মানুষ সহ সকল প্রাণী বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। এই খাদ্যে মূলত রয়েছে শ্বেতসার (কার্বোহাইড্রেট), চর্বি (লিপিড), আমিষ (প্রোটিন) ও নিউক্লিক এসিড। আবার এই সব উপাদানগুলো দিয়েই সকল জীবের দেহ তথা দেহের সকল কোষ গঠিত। এই উপাদানগুলো দিয়ে জীব কোষ গঠিত হলেও এরা পৃথক ভাবে জীবন্ত কিছু নয়। কিন্তু এরা ভীষণ ভাবে সক্রিয়। এরা জৈব যৌগ বা পলিমার। এই সক্রিয়তার কারণ এদের অণুগুলোর মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটতে থাকা বিভিন্ন রাসায়নিক বন্ধন ও অণুগুলোর ইলেকট্রিক বা আয়নিক চার্জের আকর্ষণ বিকর্ষণ। তবে শুধু রাসায়নিক ভাবেই এরা সক্রিয় নয়। এদের ছোট ছোট জৈব যৌগ রাসায়নিক বন্ধন বা চার্জে আকর্ষিত হয়ে যখন বৃহৎ আকার ধারণ করে তখন এরা কিছু যন্ত্র কৌশলগত কাজ করতেও সক্ষম হয়। আমরা জানি মানুষই একমাত্র যন্ত্র কৌশল আবিষ্কার করেছে এবং এই কৌশলে অনেক কিছু কাজ সম্পাদন করতে পারছে। কিন্তু জৈব যৌগ পরিসরে যে যান্ত্রিক কাজ সম্পাদন হয় সেগুলো স্বয়ংক্রিয় প্রাকৃতিক।
চর্বি বা তেল জীব দেহের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। উদ্ভিদ বা প্রাণীদেহে এই চর্বি বা তেল পাওয়া যায়। আবার জৈব ফসিল থেকেও আমরা তেল পেয়ে থাকি। চর্বি কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন এই সাধারণ তিনটি মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। কিন্তু বর্তমান প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাকৃতিক ভাবে আর এই চর্বি তৈরি হয় না। এর জন্য গবেষণাগারে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হয়। যার খরচও অনেক বেশী। তাই মানুষ আরও সহজে উদ্ভিদ বা প্রাণী বা ফসিল থেকেই চর্বি বা তেল সংগ্রহ করে থাকে।
বর্তমান প্রাকৃতিক পরিবেশে একমাত্র জীব কোষই চর্বি সহ অন্য তিনটি জৈব যৌগ গঠন করতে পারে। এখানে কোষ হল এক একটি কারখানা যেখানে অবিশ্বাস দ্রুততার সাথে প্রচুর পরিমাণে চর্বি সহ শ্বেতসার, আমিষ ও নিউক্লিক এসিড তৈরি হতে থাকে। কোষ এই উৎপাদন ক্ষমতা লাভ করেছে লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফলে। কোষের এই কারখানা সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়।
কিন্তু লক্ষ লক্ষ বছর পূর্বে পৃথিবীতে এই কোষও ছিল না। তখন পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশও ছিল ভিন্ন। প্রায় সারে চার বিলিয়ন বছর পূর্বে পৃথিবীর জন্ম। তখন সে ছিল জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড। জন্মের সিকি বিলিয়ন বছর পর পৃথিবী যথেষ্ট ঠাণ্ডা হয়ে আসে। গঠিত হয় আদি জল ও স্থল ভাগ। কিন্তু তখনো পৃথিবী শান্ত হয়ে উঠেনি। চারিদিকে অগ্ন্যূৎপাতে ও অসংখ্য পতিত উল্কাপিণ্ডে পৃথিবী ছিল অশান্ত। বায়ু মন্ডলের হালকা স্তর দিয়ে সহজেই সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি ভূ-পৃষ্ঠে এসে পড়ত।। বাতাসে তখনও অক্সিজেন ছিল না। এই পরিবেশে সমুদ্র ও জলাধারগুলোর উত্তপ্ত জলে অনেক মৌলিক ও যৌগিক পদার্থের অণু দ্রবীভূত অবস্থায় সঞ্চিত হতে থাকে। ক্ষণে ক্ষণে চমকানো বিদ্যুৎ ও অতি বেগুনি রশ্মি অণুগুলোর মধ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে থাকে। তখনকার চাপ, তাপ ও বিদ্যুতের বিশেষ পরিস্থিতিতে জলাধার গুলো হয়ে উঠে এক একটি ল্যাবরেটরি। সেখানেই প্রাকৃতিক ভাবে প্রথম জীবনের উপযোগী জৈব যৌগ গঠিত হতে থাকে। জলই জীবন। জীব দেহের সিংহ ভাগ অংশই জল। জলেই প্রথম জীবনের উপাদানগুলো গঠিত হয়েছিল। জীব কোষ জলীয় পরিবেশেই সক্রিয় থাকে। জলের অণু হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন পরমাণু দ্বারা গঠিত। অক্সিজেনের একটি পরমাণু হাইড্রোজেনের দুইটি পরমাণুর সাথে তাদের ইলেকট্রন শেয়ারের মাধ্যমে জলের অণু গঠন করে। এটি একটি শক্ত বন্ধন। জলের অক্সিজেনের অংশটি হালকা নেগেটিভ ও হাইড্রোজেন অংশটি হালকা পজিটিভ চার্জ-যুক্ত। ফলে জলের অণুতে চুম্বকের মত মেরু রয়েছে। ফলে জলের অণুগুলো পরস্পর হালকা ভাবে সংযুক্ত থাকতে পারে। অন্যান্য মৌলিক পদার্থের অণু যেগুলোর এইরূপ চার্জ থাকে তারাও জলের অণুর সাথে হালকা ভাবে সংযুক্ত থাকতে পারে এবং জলের সাথে মিশে যায়। অর্থাৎ এরা জলে দ্রবীভূত হয়ে যায়। ফলে জলে দ্রবীভূত অবস্থায় অণুগুলো নিবিড় ভাবে সংস্পর্শে আসতে পারে এবং আরও রাসায়নিক বন্ধনে অংশ নিতে পারে। আদি জলাধারে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড দ্রবীভূত অবস্থায় সঞ্চিত হয়েছিল। রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য কার্বনের রয়েছে চারটি শেয়ার করার যোগ্য ইলেকট্রন। ফলে কার্বন পরমাণু হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের অণু বা পরমাণুর সাথে বহুভাবে শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। এইরূপ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েই আদি চর্বি গঠিত হয়েছিল।
কোষের আবরণ চর্বি দিয়ে তৈরি। আদি জলাধার রসায়নগারে বিক্ষিপ্তভাবে প্রচুর চর্বি তৈরি হচ্ছিল। এর রাসায়নিক নাম লিপিড। আবরণ বা ঝিল্লী তিনটি যৌগের বন্ধনে গঠিত। তার একটি হল ফ্যাটি এসিড। এটি কার্বন ও হাইড্রোজেনের দীর্ঘ চেইন। সাথে কিছু অক্সিজেন অণুও রয়েছে।
আর দুটি হল গ্লাইসিরোল ও ফসফেট। ফসফেট যৌগে ফসফেট ও অক্সিজেন বন্ধন তৈরি করে।
এই তিনটি যৌগ রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যে বড় যৌগ গঠন করে তাকে ফসফোলিপিড বলে। এটা আবরণ ঝিল্লীর এক একটা ইটের মত। ফসফোলিপিডে পরমাণুগুলো ইলেকট্রন শেয়ারের মাধ্যমে পরস্পর বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। তাই এই বন্ধন খুবই দৃঢ়। ত্রিমাত্রিক ভাবে এর একটা আকার রয়েছে।
ফসফোলিপিডের মাথার অংশে আয়নিক চার্জ রয়েছে। তাই এরা পরস্পর আকৃষ্ট থাকে। এরা পানির অণুর দ্বারাও আকৃষ্ট হয়। আর লেজের অংশটি পানির অণু দ্বারা বিকর্ষিত হয়। ফলে মাথার অংশটি গায়ে গায়ে সংযুক্ত অবস্থায় জলের দিকে ফিরে থাকে। আর লেজের অংশটি জল থেকে দূরে সরে থাকতে চায়। লেজের অংশটি জল থেকে দূরে সরে থাকার জন্য ফসফোলিপিড দুটি স্তরে বিন্যস্ত হয়। এতে ফসফোলিপিডগুলো দ্বী-স্তর বিশিষ্ট আবরণ বা ঝিল্লী তৈরি করে।
আবরণ ঝিল্লীটি বেশ নমনীয় ও স্থিতিস্থাপক। জলীয় পরিবেশে এটা অর্ধ-ভেদ্য পর্দার মত। এর দ্বী-স্তরে আরো কিছু জৈব যৌগ প্রোথিত হয়। যেমন, কোলোস্টেরল ও প্রোটিন বা আমিষ। কোলেস্টেরল: কোলেস্টেরল অণুগুলি এলোমেলোভাবে ফসফোলিপিড দ্বী-স্তর জুড়ে থাকে, যা ঝিল্লীকে বিভিন্ন পরিবেশগত পরিস্থিতিতে তরলতার ধর্মে থাকতে সহায়তা করে। কোলেস্টেরল কার্বন ও হাইড্রোজেনের যৌগ।
প্রোটিনঃ
লিপিড আবরণে দুটি ভিন্ন ধরনের প্রোটিন রয়েছে। ইন্টিগ্রাল প্রোটিনগুলি ফসফোলিপিড দ্বী-স্তরে অবস্থিত এবং উভয় প্রান্তে আটকে থাকে। ইন্টিগ্রাল প্রোটিনগুলি লিপিড আবরণের প্রস্থ জুড়ে থাকে। এরা গ্লুকুজের মতো বৃহত্তর অণু প্রবেশ করতে দেয়। তাদের "পোলার" এবং "ননপোলার" অঞ্চল রয়েছে, যা ফসফোলিপিড দ্বী-স্তরের মেরুতার সাথে মিলে যায়।
পোলার এবং ননপোলার একটি অণুতে ইলেকট্রনের ঘনত্বকে বোঝায়। পোলার মানে ইলেকট্রনগুলি সমানভাবে বিন্যস্ত থাকে না, যার ফলে অণুর এক পাশ অন্য দিকের চেয়ে বেশি ধনাত্মকভাবে চার্জ বা ঋণাত্মক চার্জযুক্ত হয়। ননপোলার অর্থ ইলেক্ট্রনগুলি সমানভাবে বিন্যস্ত থাকে, তাই অণুটি পৃষ্ঠ জুড়ে সমানভাবে চার্জযুক্ত হয়।
অন্য শ্রেণীর প্রোটিনকে পেরিফেরাল প্রোটিন বলা হয়, যা আবরণ জুড়ে প্রসারিত হয় না। এগুলি অবিচ্ছেদ্য প্রোটিনের প্রান্তের সাথে সংযুক্ত ।
প্রোটিন হল এমিনো এসিডের মালা। এটা প্যাঁচানো অবস্থায় থাকে, ফলে এর ভিতরে ফাঁক থাকে। এই ফাঁক দিয়ে গ্লুকোজের মত বড় অণুগুলো ঝিল্লী ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করতে পারে।
আদি জলাধারে লিপিডের আবরণ বা ঝিল্লী গঠিত হওয়ার বহু পূর্বেই প্রোটিন মালার মনোমার এমিনো এসিড, শ্বেতসার পলিমার ও অন্যান্য জৈব যৌগ গঠিত হয়ে জলাধারগুলো যথেষ্ট ঘনত্ব লাভ করেছিল। চর্বির ঝিল্লী তৈরি হয় আরও অনেক পরে।
জলীয় পরিবেশে উন্মুক্ত আবরণ ঝিল্লীর দুই পাশে জলীয় দ্রবণের ঘনত্ব, তাপমাত্রা ও চাপ সমান থাকে। কিন্তু আবরণ ঝিল্লীটি যদি একটা থলের আকার ধারণ করে ভিতরের দ্রবণকে আটকে ফেলে তাহলে দু'পাশে পার্থক্য দেখা দেয়। তখন স্বাভাবিক ভাবেই অর্ধ ভেদ্য আবরণের মধ্য দিয়ে জলীয় দ্রবণের যাতায়াতের মাধ্যমে দু'পাশ সমতায় ফিরে আসতে চায়। তাই একটি আবদ্ধ থলের ঝিল্লী সব সময় সক্রিয় থাকে।
জলধারার বিভিন্ন মুখী সঞ্চালনের ফলে কখনো কখনো আবরণ ঝিল্লী থলের আকার ধারণ করে এবং এর ভিতরে জলীয় দ্রবণ সহ অন্যান্য প্রোটিন, এমিনো এসিড, নিউক্লিক এসিড, আর,এন,এ ইত্যাদি জৈব পলিমারগুলো আটকে যায়। ঝিল্লীর থলে তখন আবদ্ধ সিস্টেমে পরিণত হয়, যা জীব কোষের প্রাথমিক সিস্টেম গঠনে সহায়ক হয়ে উঠে।
প্রাথমিক থলেগুলো একই রকম অনুলিপিতে বিভক্ত হতে সক্ষম ছিল না। তাদের বিভক্তি ছিল ঝিল্লীর ক্রম স্ফীতির ফলে ছিঁড়ে যাওয়ার মত। আবরণ ঝিল্লী ও ভিতরের উপাদানগুলোর বৃদ্ধি নির্ভর করত বাইরের জৈব যৌগ গ্রহণ করার মাধ্যমে। বৃদ্ধির এক পর্যায়ে ফেটে গিয়ে দু'টি থলে তৈরি হত। এভাবে অসংখ্য থলে তৈরি হলেও থলেগুলো একই রকম ছিল না।
তবে এই ভিন্নতার জন্য থলের ভিতরের প্রোটি্ন, নিউক্লিক এসিড অসংখ্য রকম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এক একটি থলেতে এক এক রকম দ্রবণ, ঘনত্ব, তাপমাত্রা, চাপ, এমিনো এসিডের এক এক ধরণের কম্বিনেশন, রিবোনিওক্লিওটাইড, বিভিন্ন রকম প্রোটিন, প্রোটিন থেকে এনজাইম তৈরি হচ্ছিল। এ যেন প্রাকৃতিক পরীক্ষা নিরীক্ষা। লক্ষ লক্ষ বছর এই প্রক্রিয়া চলার পর এক সময় নিয়ন্ত্রিত ভাবে আর,এন,এ ও ডি,এন,এ শিকল গঠন সম্ভব হয়। এই দুইটি হলো এক ধরণের ছাঁচ, যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ভাবে বিভিন্ন প্রোটিন, প্রোটিন এনজাইম ও অন্যান্য উপাদান গঠিত হতে থাকে। আর,এন,এ নিজের ও অন্যান্য উপাদানের অনুলিপি তৈরি করতে পারে, ফলে ঝিল্লী থলিটিও ভিতরের উপাদান নিয়ে দ্বিখণ্ডিত হয়।
এই পর্যায়ে কোষের থলের ভিতরেই নিয়ন্ত্রিত ভাবে বিভিন্ন উপাদান গঠিত হয় অর্থাৎ কোষটি নিজেই উৎপাদন করতে পারে। এজন্য কোষের বাইরের কাঁচামাল ঝিল্লীর অর্ধ ভেদ্য ছাঁকনি দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। চার্জ বাহিত শক্তিও বাইরে থেকে আসে। কোষটির শক্তি সংগ্রহ, নিয়ন্ত্রিত উৎপাদন ও অনুলিপি তৈরির ক্ষমতাই জীবন চক্র। একবার শুরু হলে এই জীবন চক্র স্বয়ংক্রিয় ভাবে চলতেই থাকে। জীবন কোষের ঝিল্লী আবরণ দিয়ে বাইরে থেকে যেসব কাঁচামাল প্রবেশ করে সেগুলোকে আমরা খাদ্য বলি। কাঁচামাল ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যৌগে পরিণত হওয়াকে পরিপাক বলি। জীবন কোষের অনুলিপি তৈরির প্রক্রিয়াকে বলি বংশ বৃদ্ধি। কোন কারণে জীবন কোষ যদি বাইরে থেকে খাদ্য, জ্বালানী ও জলের সরবরাহ না পায় তাহলে সেটির কার্য্ক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থাটিকে আমরা কোষটির মৃত অবস্থা বলি।
জীবন কোষ তার অনুলিপি তৈরি করার ক্ষমতা লাভ করে RNA ও DNA পলিমার থেকে। জীবন কোষের অভ্যন্তরে DNA নিয়ন্ত্রিত ভাবে যাবতীয় অনুলিপি তৈরি করে থাকে। কিন্তু আদি জলাধারে বহু পূর্বেই, প্রায় ৪.১৭ বিলিয়ন বছর পূর্ব থেকেই RNA অনিয়ন্ত্রিত ভাবে অসংখ্য ধরণের DNA স্ব-অনুলিপি গঠন করছিল। এই স্বয়ংক্রিয় অনুলিপি তৈরি হচ্ছিল সাধারণ থেকে জটিল রাসায়নিক বন্ধনের মাধ্যমে।
ছবিতে যে আনুভূমিক লাইন দেখা যাচ্ছে, যার উপর কিছু অক্ষর সজ্জিত এটা RNA এর একটি ফিতা। এটা নিউক্লিওটাইড মৌলের একটি মালা। এক একটা অক্ষর নিয়ে এক একটা নিউক্লিওটাইড দানা গঠিত। এই দানাগুলো পরস্পর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুদীর্ঘ ফিতা তৈরি করে। চার ধরণের নিউক্লিওটাইড A C G U এই চারটি অক্ষর দ্বারা দেখানো হয়েছে। RNA ফিতাটি ২০০এর কম থেকে শুরু করে প্রায় ৫০০০ এর অধিক নিউক্লিওটাইড দিয়ে তৈরি হতে পারে। অর্থাৎ চারটি অক্ষর বিভিন্ন সংখ্যায় প্রায় প্রায় ৫০০০ টি দানা দিয়ে RNA মালা তৈরি করে। এই মালার পাশাপাশি তিনটি অক্ষর ২০টি এমিনো এসিডের যে কোন একটিকে আকৃষ্ট করে আবার এমিনো এসিডের মালা গঠন করতে পারে। বিভিন্ন ধরণের এমিনো এসিডের মালাই বিভিন্ন ধরণের প্রোটিন। চারটি অক্ষরের তিনটি অক্ষর নিয়ে এবং তিনটি অক্ষরে বিশটি এমিনো এসিডের যে কোন একটি নিয়ে লম্বা ফিতায় লক্ষ লক্ষ কম্বিনেশন হয়। আদিম জলাধারে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে লক্ষ লক্ষ কম্বিনেশনের কোটি কোটি RNA ফিতা, প্রোটিন ইত্যাদি মনোমার ও পলিমার তৈরি হচ্ছিল। RNA ফিতা দু'ভাজ হয়ে বিভিন্ন কম্বিনেশনে সংযুক্ত হয়ে জিপারের মত DNA পলিমারও তৈরি হচ্ছিল। জলীয় দ্রবণে ভেসে থাকা এইসব উপাদান ঝিল্লী থলেতেও প্রবেশ করছিল।
চিত্রে নিউক্লিউটাইডের রাসায়নিক গঠন চিত্রিত হয়েছে। এর তিনটি অংশ, একটি কার্বন গ্রুপ (সবুজ), একটি ফসফেট গ্রুপ (হলুদ) ও একটি নাইট্রোজেন গ্রুপ (গোলাপি)। নাইট্রোজেন গ্রুপ পাঁচ ধরণের, যেগুলো পাঁচটি অক্ষর A G C U T.
DNA জিপারে রয়েছে RNA-এর মত দুটি ফিতা। একটি ফিতা RNA যেটা ACGU অক্ষর দ্বারা সজ্জিত, অপর ফিতাটি ACGT অক্ষর দ্বারা সজ্জিত। একটি লম্বা ফিতার বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন কম্বিনেশনে সজ্জিত অক্ষর মালা বিভিন্ন ধরণের প্রোটিন গঠন করতে পারে। এই সজ্জাই প্রোটিন গঠনের কোড বা জীন। জিপার বন্ধ অবস্থায় DNA-এর অক্ষরগুলোর সজ্জা স্থায়ী ভাবে সংরক্ষিত থাকে। আদিম জলাধারে এইরূপ প্রচুর RNA এবং DNA-এর মজুদ ছিল। কিন্তু আবদ্ধ সিস্টেমের অভাবে সেগুলো কোন জীবন চক্র গঠন করতে পারছিল না। চিত্রে নিচের শায়িত অংশটি DNA-এর একটি উন্মুক্ত ফিতা। ফিতাটিতে T G C A G T-এর একটা সজ্জা রয়েছে। জলাধারের নিউক্লিউটাইড একটা একটা করে এই ফিতায় সংযুক্ত হয়ে সমান্তরাল আর একটি ফিতা গঠন করছে। ফলে এভাবে DNA-এর আর একটি প্রতিলিপি তৈরি হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য A শুধু T-এর সাথে এবং C শুধু G-এর সাথে বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। RNA ফিতায় T এর স্থলে থাকে U.
এই চিত্রে নীচের ফিতাটি একটি RNA ফিতা। এর তিনটি অক্ষর একটি এমিনো এসিডের দানাকে আকৃষ্ট করে। অতঃপর দানাগুলি একটার পর একটা সংযুক্ত হয়ে প্রোটিনের মালা তৈরি হয়। প্রোটিন কোষের বিভিন্ন কাঠামো গঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
আদি জলাধারে DNA ও RNA -এর পাশাপাশি প্রচুর লিপিড থলেও ছিল। এসব থলেতে DNA বা RNAও আটকা পরছিল। আবদ্ধ অবস্থায় DNA বিভিন্ন ধরণের প্রোটিন ও প্রোটিন এনজাইমও তৈরি করছিল। কিন্তু সেগুলো কোন স্বয়ংক্রিয় চক্র তৈরি করছিল না। প্রায় চার বিলিয়ন বছর পূর্বে থেকে কিছু থলের আবির্ভাব হোল যেগুলোতে বলের আকারে কুন্ডুলি পাকানো একটি DNA ফিতা অবস্থান নিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা এসব থলের নাম দিয়েছেন LUCA.
LUCA কোষের আবরণ ছিল শিথিল। তাই ভিতরের DNA-এর জিন কোষগুলোর মধ্যে সহজেই স্থানান্তরিত হত। ফলে LUCA কোষগুলো ছিল বিভিন্ন ধরণের। ক্রমে DNA উৎপাদিত প্রোটিন ঝিল্লী আবরণের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে প্রোথিত হওয়ার পর, আবরণ পোক্ত হয়ে উঠে এবং এই বিনিময় বন্ধ হয়ে যায়। কোষ হয়ে উঠে প্রকৃত আবদ্ধ সিস্টেম। আবদ্ধ সিস্টেমে DNA, যা আবার পূর্বের DNA-এর প্রতিলিপি এবং সেগুলো দ্বারা উৎপাদিত বিভিন্ন প্রোটিন ও প্রোটিন এনজাইম কোষকে স্বয়ংক্রিয় আবদ্ধ চক্রে পরিণত করে। এগুলোই আদি জীবন চক্র, যেগুলো থেকে পরবর্তীতে অসংখ্য প্রজাতি বিবর্তিত হয়েছে।
LUCA কোষ কোন নির্দিষ্ট জীবের সরাসরি পূর্বপুরুষ নয়, বরং সমস্ত জীবন্ত প্রাণীর একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ। এর মানে হল সমস্ত জীবন্ত প্রাণী LUCA কোষের সাথে পরিবর্তনের মাধ্যমে বংশগতভাবে সম্পর্কিত, কিন্তু তারা LUCA কোষের সাথে অভিন্ন নয়। সময়ের সাথে সাথে, প্রাকৃতিক নির্বাচন, জেনেটিক ড্রিফ্ট এবং প্রজাতির মাধ্যমে LUCA কোষ থেকে জীবনের বিভিন্ন বংশ বিকশিত হয়েছে। LUCA কোষ থেকে উদ্ভূত জীবনের প্রধান শাখাগুলি হল ব্যাকটেরিয়া, আর্কিয়া এবং ইউক্যারিওটস। এই ডোমেনের প্রত্যেকটির নিজস্ব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং বৈচিত্র্য রয়েছে, তবে তারা কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্যও ভাগ করে যা LUCA সেল থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
সংক্ষেপে, LUCA কোষ হল পৃথিবীর সমস্ত জীবের শেষ সর্বজনীন সাধারণ পূর্বপুরুষ। এটি একটি এককোষী প্রোক্যারিওট যা প্রায় ৪ বিলিয়ন বছর আগে একটি গরম এবং অ্যানেরোবিক পরিবেশে বাস করত। এটির একটি বৃত্তাকার ডিএনএ মৌল ছিল এবং তথ্য এবং অনুঘটকের জন্য আরএনএ ব্যবহার করেছিল। এটি অনুভূমিক জিন স্থানান্তরের মাধ্যমে অন্যান্য কোষের সাথে জিন বিনিময় করে। এটি পরিবর্তনের সাথে বংশদ্ভুত বিবর্তনের মাধ্যমে জীবনের সমস্ত বৈচিত্র্যের জন্ম দিয়েছে।
আদি ঝিল্লী কোষ কিভাবে স্বয়ংক্রিয় জীবন চক্র কোষে পরিণত হোল?
১। আদি ঝিল্লী কোষে একটি DNA ফিতার কুণ্ডলীর প্রবেশ করার পর DNA আবদ্ধ অবস্থায় নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে শুরু করে।
২। DNA এমন কিছু প্রোটিন গঠন করে যেগুলো ঝিল্লী দেয়ালে অবস্থান নিতে পারে। এই প্রোটিনগুলো ঝিল্লীর নমনীয়তা কমিয়ে দেয়, ফলে বাইরের বিক্ষিপ্ত DNA কোষে প্রবেশ করে কোষের DNA-কে সংক্রমিত করতে পারে না। ভিতরের DNA সংরক্ষিত থাকে।
৩। ঝিল্লী দেয়ালের কিছু প্রোটিন তার ছিদ্র দিয়ে বাইরের জল, বিভিন্ন জৈব উপাদান ভিতরে প্রবেশ করতে দেয়। ফলে ভিতরের জলীয় ঘনত্ব, তাপ ও চাপ নিয়ন্ত্রিত থাকে।
৪। কিছু কিছু প্রোটিন অনুঘটক জৈব উপাদানগুলোকে ভেঙে সরল মৌলে পরিণত করতে পারে। সরল মৌলগুলো DNA-এর প্রোটিন ও নতুন নিউক্লিওটাইড গঠনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই প্রক্রিয়াকে পরিপাক বলে।
৫। কিছু কিছু প্রোটিন বাইরের আয়ন চার্জ ভিতরে নিয়ে এসে বিভিন্ন কাজের শক্তির জোগান দেয়। এই প্রক্রিয়াকে শ্বসন বলে।
৬। কিছু প্রোটিন তার ছিদ্র দিয়ে ভিতরের অপ্রয়োজনীয় পদার্থ বাইরে বের করে দেয়। একে রেচন প্রক্রিয়া বলে।
৭। নতুন নিউক্লিওটাইড দিয়ে যখন DNA-এর সম্পূর্ণ প্রতিলিপি তৈরি হয়ে যায় তখন স্ফীত ঝিল্লী আবরণ নতুন DNA প্রতিলিপি নিয়ে দুই ভাগ হয়ে যায়। ফলে একটি কোষ একই রকম দুটি কোষে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়াকে বংশ বৃদ্ধি বলে।
ফলে একই বংশধারার বহু কোষ তৈরি হতে থাকে। এই প্রক্রিয়াই জীবন চক্র। তাই জীবন একটি আবদ্ধ সিস্টেমের পুনঃপনিক স্বয়ংক্রিয় সক্রিয়তা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রোটিন অনুঘটক কোষের ভিতরের জলীয় দ্রবণে মৌলগুলোর মধ্যে অসংখ্য ধরণের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে ও আয়নিক চার্জ সঞ্চালিত করে কোষকে সক্রিয় রাখে। প্রোটিন কোষকে সক্রিয় রাখার জন্য আরও বহুবিধ কাজ করতে পারে।
ঝিল্লী দেয়ালে প্রোথিত কিছু কিছু প্রোটিন বাইরের দিকে সূতার মত বেড়িয়ে থাকে, ফলে কোষের আবরণের বাইরের দিকটা রোম যুক্ত মনে হয়। এগুলো কোষকে পরিবেশের নিরাপদ স্থানে আটকে রাখে।। এগুলো অনেকগুলো কোষকে পরস্পর গুচ্ছ-বদ্ধ ভাবেও থাকতে সহায়তা করে।
জীবন চক্র কোষের সক্রিয়তার জন্য প্রোটিনের অবিশ্বাস্য ভূমিকাঃ
RNA-এর প্রভাবে তৈরি প্রোটিনের আশ্চর্য গুণাবলি রয়েছে। প্রোটিন হোল বিশ প্রকার এমিনো এসিড দানার কম্বিনেশনে তৈরি ছোট বড় বিভিন্ন মাপের মালা। বিভিন্ন মাপের ও এমিনো এসিডের দানার বিভিন্ন কম্বিনেশনের সজ্জা অসংখ্য ধরণের প্রোটিন তৈরি করে। এই মালা আবার এমিনো এসিডের সজ্জার ভিন্নতা অনুযায়ী পরস্পর সংযুক্ত হয়ে বিভিন্ন আকার, আকৃতির কুণ্ডলী তৈরি করে। কুণ্ডলীর ভিতরে আবার বিভিন্ন আকার ও আকৃতির ফাঁক ফোঁকর তৈরি হয়, যেখানে এমিনো এসিডের আয়ন উন্মুক্ত থাকে। এই খাঁজগুলো টেম্পলেট হিসেবে কাজ করে এবং অণু পর্যায়ের খাঁজ অনুযায়ী বিভিন্ন যৌগ মৌলকে আটকে রেখে সেগুলোকে সংশ্লেষণ বা বিশ্লেষণ বিক্রিয়ায় সাহায্য করে। ফলে বিভিন্ন প্রোটিন এনজাইম হিসেবে কাজ করে বিভিন্ন ধরণের পলিমার তৈরিও করতে পারে অথবা সেগুলোকে ভাঙ্গতেও পারে।
কোন কোন প্রোটিনের উন্মুক্ত খাঁজে আয়ন চার্জের বিন্যাস বাইরের পরিবেশ তথা আলো, তাপমাত্রা, কম্পন অথবা কোষস্থ তরলের আয়নিক পরিবেশের তারতম্যের কারণে অত্যন্ত সেন্সেটিভ থাকে। এগুলো সেন্সর হিসেবে কাজ করে। পরিবেশের তারতম্য অনুযায়ী বিন্যস্ত আয়ন চার্জ আবার বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগ উৎপাদন করে। সেগুলো কোষে হরমোন হিসেবে কাজ করে এবং কোষের বিভিন্ন স্থানে এর প্রভাব ছড়িয়ে দেয়।
পরিবেশের বিভিন্ন সিগন্যাল বা বার্তা RNA-এর অব্যবহৃত অক্ষরগুলোর বিন্যাসেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ফলে প্রোটিনের কোড তৈরি হয়, যেগুলো পরিবেশের সিগন্যাল অনুযায়ী পরবর্তীতে হরমোনও তৈরি করতে পারে।
হরমোন পরিবেশের কোন সিগন্যালে কিরূপ সক্রিয়তা দেখাবে তা নির্ধারণ করে। এভাবে DNA কোন পরিবেশে কখন কোন প্রোটিন তৈরি করবে বা কখন কোন প্রোটিন তৈরি বন্ধ রাখবে সেটাও নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়। ফলে এই অংশগুলো এক প্রকার স্মৃতি সংরক্ষণেরও কাজ করে।
আদি কোষে যে RNA ফিতা ছিল সে প্রথমে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে প্রোটিন ও প্রোটিন অনুঘটক তৈরি করতে থাকে। সেখান থেকে এক প্রকার প্রোটিন কোষের ঝিল্লী দেয়ালে অবস্থান নেয় এবং ঝিল্লী দেয়ালকে পোক্ত ও প্রায় অভেদ্য করে তোলে। এই অবস্থায় শুধুমাত্র প্রোটিনের ছিদ্র দিয়ে নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় প্রয়োজনীয় জৈব মৌল সমূহ ভিতরে বাহিরে যাতায়াত করতে পারত। আবরণ পোক্ত হওয়ায় কোষের স্থায়িত্ব বহুগুণ বেড়ে যায়। সময়ে আবার কিছু প্রোটিন তৈরি হোল যেগুলো রাইবোজোম অনুঘটক। এরা RNA -এর ফিতার সাথে আটকে থেকে আরও দক্ষতার সাথে এমিনো এসিডের দানা একত্রিত করে প্রোটিন উৎপাদনে সক্ষম হোল। RNA ফিতা উন্মুক্ত থাকায় এর বাঁধন ছিল দুর্বল। ফলে লম্বা ফিতা ছিঁড়ে গিয়ে কোষের ভিতর একাধিক ছোট ছোট ফিতা তৈরি হচ্ছিল। কালক্রমে RNA ফিতা ভাঁজ হয়ে যখন সংযুক্ত DNA ফিতায় পরিণত হোল তখন স্থায়িত্বও বেড়ে গেল। DNA -এর জোড়া ফিতায় আটকে পরা অক্ষরের কোড সুরক্ষিত রইল। এই অবস্থায় কোষস্থ তরলে ভাসমান ফসফোলিপিড মোনোমার DNA কুণ্ডলীর চারিদিকে জড় হয়ে সেখানে আর একটি থলে তৈরি করল, ফলে DNA -এর সুরক্ষা আরও বেড়ে গেল। এই আবরণের গোলককে কোষের নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্র বলা হয়। কিছু প্রোটিন তৈরি হোল যেগুলো কোষস্থ তরলে ভাসমান অপ্রয়োজনীয় জৈব যৌগ ভেঙে DNA ও প্রোটিন গঠনের কাঁচামাল তৈরি করতে পারে। এই সকল প্রয়োজনীয় প্রোটিনের কোড DNA -এর জোড়া ফিতায় সংরক্ষিত থাকল। ফলে নির্জীব ঝিল্লী কোষ ধীরে ধীরে সক্রিয়, পরিবেশের প্রতি সেন্সেটিভ, নিজের প্রতিলিপি তৈরিতে সক্ষম এবং স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠল।
(চলবে)