আমি চাকুরী নিয়ে নিউইয়র্কের এক গ্রামে এসেছি; দ্বিতীয় দিনই এক বাংগালী ভদ্রলোকের টেলিফোন পেলাম; তারপর দিন, উনার সাথে দুপুরের খাবার খেলাম। উনার নাম, ড: আবদুল্লাহ, এই এলাকায় ১৫ বছরের মতো আছেন; এক সময় ঢাকা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ছিলেন। এলাকায় ৩০টা'র মতো বাংগালী পরিবার আছে। খাওয়ার সময় জানতে চাইলেন, আমি তাস খেলতে পছন্দ করি কিনা! আমি হ্যাঁ-সুচক উত্তর দিলাম; উনি প্রাণ খুলে হাসলেন; বুঝলাম, তাসের প্রতি উনার বেশ দুর্বলতা আছে; শনিবারে বিকেল ৫'টায় উনার বাসায় দাওয়াত।
আমি ঠিক ৫ টা'য় উনার বাড়ীতে এলাম, কেহ নেই! ঘরের পেছন ঘুরে দেখলাম, কেহ নেই! ঘরের সামনের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম; ২/৩ মিনিট পরেই ১ টি গাড়ী এসে থামলো, একজন মেয়ে নামলেন, আমাকে সালাম দিয়ে বললেন,
-কাকা কাকীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন অনেক আগেই, কিন্তু ডাক্তারের দেরীর কারণে উনাদের দেরী হচ্ছে; আমাকে ফোন করে বলেছেন, আপনাকে বসাতে।
উনি কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন, আমি শুনছিলাম, উনার সালামের জবাবও মনে হয়, দেয়া হয়নি; মনে হচ্চিল, আমি উনার দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম; উনি দরজা খুললেন, ঘরে এলাম। হঠাৎ নিজকে নিজের কাছে অনেকটা বেকুব বলেই মনে হলো; তিনি ছিলেন স্নিগ্ধ এক পরমা সুন্দরী নারী।
-আমি আপনার জন্য চা বানাই, আপনি বসেন; এই কথা বলে উনি কিচেনে গেলেন। এক মিনিট পরে কিচেন থেকে বললেন,
-আপনি চা বানাতে পারেন?
-হ্যাঁ, পারি।
-তা'হলে, আপনিই বানান, আমি একটুখানি ক্লান্ত; আমি বসে আপনার সাথে কথা বলি।
উনি আমাকে পাতিল, চা-পাতা, দুধ, চিনি সব বের করে দিলেন। আমি ২ কাপ চা বসালাম।
-আপনার স্ত্রীও আসার কথা ছিলো, কাকা বললেন।
-হঠাৎ করে ওর ভাই এসেছে নিউইয়র্ক শহর থেকে।
তিনি আমার তৈরি চা খেয়ে উহ আহ শুরু করলেন,
-আপনি দেখি খুবই ভালো চা তৈরি করেন; আমাকে একটু দেখিয়ে দেবেন।
মেয়েটির নাম জেসমীন, আবদুল্লাহ ভাই'এর ছাত্রের স্ত্রী, ১ মাইলের ভেতরে থাকেন। আমাদের চা খাওয়ার ভেতরেই আবদুল্লাহ ভাই ও ভাবী এলেন। একটু পরেই জেসমীন বিদায় নিচ্ছিলেন; ভাবী জেসমীনকে একটি ফুলের টব দিয়েছেন, মোটামুটি ভারী; জেসমীন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-টবটা একটু এগিয়ে দেন।
আমি টবটা গাড়ীতে তুলে দেয়ার পর, জেসমিন বললেন,
-কাকার কথায় বুঝলাম, উনি আপনাকে উনার তাসের সাগরেদ বানাবেন; আপনাকে এখানে ঘনঘন আসতে হবে; এখানে বেশ কিছু পরিবার আসে, অনেক সুন্দরী বউ আসে, আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে।
-ওকে! আমি মাথা নেড়ে বিদায় জানালাম।
এখানে লোক অনেক, কিন্তু তাস খেলার লোক নেই; আমরা ৩ জন খুবই উৎসাহী, চতুর্থজন পাওয়া বেশ কষ্টকর; চতুর্থজন একজন আছেন, উনি খেলেনও ভালো; কিন্তু উনাকে আনতে ১০ বার কল করতে হয়, ৫ টায় আসবে বললে, ৬টার আগে আসে না, আবদুল্লাহ ভাইয়ের কোম্পানীতে চাকুরী করেন; নাম ছিলো জুবায়ের; আরো সমস্যা হলো, উনি স্ত্রী ব্যতিত আসেন না; স্ত্রী যেদিন আসতে পারে না, সেদিন উনি আসবেন না। মনে হয়, এর পেছনে কারণও ছিলো, উনার স্ত্রীটি ছিলো খুবই সুব্দরী। উনার স্ত্রীকে আমি প্রথম যেদিন দেখেছি, সেদিন আমরা বেইসমেন্টে বসে তাস খেলছিলাম; জেসমিন জুবায়ের সাহবেবের স্ত্রীকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য বেইসযমেন্টে নিয়ে এসেছিলো। পরিচয় ছিল শর্টকার্ট, সবার মন ছিলো খেলায়; কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম, জেসমীন মিটিমিটি হাসছেন, চোখ দু'টো আমার উপর। মেয়েটির নাম শিল্পী, পেশায় ইন্জিনিয়ার; সবেমাত্র পড়ালেখা শেষ করেছেন।
কয়েক সপ্তাহ তাস খেলার পর বুঝলাম, জুবায়ের খুব একটা উদার নন, উনার মেজাজও খুব একটা ভালো নয়; আমি উনার সাথে খেলাতে উৎসাহ হারাচ্ছিলাম। শীতকাল ছিলো, আবদুল্লাহ ভাই'এর মেয়ের জন্মদিন; ছেলেমেয়েরা সেটার আয়োজন করেছিলো রেষ্টুরেন্টে, তারপর বাসায়ও আড্ডার ব্যবস্হা ছিলো; আমরা তাস খেলার সুযোগ খুঁজছিলাম, জুবায়ের আসবে আসবে বলে চলেছে ঘন্টা দেড়েক; আবদুল্লাহ ভাই ১০/১৫ মিনিট পরপর ফোন করে যাচ্ছেন। অবশেষে, জুবায়েরেরা এলেন, খাবার দেয়া হয়েছে, লোকজন নিজেরা নিয়ে খাচ্ছেন; খাওয়ার মাঝখানে, হঠাৎ জুবায়ের প্লেট রেখে তার স্ত্রীকে বললেন,
-শিল্পি, হাত ধুয়ে নাও, আমাদের যেতে হবে!
শিল্পি খেতেছিলেন, উনি কেমন বিমর্ষ হয়ে গেলেন। আবদুল্লাহ ভাই জুবায়েরকে জিজ্ঞাসা করলেন,
-জুবায়ের কোন ইমারজেন্সী?
-হ্যাঁ, ইমারজেন্সী, পরে জানাবো। আপনারা চিন্তিত হবে না, কোন মৃত্যূ, বা এ্যাকসিডেন্ট নয়।
ওরা চলে গেলো। সবাই চিন্তিত, এমন কি ইমারজেন্সী যা বলতে পারলেন না; আবদুল্লাহ ভাই খুবই উদ্ভিগ্ন। আমি কেন যেন তেমন উদ্ভিগ্ন হলাম না; লোকটার আচরণ আমার কাছে কিছুটা আজগুবি মনে হতো। আমাদের তাস খেলা হচ্ছে না; রাজনীতি ফাজনীতি নিয়ে বকবক চলছে। জেসমীন চা নিয়ে এলেন। আবদুল্লাহ ভাই জেসমীনকে বললেন,
-জেসমীন, ফোন করে শিল্পী থেকে জেনে নাও তো কি হয়েছে, আমি খুবই উদ্ভিগ্ন।
কয়েক মিনিট পর, জেসমীন ফিরে এসে আবদুল্লাহ ভাইকে কানে কানে কি একটা বললেন; আবদুল্লাহ ভাই হো হো করে হাসলেন, তারপর বললেন,
-জুবায়ের একটা বড় ইডিয়ট।
সবাই আবদুল্লাহ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে! সবাই জানতে চান কি হয়েছে। আমি লক্ষ্য করলাম জেসমীন আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছেন।
অবশেষে আবদুল্লাহ ভাই মুখ খুললেন, "কে একজন নাকি শিল্পির দিকে কুৎসিতভাবে তাকায়েছে, সেইজন্য জুবায়ের চলে গেছে; কি ধরণের ইডিয়ট সে!"
সবাই ২/১ মিনিট সেটা নিয়ে হাসাহাসি করে রাজনীতিতে মন দিলেন। জেসমীন বললেন ,
-কারো চা লাগবে?
আমি আমার খালি কাপটা নিয়ে জেসমীনের পেছনে পেছনে কিচেনে গেলাম। জেসমীন বললেন,
-চা শেষ হয়ে গেছে, চা বসাচ্ছি, আমি নিয়ে আসবো; আপনি আড্ডায় যোগ দেন, চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই, সেটা আপনি নন।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:০৫