বাঙলাদেশে জন্মই যাঁদের আজন্ম পাপ, তাঁরা সম্ভবত যৌণকর্মী ( যদিও কেউ যৌণকর্মী হয়ে জন্ম নেয় না, ক্রমশ হয়ে ওঠে )। চলতি বাঙলায় তাঁদেরকে পতিতা, খানকি, বেশ্যা, মাগী, বাজারের মেয়ে, গণিকা ইত্যাদি নানান শব্দে ভূষিত করা হয়। শব্দগুলো গালি হিশেবেও ব্যবহৃত হয়। যাঁরা 'পবিত্র সমাজ' চ্যুত, যাদেরকে বাঙালি সমাজ চরম অশুচি রূপে দেখে, যাঁদের শরীর একাধিক 'পবিত্র পুরুষ' সম্ভোগ করে; তাঁদের উদ্দেশ্যেই উক্ত শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়।
যৌণকর্মীর অধিকাংশ মেয়েই আসে গ্রামের দরিদ্র, ভূমিহীন কৃষক, দিনমজুর, ছোটখাট গ্রামীণ কারুশিল্প নির্ভর পরিবার থেকে। চরম দারিদ্র্যতা, দারিদ্র্য পরবর্তী শারীরিক ও মানসিক চাপ এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণাই ওঁদেরকে আস্তে আস্তে ঠেলে দেয় অন্ধকার জীবনে। যখন পুরুষ অবিভাবকটি সংসার চালাতে অক্ষম, বাবা-মা যখন মারা যায় বা দ্বিতীয় বিয়ে করে সন্তানের দায়িত্ব ত্যাগ করে, যখন ছেলে মেয়ের বোঝা স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে স্বামী আবার বিয়ে করে বা উধাও হয়ে যায় এবং সংসারে যখন কোনো বিকল্প সহায়-সম্বল থাকে না, তখন মেয়েদেরকে একা আয় উপার্জনের পথ খুঁজতেই হয়।
গ্রামের এই সকল মেয়েদের কাজেই সুযোগ খুবই কম থাকে। এঁদের অনেকেই চলে আসে শহরে। এঁদের একটি বড় অংশ বাসাবাড়িতে ঝি-এর কাজ করে, আরেকটি বড় অংশ পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ করে। এসব কাজে রোজগার অনেক কম। এছাড়াও অনেকেই যৌণহয়রানি, যৌণনিপীড়ন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। এভাবে খেয়ে-পরে বাঁচার মত সুযোগ না পেয়ে এবং শারীরিক, মানসিক ও যৌণনিপীড়নের শিকার হয়ে অনেক মেয়েই একসময় যৌণকর্ম পেশা হিশেবে 'স্বেচ্ছায়' গ্রহন করে। পুরুষের প্রতারণার কারণেও কিছু মেয়ে পতিতালয়ে জায়গা খুঁজে নেয়।
পুরুষের সাথে এঁদের যৌণ সংসর্গের ব্যাপারটি নিতান্তই ব্যবসায়িক। সেখানে পছন্দ, অপছন্দ, আনন্দ উপভোগের বালাই নেই। শারীরিক কষ্ট হলেও যতজন খদ্দের পারা যায় নিতেই হবে। ব্যাপারটা তাঁদের জন্য কতটা আবেগবর্জিত হয়ে ওঠে, সেটা বোঝা যায় একজন যৌণকর্মীর কথায় আমাদের রীতিমত কষ্ট করে পেটের ভাত যোগাড় করতে হয়, একজন পুরুষ মানুষ নেওয়া আর শরীরের ওপর একটা ভারী বস্তা নেওয়া একই কথা। (সূত্র : জীবনের দামে কেনা জীবিকা : কুর্রাতুল আইন তাহ্মিনা ও শিশির মোড়ল)