শতাব্দী রায় মাত্র ১০ মিনিটের পরিচিত একটি তরুণী; শতাব্দী রায়কে দেয়া আমার প্রতিশ্রুতিটা আমি রাখতে পারিনি, কথাটা মনে এলে আমার কষ্ট লাগে। আমাদের গ্রাম থেকে ৪ মাইল উত্তর পশ্চিমে একটি গ্রামে, এক দুপুরে, ২০ বছরের একটি মেয়ের সাথে আমার ১০ মিনিটের আলাপ হয়েছিলো, নাম শতাব্দী রায়; শতাব্দী এসএসসি'তে ফেল করেছিলো; আমি কথায় কথায় তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে, আমি তাকে পড়িয়ে এসএসসি পাস করতে সাহায্য করবো। শতাব্দী রায়কে দেয়া আমার প্রতিশ্রুতিতা আমি রাখতে পারিনি, শতাব্দীর কথাটা অনেক বছর আমার মনে পড়েনি, সম্প্রতি মনে পড়েছে, আমার খুবই খারাপ লাগছে; ভাবছি, সে কেমন আছে।
২০১২ সালের কথা, আমি তখনো প্রবাসে চাকুরী করতাম; পরেদিনই আমি বিদেশে চলে যাবো; মেঝো ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ীতে দুপুরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ ছিল, এলাকাটা আমার খুব একটা জানাশোনা ছিলো না; সব সময় মুল রাস্তা হয়ে গিয়েছি, চলে এসেছি। সেদিন দুপুরে খাবারের পর, আমি পায়ে হেঁটে বাড়ী রওয়ানা দিলাম, মুল রাস্তা ছেড়ে, গ্রামের মাঝখান দিয়ে একটা সরু রাস্তা হয়ে, পূর্বদিকে যাচ্ছিলাম; একটা ছোট পুকুরের পূর্ব-পাড় হয়ে রাস্তা গিয়েছে; পুকুর পাড়ে, রাস্তার পাশে একটা ছোট কুল গাছ, অনেক কুল ধরে আছে, কুল পাকার শুরু করেছে। আমি হাত বাড়িয়ে ৩/৪টা কুল নিলাম। পুকুরের পশ্চিম পাড়ের ঘাঁটে ঘোমটা পরা একজন নারী হাঁড়ি পাতিল পরিস্কার করছিলেন, লম্বা ঘোমটার জন্য মুখ দেখা যাচ্ছিলো না, এবং আমি অত দুরে পরিস্কার দেখিও না।
নারী দাঁড়ি্যে আমাকে বললেন,
-এই যে ভদ্ররলোক, পরের গাছের কুল নিতে অনুমতি নিতে হয়, সেটা কি জানা নেই?
-আমি তো পরের গাছ ভাবিনি, নিজের মানুষদের গাছ ভেবেছি!
-তাই নাকি? নিজের মানুষকে চিনতে পারছি না কেন?
-দুরে থাকলে কি করে চিনবেন, কাছে আসেন।
-আসছি।
তিনি হাঁড়িপাতিল রেখে, হাত ধুয়ে কাছে এলেন; ২০/২১ বছরের হালকা পাতলা গঠনের সুশ্রী শ্যামলা তরুণী; হাসি হাসি মুখ। আমি সালাম দিলাম, উত্তরে তিনি সালাম জানানোর পর, নমস্কারও করলেন; হিন্দু তরুণী; নাম, শতাব্দী রায়; অসম্ভব সুন্দর নাম। আমার নাম ঠিকানা জামানাম।
-আপনাকে এই এলাকায় কোনদিন দেখিনি, শতাব্দী বললেন।
-আমি কাজ উপলক্ষে বিদেশে আছি বেশ কিছু সময়। আপনি কি করেন?
-এই যে দেখছেন, সংসার করছি!
-সংসারে কে কে আছেন?
-মা আর আমি। এক ভাই আছেন, বড় ভাই, ঢাকায় থাকেন, কিসব রাজনীতি করেন! বাড়ী আসেন না।
-ঢাকা থেকেই বাড়ী আসেন না?
-চাকুরী বাকুরী নেই, মনে হয়, সেজন্য আসেন না।
-আপনি পড়ালেখা করেছেন, বা করছেন।
-আমি এসএসসি ফেল করেছি, ৪ বছর হয়ে গেছে!
-কয়বার পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
-একবার মাত্র।
-কিসে কিসে ফেল করেছেন?
-মনে হয়, সবকিছুতে; আমি ইংরেজী, অংক, বিজ্ঞান পারি না!
-তাই? সমস্যা নেই, আমি আপনাকে এগুলো সবগুলো পড়াবো; পাশ করা কোন সমস্যাই না, আপনি শুধু পাশ করা নয়, তার থেকে অনেক ভালো করবেন!
-আপনি আমাকে পড়াবেন?
-অবশ্যই পড়াবো।
খুশীতে শতাব্দীর চোখগুলো চিকিচিক করে উঠলো; ওর জন্য মনটা বেদনায় ভরে গেলো। সন্ধ্যার বাসে আমার ঢাকায় যাবার কথা, পরেরদিন আমার ফ্লাইট; আমি কথা বাড়ালাম না, বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আমি প্রায় শ'খানেক গজ সামনে আসার পর, পেছনে ফিরে দেখলাম, শতাব্দী সেখানে দাঁড়ায়ে আমার চলে যাওয়া দেখছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:১৬