জোৎস্নার রাত। শহরের ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে খালি পায়ে হেটে চলেছি। পরনে জিন্সের প্যান্ট, গায়ে খয়েরী রঙ্গের পান্জাবী। খুব ইচ্ছে ছিল হলুদ রংয়ের পান্জাবী পড়ে খালি পায়ে এরকম জোৎস্নার রাতে হাটার। কিন্তু সে ইচ্ছা অপূর্ন থেকে গেল। কারন আমার তো কোন হলুদ পান্জাবী নেই। তাই বাধ্য হয়েই........। এভাবে হাটতে হাটতে কখন যে মূল রাস্তা থেকে সরে গিয়ে অচেনা পাড়ার অচেনা একটা রাস্তা দিয়ে হাটতে শুরু করেছি, বুঝতেই পারিনি। কিন্তু যখন ঘোর কাটল, বুঝতে পারলাম একটা বাড়ীর গেটের সামনে দাড়িয়ে আছি। সামনে আর রাস্তা নেই...।
ভয় পেয়ে গেলাম। কারন এলাকার এই রাস্তাটাতে এর আগে কখনোই আসিনি। তাই রাস্তাটা একেবারেই অপরিচিত। সেই রাস্তা দিয়ে কিভাবে আবার বাড়ীতে ফিরে যাব, সেই চিন্তায় সেই জোৎস্নার রাতেও ঘেমে যেতে শুরু করলাম। সেই সাথে নতুন একটা আতংক মাথায় ভর করল!! যেহেতু মোটামুটি পাগলের মত রাস্তা দিয়ে হাটছি এবং সেই সাথে একটা অচেনা রাস্তায় কিছুটা দিকভ্রান্ত হয়ে অসহায়ত্ব অনুভব করছি এবং ব্যাপারটা আমার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে!! সব মিলিয়ে হুজুগে বাংগালীর কাছে আমি একটা সন্দেহজনক ক্যারেক্টার!!! যে কেউ চাইলেই চোর-ছ্যাচ্চোড় ভেবে আমাকে রিমান্ডে নিতে পারে। এসব ভেবে ঘন্টাখানেক আগের ঘোর কেমন জানি আতংকে পরিণত হল। সেই বাড়ীর সামনের রাস্তায় দাড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম যে, এই যাত্রায় যদি ভালোয় ভালোয় রক্ষা পেয়ে যাই তো, জীবনে আর কখনোই হুমায়ুন আহমেদের "হিমু" হতে যাবনা!!!
অবশেষে কিভাবে কিভাবে যেন বাড়ীতে ফিরে এলাম। তবে বাড়ীতে ফিরে আসার পরেও ঘোরটা কেমন জানি কাটলনা। বরং আরো ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। এইবার পরিকল্পনা করলাম, দল বেধে জোৎস্না দেখতে যাব। কিন্তু আগেরটার চাইতে এটা আরো বেশী জটিল মনে হতে লাগল। দল বেধে দল কোথাও যাওয়া মানেই এক ধরনের পিছুটান। অন্যদের ইচ্ছে অনিচ্ছের উপর নির্ভর করে আমার সমস্ত কার্যাবলী আবর্তিত হবে- এটা ভেবেই কেমন জানি বিরক্ত লাগল। তবুও জোৎস্না দেখার জন্য একটু আকটু স্যাক্রিফাইজ তো করতেই হবে। ভাবলাম সেন্টমার্টিন যাব কয়েকটা দিনের জন্য। জোৎস্নার রাতে সেখানে গিয়ে আড্ডা দিতে দিতে চাঁদ দেখব!! কয়েকটা বন্ধুকে রাজিও করালাম। ওরা ঘুরতে যাবে, আর আমি জোৎস্নার রাত সবার সাথে উপভোগ করার পাশাপাশি একটু আকটু ঘুরাঘুরি করব। যদিও আমার এই পাগলামীর কথা কেউ জানেনা। প্রস্তুতির অনেকখানিই সম্পূন্ন করেছিলাম। যদিও শেষ পর্যন্ত সেই পাগলামীকে পূর্নতা দিতে পারিনি!!!
এভাবে হিমু হওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে অতিকান্ত হতে থাকে আরো কিছুটা সময়। রিক্সাওয়ালাকে পাঁচ টাকার ভাড়া বিশ টাকা দিয়েছি, মাঝে মাঝেই জোৎস্নার রাতে খালি পায়ে হেটেছি অনেকটা পথ, কটকটে হলুদ রংয়ের পান্জাবী কিনতে পারিনি ঠিকই, তবে হালকা ঘীয়ে রংয়ের পান্জাবী কিনেছি, সবসময় জগৎ সংসার সম্পর্কে উদাসী মনোভাব দেখাতে চেষ্টা করেছি, বন্ধু ও পরিচিত মহলে দার্শনিক টাইপের কথা বলে বিরক্তির কারন হয়েছি এবং একটা সময় স্কুলে কিছু বন্ধুবান্ধবে বুঝিয়ে দিয়েছি যে আমার ডাকনাম "হিমু"!!! আর এসব ঘোর আর পাগলামীর মূলে ছিল আমার প্রিয় মানুষ "হুমায়ুন আহমেদ" আর তার সৃষ্ট চরিত্র "হিমু"
এভাবে চলতে থাকে ঘোর লাগা আরো কিছু মুহূর্ত। পরিচয় হয়ে যায় মিসির আলীর সাথে!! যুক্তিহীনতা আর পাগলামীকে ধরে রাখতে পারিনা। জগৎ সংসারের প্রাকৃত-অতিপ্রাকৃত ব্যাপারগুলোকে যুক্তির কষ্টিপাথরে ছোঁয়ানোর চেষ্টায় মত্ত হয়ে যাই। নিজের মাঝে আরেকজন মিসির আলীকে অনুভব করতে শুরু করি!! আবিস্কার করি আমার মাঝে অন্য এক "আমি" কে!!!
একই মানুষের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন সত্ত্বার পরিচয় আমার এই প্রিয় মানুষ "হুমায়ুন আহমেদ" এর কারনেই অনুভব করতে পারি একসময়। আজ এই মানুষটা আমারে মাঝে আর নেই। বিদায় নিয়ে চলে গেছেন এক অজানা না ফেরার দেশে। হিমু, মিসির আলী আর শুভ্রকে আমরা কখনোই ফিরে পাবনা!! এদের সৃষ্টাকে নিয়ে কখনোই তেমন ভাবে ভাবা হয়নি। তবে আজ এই অবেলায় কেবলি মনে হচ্ছে- এই মানুষটাকে মনের অগোচরে কখন যেন বড্ড বেশী ভালোবেসে ফেলেছি!!
দোষত্রুটি নিয়েই একজন মানুষ। আর আমার এই প্রিয় মানুষটাও দোষত্রুটির উর্ধ্বে নয়। জীবনের চলার পথে উনি হয়তোবা সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারেননি। উনার প্রতি কিছু মানুষের হতাশা, অভিযোগ, ক্ষোভ থাকাটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। এতকিছুর পরও আসুন আমরা প্রার্থনা করি- সৃষ্টিকর্তা যেন এই মানুষটাকে অন্য জগতেও সুখে শান্তিতে রাখুক, উনার জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিক এবং উনার বিদায়ে উনার শুভাকাঙ্খীদের ধৈর্য ধারন করার তৌফিক দান করুক। আমিন।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১২ বিকাল ৩:৩২