ভূমিকা
শেখ মুজিবুর রহমান বাঙলাদেশের স্থপতি; সাধারণত শেখ মুজিব (আগে মুজিব ভাই) নামেই অধিক পরিচিত। এই ভূ-খন্ডের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত ব্যক্তির নাম শেখ মুজিব। তাঁর একাত্তর পূর্ববর্তী দীর্ঘ, সংগ্রামী, সাহসী, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীলতার রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে শ্রদ্ধায় যেমন মাথা নত হয়ে আসে, ঠিক তেমনি তাঁর একাত্তর উত্তর ভীরু, অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী, প্রগতিবিমুখতার রাজনৈতক কর্মকান্ড দেখলে ব্যাপকভাবে বিস্মিত ও হতভম্ব হতে হয়। কারণ যে মানুষটি সারাটা জীবন মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন তিনিই শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠলেন একজন প্রতিক্রিয়াশীল
আমি বিশ্বাস করি মানুষ মাত্রই সীমাবদ্ধ। আর রাজনৈতিক মানুষ মানে আরো বেশি সীমাবদ্ধ। তাদেরকে অনেক কিছু মানিয়ে চলতে হয়। ২৫ শে মার্চ রাতে শেখ মুজিব শশুড়বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলেন কিনা বা গুলি লাগার ভয়ে খাটের নিচে লুকিয়েছিলেন কিনা এই ধরণের অশ্লীলতা উদ্ঘাটন আমার লক্ষ্য নয়। অতি গৌণকে মূখ্য এবং মূখ্যকে গৌণ করার অভিপ্রায়ও আমার নাই। আমার পোষ্টের উদ্দেশ্য হল সংক্ষিপ্ত আকারে তাঁর রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করা এবং তাঁর ব্যর্থতার কারণগুলো খুজে বের করা।
ধৈর্য্য থাকলে এবার শুরু করুন . .
শেখ মুজিব ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহন করেন। অন্যান্য সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মত শেখ মুজিবকেও তাঁর বাবা যথাসময়ে স্কুলে ভর্তি করান। কিন্তু শারীরিক অসুস্ততার কারণে শেখ মুজিব তাঁর সহপাঠীদের তুলনায় কয়েক বছর পিছিয়ে পড়েন। এছাড়াও চোখের সমস্যার কারণে শেখ মুজিব চশমা নিতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে যখন তিনি আবার স্কুলে ভর্তি হন তখন বয়স, শারীরিক গঠন ও উচ্চতায় অধিক হওয়ায় তাঁর সহপাঠীরা তাঁকে 'মুজিবভাই' বলে সম্বোধন করত। শারীরিক গঠন ও চশমার কারণে অনেকের দৃষ্টিনন্দিত চোখ শেখ মুজিবের দিকে স্থির ছিল। ফলে শেখ মুজিব বিদ্যালয় ও শ্রেণীকক্ষের বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালনার প্রধানকর্মী ও বক্তা হয়ে ওঠেন। পড়াশোনার চেয়ে বাইরের দিক ও খেলাধুলায় তাঁর মন বেশি নিবিষ্ট থাকায় শেখ মুজিব ওইসব কাজ খুব আগ্রহ নিয়ে করতেন। ফলে তিনি আরো পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়েন, এতে ২২ বছর বয়সে তিনি ম্যাট্টিকুল্যাশেন পাশ করেন!
শেখ মুজিবকে আরো ভালোভাবে বুঝতে হলে দৈহিক গঠনের পাশাপাশি তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকেও বুঝতে হবে। শেখ মুজিব ছিলেন খুব সাহসী, অমায়িক, বন্ধুসুলভ, তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তিসম্পন্ন ও স্পষ্টবাদী মানুষ। তিনি যা বিশ্বাস করতেন তা সহজেই নিজের ভাষায় স্পষ্ট করে ও দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে পারতেন। তাঁকে ঘিরে কিছু ঘটনা দেখা যাক. . .
১৯৩৯ সালে মিশন স্কুল পরিদর্শনে যখন সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হক এসেছিলেন তখন শেখ মুজিবের নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক ছাত্র তাদের ন্যায্য দাবিদাবা নিয়ে সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হকের পথরূদ্ধ করেন। একজন স্কুলছাত্রের পক্ষে সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হকের মত বড় নেতার পথরূদ্ধ করা চারটে খানিক কথা না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর ১৯৪৩ সালে যখন খাদ্যভাব চরমরূপ ধারণ করল তখন ইসলামি কলেজের বাকের হলের তত্তাবধানে ছিলেন সৈয়দুর রহমান। তিনি খাদ্যভাব ও দূর্নীতি এড়ানোর জন্য 'এক কাপ-এক ছাত্র' ব্যবস্থা চালু করেন। কিন্তু শেখ মুজিব তাঁর ক্ষুধানিবারণের জন্য অতিরিক্ত কাপও নিতেন। তখন সৈয়দুর রহমানের সাথে মুজিবের আলাপচারিতার অংশ. . .
রহমান: তুমি প্রতিনিয়ত দুইটি কাপ নিচ্ছ এটা কি সত্য?
মুজিব: হ্যাঁ, স্যার।
রহমান: তুমি কি জানো না এটা অপরাধ? তোমার এটা করা ঠিক হয়নি।
মুজিব: (কিছুক্ষণ থেমে) স্যার, আমি জানি তা ঠিক না। কিন্তু আমি কি করব যখন এক কাপ আমার ক্ষুধা মেটাতে অক্ষম।
বাকের হলের ছাত্রদের রাত ৯ টার মধ্যে ছাত্রাবাসে প্রবেশের নিয়ম ছিল। কিন্তু শেখ মুজিব তা প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন করায় সৈয়দুর রহমান শেখ মুজিবকে জরিমানা হতে পারে বলে সতর্ক করে দেন। উত্তরে শেখ মুজিব বলেন, আপনি চাইলে শাস্তিস্বরূপ আমাকে জরিমানা করতে পারেন, কিন্তু আমার পক্ষে ৯ টার মধ্যে প্রবেশ সম্ভব না।
১৯৪৫ সালের যখন 'সমগ্র ভারতীয় মুসলিম লিগ' যখন ভাগ হয়ে যাচ্ছিল রক্ষনশীল ও বামপন্থী দু'টি দলে তখন কাউন্সিলের সভা ডাকা হয়। কিছু সংখ্যক রক্ষনশীল দলের সদস্যরা খুব উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠেন এবং রক্ষনশীল দলের সদস্য ইউসুফ আলী চৌধুরী শামসুদ্দিন আহমেদের বুকে এমন জোরে আঘাত করেন যে, শামসুদ্দিন মাটিতে পড়ে যান। পাশেই মুজিব ছিলেন। তৎক্ষনাৎ শেখ মুজিব ইউসুফের গলা চেপে ধরে মাটিতে ফেলে দেন। ফলে উক্ত সভা পন্ডু হয়ে যায়।
১৯৪৬ সালের আগষ্টে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যখন চরমরূপ ধারণ করল, তখন পাকিস্তান সৃষ্টি অনিবার্য হয়ে উঠল। সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাসিম বাঙলার অখন্ডতা রক্ষার জন্য কিছু ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছিলেন। শেখ মুজিবও তখন ছাত্রদের মধ্যে অখন্ড বাঙলার পক্ষে জোর প্রচারণা চালান : অখন্ড বাঙলা হিন্দু মুসলিম উভয়ের জন্যই লাভজনক হবে। তখন অর্থনীতির ছাত্র সালাউদ্দিন তখনকার বাজেট পর্যালোচনা করে ছাত্রদের বুঝানোর চেষ্টা করেন যে, একত্রিত বাঙলায় হিন্দু-মুসলিম উভয়েই আর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। এরপর সম্ভবত শেখ মুজিবের সাথে সালাউদ্দিনের আর দেখা হয়নি। তারপর ঘটনাক্রমে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায় এক দশক পর প্রথমশ্রেণীর কামরায় সালাউদ্দিন (পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসের সদস্য), শেখ মুজিব, সোহরাওয়ার্দী ও আরো কিছু নেতা ভ্রমন করছিলেন তখন শেখ মুজিব সালাউদ্দিনকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন : স্বাধীন একত্রিত বাঙলার জন্য সালাউদ্দিন তীক্ষ্ণ আর্থনৈতিক বিচার বিশ্লষণের মাধ্যমে জনমত গঠন করার চেষ্টা করেছিলেন।
এই হচ্ছে শেখ মুজিব যার স্মরণশক্তি অসাধারণ; যিনি স্পষ্টবাদী, অমায়িক, সাহসী ও উদার। এই সকল বৈশিষ্টের কারণে তৎকালীন অনেক বড় বড় নেতাকে টপকিয়ে শেখ মুজিব পিরামিডের প্রথম স্তরে ওঠে আসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব:
শেখ মুজিব ১৯৪৭ সালের সেপ্টম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ার জন্য আসেন। যদিও পড়াশোনার চেয়ে রাজনীতি ও বাইরের জগতে উনার মন বেশি নিবিষ্ট ছিল। তিনি বিবাহিত হওয়ায় ছাত্রাবাসে না ওঠে পুরান ঢাকায় বাসা ভাড়া করে থাকেন। তখন খাজা নাজিমউদ্দিন পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
১৯৪৭ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে করাচিতে 'পাকিস্তান শিক্ষা মন্ত্রণালয়'-এর সভায় "ইসলামিক মতাদর্শে" শিক্ষা সংস্কার করার জন্য বলা হয় এবং ৫ ডিসেম্বর উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিশেবে গ্রহন করার সুপারিশ করা হয়। তখন চুপচাপ বাঙলা ভাষার প্রধান্যকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন যেমন, তমদ্দিন মজলিস এবং বামপন্থী কিছু নেতা প্রথম এর বিরোধীতা করেন। শিক্ষা ব্যবস্থায় যখন অতিরিক্ত বিষয় হিশেবে উর্দু, হিন্দি, আরবি ও ফারসির ব্যবস্থা রাখা হয় তখনই বাঙলি ছাত্ররা এর বিরোধীতা করতে শুরু করে।
প্রথমদিকে শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলন নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন নি। মুজিব বিপ্লবী ধারায় বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনি বিশ্বাস করতেন যে সংগঠনকে একটি ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করেই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। মুসলিম লিগের ছাত্র সংগঠন "পূর্ব বাঙলার মুসলিম ছাত্রলিগ" শাহ্ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত হত। শেখ মুজিব শাহ্ আজিজুর রহমানকে কাউন্সিল দেওয়ার জন্য বুঝিয়ে ব্যর্থ হওয়ায় একই নামের প্রতিদ্বন্ধী আরেকটি ছাত্র সংগঠন গঠন করা হয়। এ সংগঠনের সদস্য ছিল অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোহা, আব্দুল মতিন, শেখ মুজিব প্রমুখ। অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোহা সংগঠনের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিতে চাইলে মুজিব এর বিরোধীতা করেন এবং বলেন যে, এটা যথার্থ সময় নয়; সরকার এটাকে ভুল বুঝতে পারে। ফলে সিদ্ধান্তটি বাতিল হয়ে যায়।
নবগঠিত উক্ত ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে নাজিমউদ্দিন আহমেদ, আব্দুল মতিন, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোহা এবং আরো কিছু ছাত্রনেতা (মুজিব অনুপস্থিত ছিলেন) তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে ভাষা প্রশ্নে আলোচনা করেন। আলোচনা তেমন ফলপ্রসু হয়নি।
অন্যদিকে চিত্তরন্জ্ঞন দত্ত করাচিতে পাকিস্তানের আইনসভায় বাঙলা ভাষাকে জাতীয় ভাষা করার বিচার বিবেচনা করার পক্ষে মত দেন। তৎক্ষনাৎ প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এর বিরোধীতা করেন। দত্ত যখন ঢাকায় ফিরেন তখন তাকে বিজয়মাল্য দিয়ে বরণ করা হয় এবং ভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য কমিটি গঠন করা হয়। বাংলা ভাষার স্বকৃতির জন্য উক্ত কমিটি ১১ মার্চ প্রাদেশিক ধর্মঘট আহ্বান করে। মুজিব তখন গোপলগন্জ্ঞে ছিলেন। যখন তিনি ধর্মঘটের কথা শুনলেন তখন তাড়াতাড়ি ঢাকা চলে আসেন এবং ধর্মঘটকে ফলপ্রসু করার জন্য মিছিলের প্রথমসারিতে অবস্থান করেন। মিছিল যখন সেক্রিটারিয়েট গেইটের কাছাকাছি পৌঁছায় তখন ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাটিচার্জ করে এবং শেখ মুজিবসহ আরো ২০০ জনকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়।
জিন্নাহ্ সামনের সপ্তাহে ঢাকা সফরে আসার পরিকল্পনা গ্রহন করেছিলেন। মুসলিম লিগের অনেক নেতাই উদ্বিগ্ন হন এই ভেবে যে, যদি ছাত্রদের শান্ত করা না যায় তাহলে জিন্নাহ্র প্রথম সফর হয়ে ওঠবে নিরানন্দ। তাই সমঝোতার মাধ্যমে ১৫ ই মার্চ চারজন বামপন্থী ছাত্রনেতা ছাড়া বাকি সবাইকে শর্তহীন মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু শেখ মুজিব ও কিছু সংখ্যক বামপন্থী নেতা ঐ চারজনকে ছাড়া জেল ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান। অবশেষে ঝামেলা এড়াতে কর্তৃপক্ষ সবাইকে শর্তহীন মুক্তি দান করে। পরদিন দুপুর দেড়টার ছাত্রসভায় তিন দফা দাবির সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। এরপর কাউকে সুযোগ না দিয়ে শেখ মুজিব বক্তৃতা দিতে থাকেন। যদিও সেই বক্তৃতার কোনো সারমর্ম ছিলো না। হঠাৎ মুজিব 'চলো চলো অ্যাসেমব্লি চলো' বলে শ্লোগান দিয়ে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি ছাড়াই সকল ছাত্রকে পরিষদ ভবনের দিকে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান। হঠাৎ উদ্ভূত এই পরিস্থিতির পর মিছিলকে বন্ধ করা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে ছাত্ররা সরকার বিরোধী এবং বাঙলা ভাষার সমর্থনে শ্লোগান দিতে দিতে পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এতে পুলিশ বাধা দেওয়ার ছাত্ররা ইন্ঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তারের বেড়া পার হয়ে কলেজ এলাকার মধ্যে ঢুকে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিত্বের পদত্যাগ দাবি এবং পুলিশি জুলুমের বিরূদ্ধে শ্লোগান দিতে থাকে।
১৯ শে মার্চ জিন্নাহ্ ঢাকায় আসেন। ২১ শে জুন রেসকোর্স ময়দানে একঘণ্টাকাল বক্তৃতার মধ্যে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন,
এককথা আপনাদেরকে পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া দরকার যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়। এ ব্যাপারে যদি কেউ আপনাদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে বুঝতে সে হচ্ছে রাষ্ট্রের শত্রু। একটিমাত্র রাষ্ট্রভাষা ছাড়া কোনো জাতিই একসূত্রে গ্রথিত হয়ে কার্যনির্বাহ করতে পারে না। অন্যদেশের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন। অতএব, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।
জিন্নাহ্ ইংরেজিতে বক্তৃতা প্রদান করায় অধিকাংশ শ্রোতাই কিছু না বুঝে চুপচাপ থাকে। ছাত্ররা বক্তৃতা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় কিন্তু শ্রদ্ধাস্বরূপ চুপচাপ প্রদর্শন করে। এর তিনদিন পর ভাষা প্রশ্নে ঢাবির কার্জন হলে ছাত্রদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় জীবনে প্রথমবারের মত জিন্নাহ্ "না না" স্বরে বিরোধিতার মুখোমুখি হন। ঐদিন পড়ন্ত বিকেলের সভায় জিন্নাহ্ ছাত্রদের বুঝানোর চেষ্টা করেন যে একটি মাত্র রাষ্ট্রভাষা ছাড়া পাকিস্তানের একতা বিনষ্ট হতে বাধ্য। জিন্নাহ্ উক্ত সভায় এমন যৌক্তিক প্রতিবাদের মুখোমুখি হন যে এরপর আর ভাষা ইস্যু নিয়ে তিনি কখনো কথা বলেননি।
নাজিমউদ্দিন ভাষা আন্দোলনে সোহরাওয়ার্দীর অদৃশ্য হাত আছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করে জিন্নাহ্কে বুঝান : সোহরাওয়ার্দী সমর্থিত নেতাদের সরকারে স্থান দিলে সমস্যাটি মিটে যেতে পারে। জিন্নাহ্ উক্ত প্রস্তাব গ্রহন করে মোহাম্মদ আলী বগড়া, ড. আব্দুল মোতালেব মানিক, তোফাজ্জল আলীকে সরকারের বিভিন্ন পদে স্থান দেন। এসব গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদদের হারিয়ে ভাষা আন্দোলন সুপ্ত আবস্থায় বিরাজ করতে থাকে।
ভাষা আন্দোলন যখন স্তিমিত হয়ে পড়ছিল তখন শেখ মুজিব ঢাবির প্রভাষকদের বেতন বৃদ্ধি, অমুসলিম শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদন্নোতির ব্যাপারে স্বচ্ছতার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এছাড়াও ১৯৪৭ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন যা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সমর্থন অর্জন করতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ শিক্ষার পরিবেশ রক্ষার নামে আন্দোলনরত কিছু সংখ্যক ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিঃস্কার ও কিছু সংখ্যক ছাত্রদের ছাত্রাবাস থেকে বহিঃস্কার করে। মুজিবসহ আরে ছয়জনকে ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ জরিমানা করা হয়। কিন্তু মুজিব তা দিতে অস্বীকৃতি জানালে কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিঃস্কার করে দেয়। ছাত্রজীবনের অবসান ঘটায় শুরু হয় তাঁর নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামশীল রাজনীতি।
তথ্য:
Sheikh Mujib: Triumph and Tragedy by S. A. Karim
ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি : বদরউদ্দীন উমর
আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম : হুমায়ুন আজাদ
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ বিকাল ৪:৩২