একদিন সৈকত আহসানউল্লাহ হলের ক্যান্টিনে সকালের নাস্তা করতে এসে হৈ হুল্লুরের মধ্যে পরে গেল। আহসানউল্লাহ হল আর হলের ক্যান্টিন একদিকে বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা, অন্য পাশে নজরুল ইসলাম হল ও তার ক্যান্টিন। প্রতিদিন সকালে ক্লাসে যাওয়ার আগে এই ক্যান্টিনে তিন রুমমেট নাস্তা করতে আসে। দুই পিস ব্রেড টোস্ট আর ডিম পোশ অথবা পরোটা ভাজি নিত্যদিনের আইটেম। দুইটি ক্যান্টিন আর তার চার পাশের খোলা জায়গা ও বাগান মিলিয়ে বেশ বড়সড় একটি এরিয়া। বাইরে রাস্তার দিকে একটা গেট আছে যা দিনের বেলা খোলাই থাকে। এই টেরিটরিতে একদল কুকুরের বাস। ছাত্রদের আদর আর ক্যান্টিনের পরিত্যক্ত লেহ্য পেয় পেয়ে তারা বেশ আনন্দেই দিন কাটায়।
আজ সকালে ক্যান্টিনের এই চত্বরে বাহিরের একদল কুকুর ঢুকে পড়ে। ব্যস আর যায় কোথায়? এই টেরিটোরির স্থায়ী বাসিন্দা কুকুরগুলো তাদের উপর হামলে পড়ল। বেঁধে গেল তুমুল যুদ্ধ। চত্বরের টোকাই ছেলেরাও তাদের বন্ধু কুকুরদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে গেল। তুমুল হৈ চৈ আর হট্টগোল।
এই হট্টগোল মাথায় নিয়েই তিন রুমমেট সকালের নাস্তায় মনোযোগ দিল।
তিন রুমমেট চিন্তা ভাবনায় তিন জগতের মানুষ। সৈকত কোন এক আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির ওপেন গণসংগঠনের সক্রিয় কর্মী। ক্লাস করতে করতে হঠাত উধাও হয়ে যাওয়া তার স্বভাব। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হলেও চাল চলন বেশ ভূষায় প্রলেতারিয়েত ছাপ।
মোতালেব মফস্বলের মেধাবী ছাত্র। দিনে ক্লাস ও অধিক রাত পর্যন্ত তাকে পড়ার টেবিলেই দেখা যায়। ছাত্রদের মিটিং মিছিলে তার আগ্রহ নাই। প্রতিদিন বিকেলে টাইট শার্ট, ইস্ত্রি করা বেলবটম পেন্ট ও ব্রাশ করা লম্বা চুল নিয়ে সে ফুলার রোড ধরে শামসুননাহার হল ও জগন্নাথ হলের মাঝখানের সরু পথ ধরে টিএসসি পর্যন্ত হাঁটতে বের হয়। শামসুননাহার হলের খোলা বারান্দার মেয়েগুলোই তার প্রধান আকর্ষণ।
তিন জনের মধ্যে সুভাষ দা ছিলেন সবার সিনিয়র। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একজন সক্রিয় পাতি ছাত্র নেতা। মুখে সর্বদা স্নেহ মাখা হাসি লেগেই থাকে। ক্লাসের পাঠ বা উপস্থিতির কোন বালাই নাই। ছাত্রত্ব ধরে রাখার জন্য একই ক্লাসে বছর তিনেক ধরে আছেন। সকালের নাস্তার টেবিলে এই তিন জনের হালকা কথোপোথন বেশ কৌতুক জনক।
--- আজ রাতে প্রিন্সেস ডায়নার ড্যান্স আছে! মোতালেবের চোখ মুখে উজ্জ্বলতা। আড় চোখে সুভাষ দাকে দেখে নিয়ে সৈকতের কানের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করে--- যাবি?
আজকাল ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় রাতের বেলা হাউজি সহ অর্ধ নগ্ন যুবতীদের উত্তাল নৃত্যের প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। এদের নামের পূর্বে টাইটেল থাকে প্রিন্সেস। রাতের বেলা একদিকে হাউজি আর অন্যদিকে প্রিন্সেসদের উত্তাল নৃত্য ঢাকার সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে।
--- জব্বর মাল! বুকে আর কোমরে শুধু সরু ঝালর... আর কিছু থাকে না। কোমর আর বুক দুলিয়ে ঝাকানাকা ড্যান্স... পুরাই গরম। আমরা আরও কয়েকজন যাব।
এইসব অপসংস্কৃতিতে সৈকতের কোন আগ্রহ নাই। বরং সে চত্বরের কুকুরদের সামাজিক জীবন যাপন লক্ষ্য করতে বেশি আগ্রহী। হল থেকে ক্যান্টিনে আসার পথে একপাশে একটি টং দোকান। ছাত্ররা সময় অসময়ে বিড়ি সিগারেট ও প্রয়োজনীয় টুক টাক দ্রব্যাদি এখান থেকেই সংগ্রহ করে। ছোট পায়ার পাটাতনের উপরে দোকান, তার নীচে একটি মা কুকুর বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে সংসার পেতেছে। পাঁচ ছয়টি ছানা প্রায়ই বাইরে রোদে এসে হুটোপুটি করে বেড়ায়। দলে আরও কয়েকটি ছোট বড় বিভিন্ন বয়সী কুকুর রয়েছে। বড়সড় পুরুষ কুকুর তাদের সর্দার, সর্বদা দলের পাহাড়ায় সতর্ক। তবে দলের সবাই মা কুকুরটির অনুগত। খাবারের খোঁজে সে যেখানে যেখানে যায়, সবাই তাকে অনুসরণ করে। খাবার পেলে প্রথমে সর্দার ধেড়ে ও মা তাদের অংশটুকু খেয়ে নেয়। তারপর হায়ারিকি অনুযায়ী অন্যরা ভাগ পায়। কেউ হায়ারিকি ব্রেক করে ঝগড়া ঝাটি শুরু করলেই সর্দার কুকুরটি কড়া হস্তে তাদের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে।
---- তোমরা আর মানুষ হইলা না। মোতালেবের কথা শুনে ফেলে সুভাষ দার কণ্ঠে বিরক্তির সুর। পাতলা রুটির একটি বড় টুকরোর ভাঁজে চানার ডাল কৌশলে পুরে তিনি মুখে চালান দিতে দিতে বলেন,
--- আজ বিকেলে আমতলায় স্বৈরাচার বিরোধী মিছিল আছে। তোরা সব সেখানে আয়।
---- আমি তো যাব। সৈকত সায় দেয়। মোতালেব চুপসে যায়।
সুভাষ দা ক্যান্টিন বয় জামালকে কাছে ডেকে বেশ স্নেহ মাখা কণ্ঠে তাদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন, রং চায়ের অর্ডার দিয়ে তাদেরকেও বিকেলে মিটিং-এ যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। সুভাষ দার আহ্বানে শুধু জামাল নয়, তার সহকর্মীরাও নেতার সাথে কুশল বিনিময়ের জন্য এগিয়ে আসে। সুভাষ দা উৎসাহিত হয়ে স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করার জন্য সবাইকে একসাথে আন্দোলন করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটা নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে ফেলেন।
স্বাধীনতার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে অস্থিরতা চলছে। ছাত্ররা গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চায়। সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার চরম বিরোধী তারা। শুধু ছাত্ররা কেন দেশের সকল যুব সমাজের মধ্যে একটা বিদ্রোহী ভাব। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা বিদ্রোহী। ভদ্রলোক বাঙালী যুবকের বেশভূষা ছেড়ে তারা জিপসি সেজেছে। মাথায় লম্বা চুল, কাঁধে ঝোলা হাতে গিটার নিয়ে সমাজ সংস্কৃতিকেই বদলে ফেলতে চায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে চত্বরে তারা চিৎকার করে গাইছে,
--- ওরে ছালেকা, ওরে মালেকা...
গান, নাটক, কবিতা, শর্ট-ফিল্ম সর্ব ক্ষেত্রেই ভাঙন আর এক্সপেরিমেন্ট চলছে। ছাত্রদের গ্রুপে গ্রুপে চলছে সমাজ, দর্শন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ, বিতর্ক, সেমিনার। লিটল ম্যাগাজিন, সাময়িকী, অর্ধ-সাময়িকী, পত্র পত্রিকায় দেশ ছেয়ে গেছে। জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন আতেল গ্রুপ।
একদিকে গুরু আজম খানের হাত ধরে পপ গান, অন্যদিকে বামপন্থী সাংস্কৃতিক সংগঠনের গণসংগীত, কাঁধে ঝোলা খসরু ভাইয়ের শর্ট ফিল্ম আন্দোলন, আবদুল কাইয়ুমের পথ নাটক, থিয়েটারের মঞ্চ নাটক; রনবী স্যারের টোকাই কার্টুন, রাশার ভাস্কর্য, শিশিরের ব্যঙ্গচিত্র; সংস্কৃতি, বিতর্ক, প্রাক্সিস জার্নালে সমাজের চুলচেরা বিশ্লেষণ; এরও পূর্বে সিরাজ সিকদার, চারু মজুমদার, দেবেন সিকদারদের রাজনীতি, যুদ্ধ বিধ্বস্ত চাল চুলা-হীন নবীন বাংলাদেশ নিয়ে হাজারো পরীক্ষা নিরীক্ষা।
‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় তার।…’ হেলাল হাফিজের কবিতা ভার্সিটির যুবকদের উন্মাদ করে তুলছে। গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশ নিচ্ছে হাজারো তরুণ।
গণতান্ত্রিক সংগ্রামে সমর্থন থাকলেও তাতে যে জনগণের মুক্তি মিলবে না, এই মতের সমর্থনে সৈকতের ভিন্নমত রয়েছে। তাই সে সুভাষ দার বক্তৃতায় আকৃষ্ট না হয়ে কুকুরদের প্রতি মনযোগী হয়ে উঠে।
কুকুর দলের মধ্যে এক যৌবনবতী সুডৌল যুবতী রয়েছে। যুবক কুকুরগুলো তার পেছনে ঘুরঘুর করে। যুবতিটি সারা বাগানময় তাদের নাচিয়ে বেড়ায়। একবার কিছুক্ষণের জন্য একে শুঁকতে দেয় তো দৌড়ে গিয়ে আরেকটাকে কিছুক্ষণের জন্য ড্যান্স করতে দেয়। মোতালেবের বর্ণনায় প্রিন্সেস ডায়নার কোমর দোলানোর সাথে এর মিল রয়েছে। মিল রয়েছে যুবক কুকুরদের যৌন আগ্রহের সাথে মোতালেবের কুতকুতে আগ্রহের। মোতালেবের দেহের ভিতরে যেন এক কুকুরের বাস। প্রতিদিন হলের ডাইনিং রুমের দরজা খোলার সাথে সাথে একদল মোতালেব হুরমুর করে সবচেয়ে বড় মাংসের টুকরার বাটি দখলের জন্য দৌড়ে যায়। বিকেলে পরিপাটি সেজে মেয়ে হোস্টেলের সামনে মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। খাদ্য ও নারী তাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য। ভবিষ্যতে সুন্দরী বউ, বাড়ি গাড়ি, ভাল খাবার দাবার পাওয়ার লোভেই এত কষ্ট করে পড়াশুনা।
শুধু ডায়নার ড্যান্সই নয়। পুরাণ ঢাকার কোন এক পট্টিতে নীল ছবির প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। মোবারকরা সেখানকার নিয়মিত দর্শক। গভীর রাত অবধি ছবি দেখে তারা হলে ফিরে এসে বিছানায় গামছা পেতে ঘুমুতে যায়।
--- এই তোরা বিকেলে আসিস, বলে সুভাষ দা চলে যায়। ১২০ নং রুমে ছাত্র ঐক্য পরিষদের গোপন বৈঠক আছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির হলগুলো তখন মোটেই নিরাপদ নয়। চারিদিকে টিকটিকির ছড়াছড়ি। তাই বুয়েটের বিভিন্ন হলে তারা গোপন বৈঠক করে।
সুভাষ দা চলে যাওয়ায় মোতালেব দ্বিগুণ উৎসাহে সৈকতকে নীল ছবির বর্ণনা দিতে উদ্যত হয়। সৈকতের ধর্য্য আছে বলা যায়। সাধারণ মানুষকে উচ্চতর লেভেলে উঠাতে হলে প্রথমে তাকেই নীচের লেভেলে নামতে হবে। তাই সে বিরক্ত হয় না।
--- শুন, এইসব অপ সংস্কৃতি। বুর্জোয়া শাসক-গুষ্ঠি জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে এইসব অপসংস্কৃতি আমদানি করেছে। আমাদের প্রগতিশীল সংস্কৃতি প্রচার করতে হবে।
--- শুধু খাওয়া, ঘুমানো আর সেক্স করাই মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য নয়। তাহলে পশুদের সাথে মানুষের আর পার্থক্য কোথায়? সমাজের জন্য কিছু অবদান রাখাই জীবনের সার্থকতা।
--- রাখ তোর অপসংস্কৃতি! মোতালেব মাঝপথে সৈকতের সমাজ বিজ্ঞানের পাঠ থামিয়ে দেয়।
সৈকত অগত্যা কুকুর সমাজের প্রতিই আগ্রহী হয়ে উঠে।
বাগানে বড় বড় ইঁদুরদেরও আবাস স্থল রয়েছে। মাটির তলদেশে গর্তের শহরে তাদের বাস। মাঝে মাঝে কুকুরের দলটি ইঁদুর শিকারে বের হত। মাটি শুঁকে শুঁকে তারা বাগানে ছড়িয়ে পড়ত। তাদের পদ চারণায় কোন ইঁদুর আস্তানা ছেড়ে বের হলেই হল, কুকুরগুলো দল বেঁধে এদিক থেকে ওদিকে তাড়া করে ইঁদুরটিকে ধরে ফেলত। এই শিকার কর্মে মা কুকুরটিই নেতৃত্ব দিত, অন্যরা থাকত সহযোগী হিসেবে। মা প্রথমে শিকারের মাথা খেয়ে নিত, তারপর নিয়ে আসত ছানাদের কাছে। ইঁদুরটির নরম অংশ ছানাদের প্রাপ্য। অন্য বয়সীরা ধর্য্য ধরে অপেক্ষা করত। ছানাদের খাবার কেড়ে না নেয়াই ছিল তাদের সমাজের নিয়ম।
সৈকত কুকুর সমাজের নিয়ম শৃঙ্খলা দেখে অবাক হয়। ক্যান্টিনের টেরিটরিতে কয়েকজন টোকাই জাতীয় মানব শিশুও আছে। রাতের বেলা খোলা বারান্দার ছাদের নীচে তারা ঘুমায়। দিনের বেলা ফেলে দেয়া খাবারের টুকরো তাদের ক্ষুন্নি বৃত্তির একমাত্র উপায়।। ক্যান্টিনে অনেক খাবার থাকলেও টোকাই শিশুরা সেই খাবারের ভাগ পেত না। মানুষের সমাজ এত মহান নয়! আইন দিয়ে মানুষকে শৃঙ্খলায় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু কুকুরদের সমাজে কোন আইনের প্রয়োজন হয় না।
তবে টোকাই সমাজে কোন আইন না থাকলেও তারা কিন্তু সুশৃঙ্খল এবং মহত্বের পরিচয়ও তাদের আছে। কারণ তারা অনেকটা আদিম মানুষদের কাছাকাছি। সমাজের অত শত আইন কানুন, রীতি নীতি তারা জানে না। ক্যান্টিনের উচ্ছিষ্ট খাবার কুরিয়ে পেলে তারা সবাই মিলে ভাগ করে খায়। কুকুরগুলোও তাদের বন্ধু, খাবারের কিছু ভাগ তারাও পায়। রাতে বারান্দায় তারা এক সাথেই ঘুমায়।
--- দ্যাখ, আমরা শ্রেণী বিভক্ত সমাজে বাস করছি। বুর্জোয়া শ্রেণী তাদের শাসন শোষণকে বজায় রাখার জন্য অপ সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এই অপ সংস্কৃতি আমাদের রুখতে হবে। আমাদের প্রচার করতে হবে গণ সংস্কৃতি।
সৈকত হাল না ছেড়ে মোতালেবকে আবার বোঝাতে চেষ্টা করে,
--- দ্যাখ, সমাজ পরিবর্তনশীল। শ্রমজীবী শ্রেণী এই পরিবর্তনের মূল শক্তি। তারা সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আমাদের তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। একটি শোষণহীন বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তুলতে হবে।
টোকাই সমাজে কোন আইন নেই, নেই তেমন সামাজিক রীতিনীতি। ক্যান্টিন চত্বরে ছেলে মেয়ে মিলিয়ে প্রায় আট জনের একটি টোকাই দল রয়েছে। খাওয়া, ঘুমানো ও ছাত্রদের ফাই ফরমাইস খাটার পর তারা যে খেলা ধূলায় মেতে থাকে সেখানে তাদের সামাজিক রীতিনীতির পরিচয় পাওয়া যায়। তারা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। ঝগড়া ঝাটি রয়েছে কিন্তু সেটা যৌন সম্পর্কিত গালা গালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই বয়সেই যৌন রহস্য তাদের অজানা নেই, বরঞ্চ এটা তাদের কাছে একটা কৌতুক। এর অনুকরণ তাদের খেলারই একটা অংশ এবং গালাগালিরও অংশ।
সমাজকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি একেক জনের একেক রকম। মুক্তিযুদ্ধের সময় সৈকত ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়ে। যুদ্ধ সে দেখেছে। যুদ্ধের পর সে দেখেছে ধ্বংস প্রায় বাংলাদেশের সমাজ-চিত্র। সে দেখেছে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ। সে দেখেছে মানুষের চরম দুর্ভোগ, নিরাপত্তা-হীনতা, অ-সহিষ্ণুতা, মানুষের ক্রূরতা।
ঢাকা শহর তখন আউট ল শহরে পরিণত হয়েছে। সৈকত দেখেছে রাস্তার পাশে কংকালসার মানুষ ঘাস খাচ্ছে, ডাস্টবিন ঘিরে মানুষে কুকুরে লড়াই, চুরি পকেটমার ছিনতাই, মোরে মোরে একদল হিংস্র মানুষের গণপিটুনি দিয়ে মানুষ খুন; রেল লাইন, রাস্তার পাশে ছিন্নমূল মানুষের সারি সারি বস্তি, হাইকোর্ট মাজার, চাংখার পুলে গাঁজা হিরোইন চরসের নেশায় বুঁদ মানুষ।
অন্যদিকে শাসন ক্ষমতায় চলছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর দখল পাল্টা দখলের নাটক। কু পাল্টা কু, হত্যা, জেল হত্যার যজ্ঞ। রিলিফ চুরি, রেশন চুরি, লাইসেন্স, পারমিট, ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে নব্য ধনিক শ্রেণীর উত্থান।
সমাজের এইরূপ ভাঙনের ফল স্বরূপ ছাত্র সমাজের মধ্যে প্রতিবাদী ধারা ও নব্য বণিক ধারা গড়ে উঠছে।
মোতালেবের কান দিয়ে এইসব তত্ত্বকথা যাচ্ছে না। তার চোখে এখনও প্রিন্সেস ডায়নার ঘোর। তার চোখ ডায়নার স্ফীত বক্ষের দিকে স্থির হয়ে আছে। দেশে ফেলে আসা প্রেমিকার দেহের গড়ন প্রিন্সেস ডায়নার সেক্সি দেহের কাছে কিছুই নয়। তারপরেও পাড়ার ছেলেরা তার পিছনে ঘুর ঘুর করে। প্রেমিকারও নিশ্চয়ই এতে সায় রয়েছে। ফলে একটা সূক্ষ্ম প্রতিহিংসার তাড়না সব সময় তাকে তাড়া করে ফিরছে। প্রতিপক্ষ সকল পুরুষদের পুরুষ হওয়ার প্রতিযোগিতায় হাড়িয়ে দিতে হবে। তাকে যে করেই হোক যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। সমাজ যেখানেই থাকুক সেই সমাজের টপ হওয়াই তার জীবনের লক্ষ্য।
যুবক কুকুরটির দলের যুবতীদের পিছনে ঘুর ঘুর করা ধেড়ে কুকুরটি মেনে নিতে পারে না। সুন্দরী যুবতিটিও তাকে প্রায় অবজ্ঞা করে চলছে। যুবক যুবতীর অবাধ্যতা দলের অন্যান্যদেরও প্রভাবিত করছে। একটা চাপা যৌন হিংসা যেন দলে ছড়িয়ে পড়ছে। সৈকত অবাক হয়ে দেখল খাবার নিয়ে হিংসার চেয়ে যৌন হিংসার প্রভাব সমাজে বেশী। সেটা কুকুর সমাজেই হোক বা মনুষ্য সমাজে! যৌন হিংসা কুকুর সমাজে কলহের মূল উৎস। সমাজে অন্যান্যদের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য অর্জনের তাড়না নারীদের উপর নিজের অধিকার সুরক্ষিত রাখার তাড়নার সাথে সম্পর্কিত। মানুষের পরিবারেও একই ঘটনা। বরঞ্চ মনুষ্য সমাজে এই প্রভাব আরও সুতীব্র, বিভিন্ন প্রথার মাধ্যমে নারীদের পুরুষদের অধীনস্থ করে রাখার কৌশল কুকুরদের জানা নেই। আধিপত্য অর্জনের এই তাড়না পরিবার থেকে সমাজে, সমাজ থেকে রাজনীতিতে সম্প্রসারিত হয়েছে।
ধেড়ে কুকুরটি প্রায়ই দাঁত মুখ খিঁচিয়ে যুবকটির সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। কিন্তু তার শারীরিক শক্তি এমন নয় যে যুবকটিকে দল থেকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হবে। এই পরিস্থিতিতে তার মন মেজাজ সব সময় তিরিক্ষি হয়ে থাকে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সে দলের অন্যান্য সদস্যদের উপরেও চড়াও হয়। দলে এই বিশৃঙ্খল অবস্থায় মা কুকুরের পক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে তার সন্তানদের লালন অসম্ভব। তাই ধেড়ে কুকুরটার ওপর সেও ক্ষুণ্ণ। ফলে কুকুর সমাজে অস্থিরতা থেকেই যায়।
কয়েকজন ছাত্র সৈকতদের টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো।
--- সৈকত ভাই, অবস্থা বেশী ভাল নয়।
তাদের একজন চাপা স্বরে খবরটা দিল। তাদের চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা।
--- আম তলার মিটিং-এ আজ হামলা হতে পারে। পুরো ভার্সিটিতে অস্থিরতা।
মোতালব এসবের মধ্যে নেই। চা খেয়ে সে চলে গেলে ওরা চেয়ার টেনে বসে পরে।
ছেলেগুলোর চোখ লাল, মনে হয় রাতে ঘুম হয়নি।
--- লিফলেট ছাপা শেষ? সৈকত তাদের জিজ্ঞেস করে। ছেলেরা ঘার নেড়ে হা সূচক সায় দেয়।
আমতলার সমাবেশে লিফলেট ছড়াতে হবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শ্রেণি-দ্বন্দ্বে পরিণত করার আহ্বান লিফলেটে রয়েছে। সাথে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক শ্লোগান।
স্বৈরাচারী আধিপত্য পুরো সমাজকেই অশান্ত করে তুলেছে। সৈকত লিফলেটগুলো কোন সমাবেশে কিভাবে বিতরণ করতে হবে তার পরিকল্পনায় বসে গেল। পরিকল্পনা শেষে তারা আমতলার উদ্দেশে রওনা দিল।
কুকুর দলে যুবক কুকুরটির প্রতি অন্যান্য সদস্যদের সমর্থন বাড়তে থাকে। এই সময় বহিরাগত কুকুরদের হামলা যুবকটির শক্তিমত্তা ও নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ এনে দেয়। সে তার অনুগত সাথীদের নিয়ে বিপুল বিক্রমে বহিরাগতদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আমতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় ছাত্রদের বিপুল সমাবেশ ঘটে। সভা শেষে ছাত্ররা মিছিল নিয়ে শিক্ষা ভবনের দিকে রওনা হয়। সেখানে দাঙ্গা পুলিশ ব্যারিকেড দিয়েছে। ছাত্ররা ব্যারিকেডের সামনে গিয়ে শ্লোগান দিতে থাকে। ব্যারিকেড সরিয়ে ছাত্ররা সেক্রেটারিয়েটের দিকে যেতে চায়। পুলিশ অনড়, তারা আর এক কদমও এগুতে দিবে না। হঠাত পুলিস গুলি ও টিয়ার শেল ছুরতে থাকে। মুহূর্তে পুরু এলাকাটি রণক্ষত্রে পরিণত হয়। ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে কার্জন হলের চত্বরে ঢুকে সেখান থেকে ইট পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। পুলিশ ব্যারিকেড পেরিয়ে ছাত্রদের উপর চড়াও হয়। শুরু হয় লাঠিপেটা ও গুলি। সন্ধ্যা পর্যন্ত ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার পর ছাত্ররা পুলিশের বিরুদ্ধে পেরে না উঠে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। একদল ছাত্র কার্জন হলের পিছনের রাস্তা ধরে গুলিস্তানের দিকে এগিয়ে যায়। বাকীরা পুলিশ ধাওয়ায় আমতলায় ফিরে আসে। আমতলায় ছাত্র নেতারা এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে পরদিন থেকে লাগাতর ধর্মঘটের ঘোষণা দেয়। পুলিশ রিজার্ভ ফোর্স বৃদ্ধি করে ভার্সিটি ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ে। এই অবস্থায় ছাত্ররা কাঁটাবন, নিউমার্কেটের দিকে পালাতে থাকে। পুলিশের গুলাগুলিতে প্রায় ছয়জন ছাত্র নিহিত হয়েছে। আহত ও গ্রেফতার হয়েছে শতাধিক।
সন্ধ্যার পর সৈকতরা বিধ্বস্ত অবস্থায় একে একে ক্যান্টিনে ফিরে আসে। সামরিক সরকার রাতের মধ্যেই সকল ছাত্রাবাস খালি করার ঘোষণা দিয়েছে। রাতে রেইড ও ধর পাকড়ের আশংকা রয়েছে। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা হল ছেড়ে সরে পড়বে। যুদ্ধ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। এই সরকারকে উচ্ছেদ না করা পর্যন্ত সংগ্রাম চলবেই। নতুন দিনের বার্তা নিয়ে তারা আবার হলে ফিরে আসবে।
কুকুর দলের যুদ্ধ থেমে গেছে অনেক আগেই। বহিরাগতরা পরাজিত হয়ে চত্বর ছেড়ে পালিয়েছে। যুদ্ধের সুযোগে ধাড়ি কুকুরটিকেও তাড়িয়ে দিয়েছে যুবকেরা। এখন যুবক কুকুরটি দলের নেতৃত্ব নিয়েছে। দলে ফিরে এসেছে প্রাণ চাঞ্চল্য, শান্তি ও শৃঙ্খলা। কুকুরদের যুদ্ধে অনেকে আহত হলেও কেহ নিহিত হয়নি। স্বজাতির কাউকে নিহিত করার নিয়ম কুকুর সমাজে নাই। মানুষের মত অমানবিক তারা নয়।