগ্যতা হারাচ্ছেন। মধ্যবিত্তরা পরিণত হচ্ছেন নিম্ন বিত্তে, নিম্নবিত্তরা পরিণত হচ্ছেন এই মহানগরীতে বসবাসের অযোগ্য নাগরিকে।
সংবাদপত্র, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি দেখি। পিকআপে সাজানো প্রাগৈতিহাসিক কিছু মালামাল নিয়ে মাথা নিচু করে শহর ছাড়ছেন ২০-৩০-৪০ বছর বসবাস করা নাগরিকেরা।
হৃদয় বিদারক দৃশ্য।
উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় হলেও, উচ্চতর সাফল্যের আকাঙ্ক্ষায় হলেও ২০-৩০ বছর বসবাস করা আবাস হঠাৎ ছেড়ে যাওয়া হৃদয় বিদারক। আর সেখানে ব্যর্থতা মাথা পেতে নিয়ে আশৈশবের শহর ছেড়ে যাওয়া যেকোন প্রিয়জন হারানোর মতনই বিয়োগান্তক...যে ছেড়ে যায় তার জন্যেও, যাকে ছেড়ে যায় তার জন্যেও।
সেইসব অচেনা-অজানা পরাজিত মানুষের জন্য আপনার মন কাঁদে, এটা আপনার মনুষ্যত্ব বোধ, সহমর্মিতা। আর সেইসব আপাত অজানা পরাজিত মানুষের জন্য যখন আমার মন কাঁদে, তখন সেটাকে বলা যায় স্বজাত্যবোধ। কারণ ওরা আমারই ভাই, ওরা আমারই বোন। ওরা আমারই বাবা-মা, ওরা আমি নিজেই।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি একদিন আমরাও হঠাৎ করেই এই শহরে বসবাসের যোগ্যতা হারিয়ে ফেললাম। কোন এক সুন্দর রৌদ্র করোজ্জল সকালে এই শহর ছেড়ে মাথা নিচু করে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হয়েছিলো আমাদের।
বাবা 'সোনালী হাত-ঝাকি' দিয়ে সরকারি চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করতে চাইলেন। দুই দশকের চাকুরীজীবীকে দিয়ে সহসাই যে ব্যবসা হবে না, বাবা সেই নিষ্ঠুর সত্য যতদিনে বুঝতে পারলেন, ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। তিনি তার গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে পাওয়া হ্যান্ডসাম টাকা পুরোটাই খরচ করে যে অমূল্য শিক্ষাটি অর্জন করলেন তা হলো, ব্যাবসা সবার জন্য নয়।
বাবার অমূল্য শিক্ষার ফল হাতেনাতে পেতে শুরু করলাম আমরা। আমরা আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাপন সবকিছু গুটিয়ে এনে, সীমিত করে এনে তারপরও মাটি কামড়ে পড়ে থাকার চেষ্টা করলাম এই প্রাণের শহরে।
আমি ক্লাস ফোরে পড়ি, বড় বোন ক্লাস সেভেনে। বড় ভাই ক্লাস টেনে। সামনে ভাইয়ার ম্যাট্রিক পরীক্ষা, তাই তাকে নানার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে তার পড়ালেখা সচল রাখার চেষ্টা করা হলো। আমার আর আপুর লেখাপড়া বন্ধ।
তার পরও শেষরক্ষা হলো না। অসম প্রেমের ভবিষ্যতের মতন এই শহরের সাথে আমাদের সম্পর্ক শেষপর্যন্ত টিকিয়ে রাখা গেল না। যেই সময়ে মানুষ উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় গ্রাম ছেড়ে শহরে আসছে, আমরা তখন জীবন বাঁচানোর জন্য শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমালাম।
সেই গ্রামবাস আমার জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। গ্রামে গিয়ে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষে আমি পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হই। চতুর্থ শ্রেণি শেষ পর্যন্ত আমার আর পড়াই হয়নি।
মানুষ যদি আমাজনের গহীন জঙ্গলে হারিয়ে যাবার পরও, কিংবা মাঝ সাগরে জাহাজ ডুবির পরও, ভাগ্যক্রমে আবার নতুন জীবন ফিরে পায়, তখন তাদের কাছে সেই অভিজ্ঞতা যেমন হয় সব কিছুর থেকে মূল্যবান, আমার কাছেও আমার গ্রামের সেই অভিজ্ঞতা সেভাবেই অমূল্য। কারণ আমি ফিরে আসতে পেরেছিলাম।
গ্রামে আমি আসলেই একটা সোনালী সময় কাটিয়েছি। বয়স কম, আমি সংগ্রাম বুঝতে শিখিনি, সেটা বাবা-মায়ের দপ্তর। আমার দপ্তর ছিলো জীবনকে নতুন চোখে দেখার। আমি দেখেছি।
গ্রামে আমি সাতার কাটতে শিখেছি, গাছে চড়তে শিখেছি। গ্রামে আমি হাটতে শিখেছি, ৬-৭ কিলোমিটার পথ হেটে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে শিখেছি। কেরোসিনের আলোয় পড়তে শিখেছি। আমার গরু ছিলো, ওদের মাঠে চড়াতে শিখেছি, মাছ ধরতে, ফসল বুনতে, ফসল ঘরে তুলতে শিখেছি। আমি জেনেছি, গ্রাম কেবল বার্ষিক পরীক্ষার পর ডিসেম্বর মাসের ১৫-২০ দিন নয়। গ্রাম ১২ মাসের। গ্রাম গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-শীত-বসন্তের। অসাধারণ কিছু নতুন বন্ধু হয়েছে, আত্মীয়-স্বজনদের চিনেছি আরও কাছ থেকে। সব মিলিয়ে অসামান্য সেই অভিজ্ঞতা।
গ্রামে গিয়ে সাঁতার শেখার আগেই ২ বার পানিতে ডুবে মরতে মরতেও বেঁচে গেছি। সেদিনই আরও বুঝতে শিখেছি, আমার মৃত্যু এত অল্পতেই নেই, আরও বড় কিছু করার জন্য আমার জন্ম হয়েছে।
এর পর অনেক অনেক বছর পার হয়েছে।
আমি আজও খুঁজে ফিরি, কী সেই অসাধারণ কিছু, যার জন্য আমার জন্ম হয়েছে?
প্রায় দুই দশক ধরে ভেবে আজ পর্যন্ত আমার মধ্যে অনন্য যা পেয়েছি, আর দশজন সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা যা পেয়েছি, তা হলো--ক্লাস ফোর পাশ না করেও মাস্টার্স পাশ করা অতি বিরল দু'একজন সৌভাগ্যবানের আমি একজন!
শ্রেফ এটুকুই।
আর কিছু না। আর কিচ্ছু না।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০২০ রাত ৯:০৭