মহিউল কাকা খুব রসিকতা ভালোবাসতো। নিজে আনন্দ করতো, অন্যদেরকেও তার আনন্দে শামিল করতো। আমার দেখা সবচে আমুদে, নির্মল, শাদাসিধে এই আমার সেজ চাচা। আমার আব্বার সেজ ভাই।
কাকা তার ভাগ্নেদের কাছে প্রিয় মামা ছিল। আমাদের ফুপাতো ভাই কবি সেলিম ভাই তো কাকার কানমলা নিয়মিত খেত। কাকা আমার ফুফাতো ভাই রুমি ভাই, শিমুল ভাইদের নিয়েও খুব রশিকতা করতো। বলতোঃ
‘ঘরে চাল নেই তো, ডাল নেই তো খাবা কি
ও আমার ইন্দুর বাবাজী!’
কাকা বাবু ভাইকে লুটু আমার আমাকে পুটু ডাকতো। আমাদের খুব স্নেহ করতো। দেয়ালে লেখা ভোটের মার্কার প্রচারকে উনি আমাদের উল্টো করে মুখস্ত করাতো। আমি আগেও একবার বলেছি। কাকা বাবুভাই আর আমাকে শেখাতোঃ
রদারস দজিম কে তাছা য়র্কামা টভো নদি
অথবা
:ওমা রীবা কে ড়ীদা ল্লাপা য়র্কামা টভো নদি
কি, মানে বোঝা যায়?
কাকা মোটা মোটা উপন্যাস লিখতো। জাবেদা খাতা জুড়ে। খুব সাবলিল ছন্দ মিলিয়ে ছড়া কাটতে পারতো। গ্রামের অনেকেই সেই ছড়ার পাত্রপাত্রী ছিল। আমার কিছুটা এখনও মনে আছে-
‘জ্বর নেই জারী নেই মকবুল শুটকো কাবু
টাকা নেই পয়সা নেই একুব কমেন্ডার বাবু
মোট বয়না চোট বয়না আমাতাকের মাথায় টাক
খেচড়া কবি শোন তে কেঠু আজির ডাক।’
(আমার ভুল হতে পারে, আসলে স্মৃতি হাতড়ে ফিরছি
আরও লম্বা ছিল এসব কবিতা। আমরা কিন্তু এসব মানুষজনকে ভুলে গিয়েছি। চিনি না। সময়ের অন্তরালে হারাচ্ছে নিয়ত চারপাশের মানুষজন।
মহিউল কাকার প্রতিভার কথা এখন মনে পড়লে অবাক হয়ে যাই। গ্রামের প্রান্তিক একজন মানুষ কতটা সেন্স অফ হিউমার নিয়ে জন্মালে এরকম অসাধারণ সৃষ্টি ধারণ করতে পারে লেখায় বা কথ্য বাক্যবিন্যাসে!
কাকা, আমাদের ভানু বন্দোপাধ্যায়ের মুভির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই যে ভানু গোয়েন্দা জহর এসিট্যান্ট আমার এখনও খুব প্রিয় মুভি। তাছাড়া রবি ঘোষ আর অনুপ কুমারের ছবিও কাকার সাথে বসে দেখেছি। গ্রামের একজন মানুষের রুচি কতটা শিল্পসম্মত হলে সেই গুগুলবিহীন সাদাকালো এনালগ আমলে কেউ এসব চর্চার মধ্যে রাখতে পারে!
কাকা মাছ ধরা খুব পছন্দ করতো। আমাদের বড় পুকুরঘাটে কাকার সাথে কত মাছ ধরেছি। আটার গুলি দিয়ে টোপ গাথা হতো। তার আগে চার কাঠিতে করে মশলার চার পুকুরের নিদিষ্ট জায়গায় পুতে রাখা হতো। সেই যে মাছ ধরার ভূত আমার মাথায় চেপেছিল আজও নামেনি, আমি এখনও খুব মাছ ধরতে ভালোবাসি। এখানে প্রায়শ সমুদ্রে হুইল ছিপ ফেলে মাছের অপেক্ষায় থাকি। সেই আটার গুলি বা কেচোর টোপ নেই এখানে একরকম আলোর টোপ ফেলা হয়, দুরন্ত বাতোসের কানাকানিতে দূরে জাহাজের মাস্তুল দেখতে দেখতে আমি আবার শৈশবে হারিয়ে যাই!
কাকার কাছে ছোটবেলার অনেক গল্প শুনতাম। একবার কাকা বলেছিল, কাকারা কয়েক বন্ধু চুরি করে রস খেতে গিয়ে ধরা পড়ে। কাকা, নূর ইসলাম ভাই, হামিদুল চাচা আর সম্ভাবত খাদেম চাচা। যথারীতি তাদের বিচার হচ্ছে। এই তুমি কয় উকড়ি, কেউ বলছে এক/ দুই, তাকে সেই এক দুই ঘা দেওয়া হচ্ছে; এরপর খাদেম চাচাকে বলা হলো তুই কয় উকড়ি, তো খাদেম চাচা মাথা ঠিক রাখতে না পেরে বল্লো আমি উকড়ি, উকড়ি ( এখন উকড়ি কি জিনিস তা নিশ্চয় মনে আছে সবার!)
আসলে আমাদের চারপাশের এসব রঙিন মানুষেরা হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। মহিউল কাকারও বয়স হয়েছে। তার বন্ধুবান্ধবরা অনেকেই আজ আজ নেই। কেমন যেন স্বার্থপর বাতাসে মিশে আছে আমাদের এখনকার তথাকথিত আধুনিকতা। নির্মল আনন্দ অশ্লিল হয়ে উঠেছে। মেধা চর্চা পুরোটা লগ্নি করছি আমরা সামজিক অপব্যয়ে। সুকুমারবৃত্তির চর্চা তো দুরে থাক, এর নামও হয়তো এখন কেউ জানে না। আমি জানি মহিউল কাকার মতো এত সেন্স অফ হিউমার নিয়ে পাথরঘাটায় আর কেউ জন্মাবে না!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০২৩ দুপুর ২:৪৭