somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্লাশমেট হাসিনা চৌধুরীর নীরব জীবন

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এই কাহিনীটি আমার প্রাইমারী স্কুল জীবনের এক সহপাঠিনীকে নিয়ে; দীর্ঘ বিস্মৃতির পর, বছর তি'নেক আগে, নভেম্বরের এক সন্ধায় আমার স্মরণে আসে আমার ক্লাশমেট; ভাবলাম, তার খোঁজ নেয়ার দরকার, হয়তো সাহায্য করতে হতে পারে; গত ৩ বছর আমি অনেকটা ভালো ছিলাম না; এ'বছর নভেম্বর মাসে জানলাম, ঠিক ৩ বছর আগে সে মৃত্যুবরণ করেছে, খবরটা আমাকে বিশালভাবে ব্যথিত করেছে।

আমি চতুর্থ শ্রেণীতে উঠেছি, ১ম সপ্তাহের এক অংকের ক্লাশে হেড মাষ্টার সাহেব এক নতুন ছাত্রীকে নিয়ে এলেন ক্লাশে, পরিচয় করায়ে দিলেন: নাম, হাসিনা চৌধুরী, পাশের এক স্কুল থেকে আমাদের স্কুলে এসেছে, সেখানকার ক্লাশের রোল নাম্বার ১ ছিলো। সে আমাদের স্কুলে আসার বেশ কিছুদিন আগের থেকেই ওর আগমণের একটা সংবাদ দিচ্ছিল আমাদের ক্লাশের সিরাজ; হাসিনারা সিরাজদের প্রতিবেশী। তার আগমনে পুরো ক্লাশ চুপ, সে সেই বয়সে অগ্নিশিখার মতো সুন্দরী ছিল; কাপড়ে চোপড়ে পরিপাটি; কিন্তু গম্ভীর মুখ। আমাদের ক্লাশের মেয়েরা ওর দিকে হতবাক হয়ে চেয়ে রলো। সিরাজের হাসি হাসি মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যে, আজ দিনটি তার জন্য হয়তো এক মহা উৎসবের দিন। আমি এই বয়সে এই ধরণের গম্ভীর মেয়ে দেখিনি, আমিও হতবাক।

হাসিনার অস্বাভাবিক গাম্ভীর্য, কিংবা তার বিরল সৌন্দয্য তাকে সবার থেকে আলাদা করে রাখলো: মেয়েরা তাকে দলে টানতে পারেনি; সে চুপচাপ ক্লাশে আসে, চুপচাপ চলে যায়; সিরাজের পরিচিত হিসেবে সিরাজের সাথেও কোন ভাবসম্পর্ক নেই তার। সপ্তাহ দুয়েক পরে, টিফিনের সময় আমারা ফুটবল খেলছিলাম, আমি সম্পর্ক পাতানোর জন্য দুর থেকে চীৎকার দিয়ে বললাম,
-হাসিনা, আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়!
হাসিনা অফিসের সামনে দাঁড়ায়ে ছিলো, আমাদের পানি ও গ্লাস থাকতো অফিসের টেবিলের উপর; সে নড়লো চড়লো না; ছেলেমেয়ারা দেখছিলো কি হয়! একটু পরে সে আমার জন্য পানি নিয়ে এলো, আমি পানি খেলাম; হেসে ধন্যবাদ প্রকাশ করলেম(তখনো ধন্যবাদ দিতে শিখিনি)।

সেইদিন ক্লাশ শেষে সিরাজ কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
-আমাদের বন্ধুত্বের শেষ, আর কথা হবে না এই জীবনে!
-কি ঘটলো?
-তুই হাসিনাকে কেন পানি আনতে বললি? তুই জানিস না আমি ওকে ভালোবাসি?
-তুই হাসিনাকে ভালোবাসিস, সে জানে?
-সে জানে কিনা আমি জানি না; তবে, তুই মাঝখান দিয়ে কেন ঢুকে পড়ছিস?
-শোন, তুই আমার সামনে আর পড়িস না; সে আমার ক্লাশমেট, তার প্রতি আমারও টান আছে, ভালোবাসা টাসা কিছু নেই। তোর মাথা সব সময় খারাপ ছিলো, আমার সামনে থেকে যা।

এরপর থেকে খেলার কোন এক সময় হাসিনাকে আমি অফিসের সামনে ঠিকই দেখতাম, আমি চীৎকার দিয়ে পানি আনতে বলতাম, সে পানি নিয়ে আসতো; এতে সিরাজ মিয়া মাথাহীন মুরগীর মতো ঝিমাতো, মেয়েরা হাসিনাকে নিয়ে হাসতো। আনুমানিক ৬ মাস পর, একদিন স্কুল থেকে বাড়ী ফেরার পথে, হাসিনার বড় ভাই আমাকে থামালেন,
-তুমি নাকি হাসিনাকে পানি আনতে অর্ডার দাও?
-হাসিনা বলেছে?
-না, অন্য কেহ বলেছে; আমি যেন পানি টানির কথা না শুনি।
হাসিনার ভাই কলেজে পড়তেন, খুবই ভালো ছাত্র ছিলেন, বেশ বড় ধরণের পাগলও ছিলেন; পরে আমার পানি আমি খেয়েছি। ফাইনালে, হাসিনা ৩য় স্হান পেয়েছিলো, বেচারী হতাশ, আমি শান্ত্বনা দিলাম। ৫ম শ্রেণী শেষ করলো ২য় স্হান পেয়ে। এরপর আমরা আলাদা হাই স্কুলে চলে গেছি; সিরাজ ওকে অনুসরণ করে একই স্কুলে ভর্তি হলো; আমার সাথে যোগাযোগ ছিলো না বললেই চলে; আমি ওদের স্কুলে ফুটবল খেলতে গেলে সে খেলা দেখতো, আমি এক সুযোগে দেখা করে খোঁজখবর নিতাম। নবম শ্রেণীতে উঠে শুনি সিরাজ মিয়া হাসিনাকে বিরক্ত করার কারণে স্কুল থেকে টিসি পেতে যাচ্ছিলো প্রায়।

যাক, তার কিছুদিন পরেই খারাপ সংবাদ পেলাম, হাসিনার বাবা খুবই অসুস্হ, মেয়েকে নিজের বোনের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন; বিয়েতে বড়ভাই সবকিছু দেখছে, আমি দাওয়াত পেলাম না; তবুও আমি গেলাম; ইচ্ছা ছিলো জামাই দেখা; হাসিনার সাথে দেখা হলো না, জামাই দেখলাম , একেবারেই মীন-টাইপের, বিনয়ী নয়।। হাসিনার বাবা অসুস্হ না হলে, জামাইকে পিটায়ে বিয়েটাই ভেংগে দিতাম; ক্লাশমেটদের মাঝে পাখী ও মিনতি ব্যতিত আর কেহ দাওয়াত পায়নি; ওদেরকে বললাম,
-চল জামাইকে পিটাই, বিয়ে ভেংগে যাক।
মিনতি বললো,
- বিয়ে বাড়ীতে এসে অমংগল কথা বলিসনে, যা ঘরে চলে যা।

কয়েক মাসের মাঝেই হাসিনার বাবার মৃত্যু হলো; হাসিনা স্কুল ছাড়লো। এরপর, পাখী থেকে হাসিনার সামান্য খবরাখবর পেতাম মাঝে মাঝে। ৮০ দশকের মাঝমাঝি খবর পেলাম হাসিনা খুবই অসুখী, সে স্বামীর সাথে কোনভাবে টিকে আছে, ছেলেমেয়ে নেই! মনটা খারাপ হয়ে গেলে। এরপর আমি দেশের বাইরে চাকুরী করার শুরু করলাম; পাখীর সাথে দেখা হতো ২/১ বছর পরপর, সবার কিছু খবর টবর পেতাম। ২০০০ সালের দিকে পাখী এলকা ছেড়ে থানা হেডকোয়ার্টারে চলে গেছে, দেখাশোনা হতো না। ক্রমেই হাসিনার কথা ভুলে যাই। ২০১৬ সালের শেষের দিকে প্রাইমারী স্কুলের এক ক্লাশমেট আমাকে প্রবাসে ফোন করে অনেকের খোঁজখবর দিলো, কিন্তু হাসিনার খবর দিতে পারলো না; তখন আমার মনে হয়েছিলো যে, দেশে গেলে ওকে দেখতে যাবো, দেখবো ওর কোন ধরণের কোন সাহায্য ইত্যাদির দরকার আছে কিনা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৮:১৭
২৭টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×