প্রকৃতির রূপান্তরের ক্ষমতা বিস্ময়কর। মহাবিশ্বের আদি অবস্থা থেকে এ পর্যন্ত বস্তু জগতের ইতিহাস হল রূপান্তরের ইতিহাস। এক সিস্টেম থেকে বহু সিস্টেমের দিকে যাত্রা। এক গুণ থেকে বহু গুণের উদ্ভব। আদি থেকে এ পর্যন্ত সকল রূপান্তরই নিরবচ্ছিন্ন। এই নিরবচ্ছিন্ন রূপান্তরে কোন ফাঁক নেই যেখান দিয়ে অভূতপূর্ব কোন সিস্টেম প্রবেশ করবে। প্রকৃতির সকল সিস্টেমের যে নিজস্ব নিয়ম নীতি আছে সেখানে অলৌকিক কোন নিয়ম অনুপ্রবেশ বা প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। প্রকৃতির রূপান্তর স্বয়ংক্রিয়, সিস্টেমের নিয়ম নীতিই ঠিক করে দেয় কোন পথে রূপান্তর ঘটবে। প্রকৃতির প্রধান রূপান্তরগুলো নিম্নরূপ:
প্রকৃতির প্রথম রূপান্তর হল মহা বিশ্বের আদি অবস্থায় শক্তি থেকে এক গুচ্ছ বস্তু কণিকা ও চারটি বলে রূপান্তর। এই সিস্টেমে রূপান্তর পুরো বিশ্ব জুড়ে ঘটেছিল।
দ্বিতীয় রূপান্তর হল গুয়ন দিয়ে তিনটে করে বস্তু কণিকা বা কোয়ার্ক আটকে ফেলা। এভাবে কণিকাগুলো প্রোটন ও নিউট্রন সিস্টেমে রূপান্তরিত হল। একাধিক প্রোটন ও নিউট্রন আবার স্ট্রং ফোর্স দ্বারা পরস্পর আটকে গেল। একই সাথে প্রোটন উইক ফোর্স দ্বারা ইলেকট্রনকে তার কক্ষ পথে আটকে ফেলে। ফলে বস্তুর পরমাণু সিস্টেম গঠিত হল। পরমাণুতে প্রোটনের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পেতে লাগল তত বিভিন্ন বস্তুর পরমাণু গঠিত হল। যেমন হাইড্রোজেনের আছে একটি প্রোটন, আর অক্সিজেনে আছে আটটি প্রোটন। এইভাবে গঠিত হল বস্তু জগত। এর মধ্যে আলো হলো ইলেকট্রন ম্যাগনেটিক ফোর্স। আলো গঠিত হওয়ার পর থেকে মহাবিশ্ব দৃশ্যমান হয়ে উঠে।
তৃতীয় রূপান্তর হল গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, ব্ল্যাক হোলের গঠন। বস্তুর অণুর ভর রয়েছে। ভর মহাবিশ্বের স্থান-কালকে নিজের দিকে বাঁকিয়ে ফেলে। ফলে কাছাকাছি বস্তু অণুগুলো পরস্পর আটকে গিয়ে আরও বৃহত্তর ভর গঠন করে এবং আরও দূরের বস্তুগুলো এক জায়গায় জড়ো হতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ ও ব্ল্যাক হোলগুলি গঠিত হয়। এভাবে অণু থেকে বৃহৎ বস্তুগুলো মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের সিস্টেমে আবদ্ধ হয়ে যায়।
চতুর্থ রূপান্তর হল বস্তুর অণু, পরমাণুর জগতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে অসংখ্য যৌগিক বস্তুর গঠন। এরা সাধারণত গ্রহের কম তাপমাত্রায় তাদের রূপান্তর ঘটাতে পারে। এর মধ্যে কার্বন অণুকে কেন্দ্র করে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন ও ফসফরাস যেসব যৌগ গঠন করে তাদেরকে আমরা জৈব যৌগ বলি।পঞ্চম রূপান্তর হল জৈব যৌগ গুলো পরস্পর রাসায়নিক ক্রিয়া ও বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বেশ কিছু জৈব এককে রূপান্তরিত হওয়া। এদেরকে আমরা মোনোমার বলি। এগুলো বড় বড় মালার এক একটি দানা। দানাগুলো রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যে মালা তৈরি করে সেগুলোকে পলিমার বলা হয়। কার্বোহাইড্রেট, লিপিড, প্রোটিন ও নিউক্লিক এসিড হল এই ধরণের চারটি মালা। পৃথিবীর সকল জীবের কোষ মাত্র এই চারটি উপাদান দ্বারা গঠিত হয়। ষষ্ঠ রূপান্তর হল জীব কোষের গঠন। জীব কোষ একটি আবদ্ধ সিস্টেম। লিপিড আবরণের অভ্যন্তরে অন্যান্য মৌলিক জৈব উপাদান অনুপ্রবেশ করে এই আবদ্ধ সিস্টেম গঠিত হয়েছে। এই সিস্টেমটি স্বয়ংক্রিয়। এর আবরণ বাইরের পরিবেশ থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র রাখে। এর আবরণ ক্ষতিগ্রস্ত হলে নিজে নিজেই ক্ষত সাড়িয়ে তুলতে পারে। এর আবরণ বাইরে ভিতরে আয়নিক শক্তি আদান প্রদান করতে পারে, যা একটি রাসায়নিক প্রক্রিয়া। এরা বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় জৈব পদার্থ শোষণ করতে পারে, যার দ্বারা এদের আয়তনের বৃদ্ধি ঘটে। বৃদ্ধির এক পর্যায়ে এরা দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়, ফলে জ্যামিতিক হারে এদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। স্বয়ংক্রিয় বলে একবার গঠিত হয়ে যাবার পর বাইরের অনুকূল পরিবেশে এরা সংখ্যায় বাড়তেই থাকে। এই কোষীয় সিস্টেমের যত কর্ম কাণ্ড সবই ঘটে ইলেকট্রিক্যাল আয়নিক চার্জের দ্বারা। সপ্তম রূপান্তর হল বহু কোষী জীবের গঠন। অসংখ্য কোষ একসাথে জড়িয়ে থাকলে ভিতরের কোষগুলো বাইরে থেকে শক্তি আদান প্রদানের জন্য বাইরের কোষগুলোর সাহায্য নেয়। ফলে সবাই মিলে একটা সহযোগিতা মূলক সিস্টেমে রূপান্তরিত হয়। এই সিস্টেম থেকেই বহুকোষী জীবের জন্ম।
অষ্টম রূপান্তর হল বহুকোষী জীবের কোষগুলির শ্রম বিভাজন। কোষগুলি বিভিন্ন অঙ্গ বা তন্ত্রে রূপান্তরিত হল। কিছু কোষ স্নায়ু তন্ত্রে রূপান্তরিত হল। এরা বাইরের পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল। ফলে বহুকোষী জীব বাইরের পরিবেশের সাথে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। এরা সম্বলিত ভাবে পৃথক জীবে পরিণত হল।
নবম রূপান্তর বিবর্তন প্রক্রিয়ার জন্ম দেয়। ফলে জীব জগতে অসংখ্য বৈচিত্র্য দেখা যায়।
দশম রূপান্তর হল কিছু জীবের স্নায়ু তন্ত্রের একটা অংশের মস্তিষ্কে রূপান্তর। ফলে কালক্রমে মানুষের মত বুদ্ধিমান প্রাণীর জন্ম হল। মানুষের মস্তিষ্ক জ্ঞান অনুসন্ধানে সক্ষম এবং জ্ঞান সঞ্চয় করেও রাখতে পারে। প্রতিটি মস্তিষ্ক প্রকৃতির এক একটা কম্পিউটার। প্রকৃতির দৃষ্টিতে মানুষ নামক সিস্টেম বংশ বিস্তারের মাধ্যমে আরও অসংখ্য মস্তিষ্ক গঠন করে যাচ্ছে।
একাদশ রূপান্তর হল মানুষের ভাষা আবিষ্কার। ভাষা প্রকৃতির সামাজিক বা ভার্চুয়াল তথ্য ভাণ্ডার। পরবর্তীতে ভাষার লিখিত রূপ ও কম্পিউটার এই বিশাল তথ্য ভাণ্ডারকে ভার্চুয়াল জগতে স্থায়িত্ব দিয়েছে। মস্তিষ্ক প্রথমে কল্পনার মাধ্যমে জ্ঞান চর্চার সূত্রপাত ঘটায়। তারপর অনুসন্ধান ও প্রমাণের মাধ্যমে জ্ঞানের সত্যতা যাচাই করে। প্রকৃতি মানুষের মস্তিষ্কের মাধ্যমে নিজেকেই চেনার ও জানার চেষ্টা করছে। প্রকৃতির রূপান্তর প্রক্রিয়া দীর্ঘ। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ক উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে অনেক সিস্টেমের গতি ত্বরান্বিত এবং নিয়ন্ত্রিত পথে সংঘটিত করতে পারে। এ যেন প্রকৃতিই নিজের স্বয়ংক্রিয় রূপান্তরের উপর নিজের সুচিন্তিত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। এক সময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার এই নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিবে এতে কোন সন্দেহ নেই। আদি পৃথিবীতে সামুদ্রিক উদ্ভিদ সিস্টেম এই কাজটিই করেছিল। পৃথিবীর বাতাসে তখন অক্সিজেনের মাত্রা ছিল খুবই কম। ফলে স্থলভাগে কোন প্রাণীর অস্তিত্ব সম্ভব ছিল না। কিন্তু জলজ উদ্ভিদ প্রতিনিয়ত অক্সিজেন উৎপাদন করায় লক্ষ লক্ষ বছর পর বাতাসে যথেষ্ট অক্সিজেন সঞ্চিত হয়, ফলে সামুদ্রিক জীব জল থেকে মুক্তি পেয়ে স্থল ভাগেও বংশ বিস্তার শুরু করে।
প্রতিটি রূপান্তরিত সিস্টেমের ভিত্তিতে রয়েছে অণু পরমাণু। অণু পরমাণু বা তারও গভীরে কোয়ার্ক কণিকা বা তারও গভীরে কোয়ান্টাম ফিল্ড থেকে আরম্ভ করে মানুষের মস্তিষ্ক তথা বুদ্ধিমত্তা পর্যন্ত প্রতিটি সিস্টেমই নিরবচ্ছিন্ন, একটা থেকে আর একটায় রূপান্তর। সিস্টেম ভেঙে গেলে সব কিছুই আবার অণু পরমাণুতে ফিরে যায়। শুরু হয় নতুন করে নতুন ভাবে বিনির্মাণ।
প্রতিটি রূপান্তরিত সিস্টেমের গভীরে আরও মহাকাব্য রয়েছে। রয়েছে জানা অজানা অনেক জ্ঞান। কষ্ট করে এসব জ্ঞান অর্জনের চেয়ে কল্প কাহিনীতে বিশ্বাস করা অনেক সহজ। তারপরেও পাঠকদের কাছ থেকে উৎসাহ পেলে পরবর্তী পোস্টগুলোতে প্রতিটি রূপান্তরের গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করব।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০২৩ দুপুর ১:৩৫