somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কে এই সিক্তবসনা...?

১১ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ময়মনসিংহের গচিহাটার মজুমদারবাড়ি। সাত আট বিঘা জমি, বসতবাড়ি, ধানের গোলা ছাড়িয়ে সামান্য এগোলেই টল-টল করছে পুকুর, পাশে বাঁশঝাড়, মাঝেমধ্যেই দুলে উঠছে হাওয়ায়। আবহে ভাসছে তাদের শিরশিরে পত্রালাপ। সকাল থেকে নিঝুম দুপুর জুড়ে এমনটাই চলতে থাকে। এরই মাঝে গাছগাছালির আলোছায়ার আলপনা গায়ে মেখে বাড়ির বউ-মেয়েরা পুকুরে স্নান সেরে ভিজে কাপড় জড়িয়েই ঘরে ফিরে যায়। এ তো সে কালের গ্রাম-বাংলার রোজকার দৃশ্য। তবু এ নিয়ে কেউ তো সে ভাবে ছবি আঁকেননি। মজুমদারবাড়ির একমাত্র শিল্পী হেমেন্দ্রনাথের মাথায় ঘুরতে থাকে বিষয়টা। এক দিন সময় সুযোগ করে পুকুরধারে তাঁর সদ্য-বিবাহিতা রূপসি স্ত্রী সুধারানিকে ভিজে কাপড়ে দাঁড় করিয়ে, বসিয়ে বেশ কিছু ছবি তুলে ফেললেন নানা বিভঙ্গে। হেমেন মজুমদার তাঁর ছবি আঁকার প্রয়োজনে ফোটোগ্রাফের সহায়তা নিতেন। কিন্তু তিনি দস্তুর মতো জানতেন, ফোটোগ্রাফকে হুবহু ‘কপি’ করাটা কারিগরের কাজ। শিল্পীর নয়। ‘এই পরিদৃশ্যমান জগতে যা দেখব যদি তাই আঁকি তবে তার কি প্রয়োজন?’

বেশ কিছু দিন হল হেমেন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাস পড়া শেষ করেছেন। সেখানে ‘রোহিণী’ চরিত্রটি তাঁর মনে সবিশেষ ছাপ ফেলেছে। এই রোহিণী হেমেন্দ্রনাথের বহু ছবিতেই সচেতন এবং অবচেতন ভাবে ঢুকে পড়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রোহিণী প্রসঙ্গে লিখছেন: ‘রোহিণীর যৌবন পরিপূর্ণ’, সে বিধবা কিন্তু তার ‘অধরে পানের রাগ, হাতে বালা, ফিতে পেড়ে ধুতি পরা, আর কাঁধের উপর চারু বিনির্মিতা কালভুজঙ্গিনীতুল্য কুণ্ডলীকৃতা লোলায়মানা কবরী।’ সে ‘ঘাটে উঠিয়া আর্দ্র বস্ত্রে দেহ সুচারুরূপে সমাচ্ছাদিত করিয়া ধীরে ধীরে ঘরে প্রত্যাবর্তন করে’ ইত্যাদি।

এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করি— মজুমদারবাড়ির পারিবারিক ফোটো অ্যালবাম ঘাঁটতে গিয়ে নজর পড়ে ‘মালতী’ লেখা একটি ছবির ওপর। ছবিটি ক্ষতিগ্রস্থ হলেও চিনে নিতে অসুবিধা হয় না যে এই সদ্যস্নাতা ‘তন্ময়’ ছবির মুখটি ওরই। কে এই মালতী দেবী? খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি হেমেন্দ্রনাথের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে আসে, তা হলে সুধারানি দেবী কোথায় এই ছবিতে? এখানেই কৌশল। ফোটোশপের কায়দায় শিল্পী তাঁর যুবতী স্ত্রী সুধারানির দেহবল্লরিতে মালতীর লাবণ্যময়ী মুখ জুড়ে দিয়ে গড়ে তুলছেন তাঁর মানসপ্রতিমা।

পরেও এই একই কৌশল ব্যবহার করে বহু ছবি এঁকেছেন তিনি। বস্তুত কোনও বিষয়কে চিত্রায়িত করার জন্য তিনি তাঁর ক্যামেরায় তোলা ছবি এবং মডেলকে সামনে রেখে করা ‘লাইফ ড্রয়িং’এর সাহায্য নিতেন রেফারেন্স হিসাবে। হেমেন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যপাঠ, জীবনের প্রাত্যহিকতা আর কল্পনাকে একত্রিত করে অবিসংবাদিত নৈপুণ্যে গড়ে তুললেন সদ্যস্নাতা যুবতীদের সেই ‘চিত্র’। শরীর আর মন নিয়ে এক সূক্ষ্ম খেলায় আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর ছবির দর্শকদের। সাদা শাড়ি, নবনী-লাঞ্ছিত উজ্জ্বল ত্বক সংলগ্ন হয়ে যে ভাবে যৌবনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে শুরু করে, ঠিক একই ভাবে, ক্যানভাসে চিত্রিত মহিলাটি, তাঁর সামগ্রিক শারীরিক উপস্থিতি সত্ত্বেও, দর্শকদের থেকে আড়াল রচনা করে নেয়।

কাঁখে ধরা কলসি থেকে জল পড়ে চলে, আর চার দিকের জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভ্রুক্ষেপহীন সদ্যস্নাতা তার চিন্তার গভীরে হারিয়ে যেতে শুরু করে। এ এক ‘আছি’ আর ‘নেই’-এর খেলা। যে নেই তাকে খোঁজো, যা নেই তাকে ভেবে নাও। এই ভেবে নেওয়া থেকেই তাঁর চিত্রিত কাপড়ের আর্দ্রতা যৌনতার চেতনা উদ্রেক করে, কিন্তু একই সঙ্গে সদ্যস্নাতারা দর্শকদের থেকে মানসিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দরুন গোপন ক্যামেরায় তোলা ‘ভয়ারিস্টিক’ (voyeuristic) ছবির মতো হয়ে ওঠে। ফলত বহু ক্ষেত্রেই এ সব ছবির দর্শক এক অপরাধবোধে আক্রান্ত হন। এ সমস্ত কারণেই হেমেন মজুমদারের ভিজে কাপড়ের ছবি চির কাল বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থেকেছে।
সংগ্রহ From--শমীন্দ্রনাথ মজুমদার(ABP)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১:১৬
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×