somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সোনারগাঁও হোটেলের সোনালী স্মৃতি .... ২য় খন্ড

০৮ ই জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পূর্ববর্তী অংশ - সোনারগাঁও হোটেলের সোনালী স্মৃতি

কারওয়ান সরাই রেষ্টুরেন্টের আমাদের এক সহকর্মী মঞ্জুরুল হক হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে পরাতে তাকে হলি ফ্যামিলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঢাকাতে মঞ্জু’র পরিবারের কোন সদস্য বা নিকটাত্মীয় না থাকাতে রেষ্টুরেন্ট ম্যনেজার জনাব আলমগীর খান আমাকে রাতের বেলায় তার সাথে হাসপাতালে থাকার জন্য পাঠান। পরে অবশ্য আমি এই সহানুভুতির মর্ম বুঝতে পেরেছিলাম।

১৯৮৩র শুরুর দিকে কফি শপে কয়েকজন নতুন মহিলা ট্রেইনী যোগ দেয়, তাদের একজন আমার দৃষ্টি আকর্ষন করে। হোটেলে যোগদানের দ্বিতীয় মাস থেকে আমি তার সাথে কথা বলা এবং ছুটির দিনে একসাথে ঘোরাঘুরি শুরু করি। প্রায় দেড় বছরের প্রণয়ের পর আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই। তবে আমরা দুইজনই হোটেল কর্মচারী এবং যেহেতু একই পরিবারের সদস্যরা হোটেলে চাকুরী করতে পারবে না বলে হোটেলের একটি নিয়ম ছিল, সেই কারণে আমাদেরকে কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুমতি নিতে হয়েছিল। আমাদের আগে অন্য যেসব হোটেল কর্মী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে তারা হলঃ রশিদা-করিম, লরেন্স রোজারিও-জোৎস্না, সাদিয়া-হানিফ, রফিক-লিলি।

১৯৮৪ সালের মাঝামাঝি হোটেলের কর্মচারী ইউনিয়নের রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন হয়। নবগঠিত ইউনিয়নের প্রথম দাবীই ছিল এর আগে ইউনিয়ন গঠন করতে গিয়ে যে ১৪ জন সহকর্মী চাকুরীচ্যুত হয়েছে তাদেরকে পুনর্বহাল করার, যেটি কর্তৃপক্ষ মানতে বাধ্য হয়েছিল।

১৯৮৪ সালের আগষ্ট মাসের শুরুতে ডিউটিরত অবস্থায় বারে রাখা বড় প্লাজমা টেলিভিশনের পর্দায় আমরা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটের বিধ্বস্ত হওয়ার খবর দেখতে পাই। বিমানের এই দুর্ঘটনাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে এই দুর্ঘটনায় বিমানের প্রথম মহিলা পাইলট ক্যাপ্টেন কানিজ ফাতেমা রোকসানা মারা যান যিনি বিমানটি চালাচ্ছিলেন। ৪৫ জন যাত্রী ও ৪ জন ক্রু সহ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আগত আভ্যন্তরীন এই ফ্লাইটটি অত্যধিক বৃষ্টিপাতের কারণে দুইবার অবতরণের চেষ্টা করেও রানওয়ে খুজে পেতে ব্যার্থ হয়, তৃতীয়বার অবতরণের চেষ্টার সময় বিমানটি রানওয়ে থেকে ৫০০ মিটার আগেই এক জলাভূমিতে পতিত হয়ে বিধ্বস্ত হয়।

এই ঘটনার এক দুইদিন পরেই দেশের জন্য আরেকটি বড় ক্ষতি হয় যখন বিধ্বস্ত ফকার এফ ২৭ বিমানটির উদ্ধারকার্য্য তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়োজিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তৎকালীন প্রধান রিয়ার এডমিরাল এম, এইচ, খান হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন।

এরপর ১৯৮৪র অক্টোবর মাসে আবার ওই একই প্লাজমা সেটের পর্দায় রয়টার নিউজের মাধ্যমে আমরা তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির হত্যাকান্ডের খবর দেখতে পাই।

সম্ভবতঃ ১৯৮৩র মাঝামাঝির দিকে রেসিডেন্ট ম্যানেজার মিঃ গুন্থার এরেনহোল্ড পদোন্নতি পেয়ে প্যান পাসিফিক চেইনেরই থাইল্যান্ডের এক হোটেলেরে জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে বদলী হয়ে যান। ফরাসী নাগরিক মিঃ রেজিস কাতোয়া নতুন রেসিডেন্ট ম্যানেজার হিসেবে হোটেলে যোগদান করেন। ১৯৮৪র শেষের দিকে হোটেলের প্রথম জেনারেল ম্যানেজার মিঃ টনি ব্রুগামেন্স হোটেল থেকে চলে যান। এর পরিপ্রেক্ষিতে মিঃ গুন্থার এরেনহোল্ড সোনারগাও হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন।

এরই ভিতর ১৯৮৪ সালের মাঝামঝির দিকে এফ এন্ড বি ম্যানেজার মিঃ মাইক হারম্যান চলে যান। এর কয়েক মাস পরে মিঃ পিটার এমবার্গার নতুন ফুড এন্ড বেভারেজ ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করেন। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য জনাব শাহাদত হোসেন এবং জহিরুল হক চৌধুরী যৌথভাবে এফ এন্ড বি ডিপার্টমেন্টের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। একজন অপারেশন অন্যজন এডমিনিষ্ট্রেশন দেখাশুনা করতেন।

১৯৮৪ সালের মাঝামাঝির দিকে রেষ্টুরেন্ট ম্যানেজারদের আভ্যন্তরীন রদবদল করা হয় যার ফলশ্রুতিতে আব্দুল হাসিব কারওয়ান সরাই থেকে খৈয়াম বারে বদলী হন। একইভাবে আভ্যন্তরীন পূণর্বিন্যাসের কারণে খৈয়াম বার থেকে আগে বদলী হয়ে যাওয়া পুরানো কর্মীদেরকে আবারও বারে ফেরত নেয়া হয়। ১৯৮৪ সালের শেষদিকে বার ম্যানেজার আব্দুল হাসিব বিয়ে করেন এবং এফ এন্ড বি ম্যানেজার মিঃ পিটার এম্বার্গার তার বৌভাত অনুষ্ঠানে যোগদান করেন।

এই সময়ের আরেকটি ঘটনার কথা মনে পরছে। ১৯৮৪ সালে কোন একদিন বিকালের শিফটে ডিউটি করার সময় কি কারনে যেন হঠাৎ করে কার্ফিউ জারি করা হয়। ডিউটি শেষে সে রাতে কারোর পক্ষেই হোটেল থেকে বের হওয়া সম্ভব হয়নি। হোটেল থেকে সবাইকে বালিশ, বিছানার চাদর সরবরাহ করা হয় আর বলরুমে ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়। বলরুমের অন্য অংশে বড় স্ক্রীণের প্লাজমা টিভিতে মুভি দেখানোর ব্যবস্থাও করা হয়।

১৯৮৪ সালের শেষদিকে আমি রিয়াদের একটি হোটেল থেকে চাকুরীর অফার পাই। আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু মাহবুব যে আমার চাইতে কিছুদিন আগেই ওই হোটেলে যোগ দিয়েছে, জানাল যে হোটেলটি ভাল এবং আমি নির্দ্বিধায় ওখানে যোগ দিতে পারি। সোনারগাঁও হোটেলের মোট ১১ জন ষ্টাফ একই দিনে রিয়াদের আল খোজামা হোটেলে যোগদান করি। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি এবং সোনারগাওয়ের আরেক সহকর্মী রফিক মাত্র আট মাস রিয়াদে ছিলাম, সেই বছরেরই আগষ্ট মাসে আমরা ঢাকায় ফেরত যাই। ঢাকায় ফিরে আসার পরে আমরা যদিও আবার সোনারগাও হোটেলে যোগদানের চেষ্টা করেছি, ততদিনে সোনারগাঁও হোটেলে থেকে চাকুরী ছেড়ে চলে যাওয়া কর্মচারীদেরকে পুনরায় নিয়োগদানের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত আমাদের অনুকুলে ছিলনা। পুনরায় নিয়োগপ্রাপ্ত প্রাক্তন এফ এন্ড বি ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীদের ভিতর আব্দুল জলিল (তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি) চাকুরী চালিয়ে গেলেও বারনার্ড রোজারিও এবং এ, এফ, এম, নুরুল ইমাম এই দুইজন তাদের পুনর্নিয়োগের কয়েক মাসের ভিতরই আবার চাকুরী ছেড়ে বিদেশে চলে যায় যে কারণে হোটেল কর্তৃপক্ষ এমন কঠোর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল।

১৯৮৫র নভেম্বর মাসে হোটেলে ঐতিহাসিক একটি বিপ্লব ঘটে যায় যার ফলশ্রুতিতে হোটেলের কর্মচারী ইউনিয়ন তাদের দীর্ঘদিনের জমে থাকা বেশ কিছু দাবী দাওয়া তাৎক্ষণিকভাবে আদায় করে নিতে সক্ষম হয়। এর ফলশ্রুতিতে কর্মচারীদের আর্থিক এবং আন্যান্য কিছু সুযোগ সুবিধা বেড়ে যায়। ১৯৮৫র জানুয়ারীতে হোটেল ছাড়বার সময়ে সে মাসের সার্ভিস চার্জ হিসাব করা হয়েছিল ৭,০০০/- টাকা যা কি না ওই সময় পর্যন্ত প্রদত্ত সর্বোচ্চ সার্ভিস চার্জ। আর নভেম্বর বিপ্লবের পরে সার্ভিস চার্জের টাকা কোন মাসে ১৭,০০০/- পর্যন্ত উঠেছে।

প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের পর সোনারগাও হোটেল থেকে বেশ কিছু সহকর্মী ইরাকের বাগদাদে আল রশিদ হোটেলে চাকুরী নিয়ে চলে যায় আবার অনেকে অষ্ট্রেলিয়া অভিবাসী হয়ে যায়।

সোনারগাঁও হোটেলের পরে ২টি বড় আন্তর্জাতিক হোটেল চেইনের সাথে কাজ করার পরেও সোনারগাও হোটেলের কিছু কিছু ব্যাপারে এখনো গর্ববোধ করি। প্রশ্নাতীতভাবে সোনারগাঁও হোটেল বাংলাদেশের গর্ব / অহংকার। বাংলাদেশের বদলে পৃথিবীর অন্য যে কোন বড় শহরে হলে এই হোটেলটিই সিঙ্গাপুরের র‍্যাফলস, লন্ডনের গ্রসভেনর হাউস, নিউ ইয়র্কের ওয়াল্ডর্ফ এস্টোরিয়া অথবা দুবাইর বুরজ আল আরবের মত বিখ্যাত হোটেল বলে পরিচিত হত।

সেই ১৯৮১ সালে যে প্রশিক্ষণ আমরা সোনারগাঁও হোটেল থেকে লাভ করেছি এতবছর পরও সেগুলিই আমাদের পেশার মূল ভিত্তি এবং কোনরকম পক্ষপাতবিহীনভাবে বা একটুও না বাড়িয়ে আমি বলতে পারি যে আজ পর্যন্ত লাভ করা সকল পেশাগত প্রশিক্ষণের প্রায় ৮০% আমি সোনারগাঁও হোটেল থেকে লাভ করেছি। বাকী ২০% কমতি হোটেলের কোন গাফিলতির জন্য না, বরং বলা যায় যে এটা সময়ের কারনে। প্রযুক্তি ও কিছু কিছু নতুন চিন্তাধারার যেহেতু সময়ের সাথে সাথে বিকাশ ও বাস্তবায়ন হয়, বাকী থাকা এই ২০ ভাগের তখনও পর্যন্ত কোন অস্তিত্ব ছিলনা।

আমি হোটেল ছেড়ে দেয়ার পরও বহু বছর যাবত আমার স্ত্রী তার চাকুরী চালিয়ে গেছে বলে হোটেলের সাথে আমার যোগাযোগ একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। পরবর্তী ষোল বছর যাবত বাৎসরিক ছুটিতে আমি দেশে গেলে বহু পুরানো বন্ধু ও সহকর্মীদের সাথে দেখাসাক্ষাত হতো।

সোনারগাঁও হোটেল শুধুমাত্র আমার জীবনের প্রথম কর্মক্ষেত্রই না, বরং বলা যায় আমার শিরায় প্রবাহিত রক্তের মত। এই চাকুরী থেকে আমি বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়েছি। ত্রিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই ঐতিহ্যময় হোটেলের সকল কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং বিশেষভাবে যারা এই হোটেলের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে জড়িত, সবাইকে প্রাণঢালা অভিনন্দন ও আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। সোনারগাও হোটেলের অব্যাহত উন্নতি ও সাফল্য কামনা করি।

ভালবাসি সোনারগাঁও হোটেলকে।

লেখকের মন্তব্যঃ এই লেখাটি নেহায়েতই একটি স্মৃতিচারণ।
হোটেলের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে যেসকল কর্মচারী, বিশেষ করে এফ এন্ড বি সার্ভিসের সহকর্মীরা, এই লেখাটি পড়লে কিছু পুরানো কথা এবং অতীতের স্মৃতি বিজড়িত দিনের কথা মনে পরবে। যদি আমি কোন কিছু বাদ দিয়ে থাকি তা আমাকে জানালে এখানে সংযোজন করা হবে।

অবশ্য আরও দুই শ্রেণীর পাঠকের কাছে লেখাটি ভাল লাগতে পারে।

 বর্তমানে কর্মরত এবং হোটেল চালু হওয়ার পর যারা সোনারগাও হোটেলে যোগদান করেছেন তারা জানতে ও বুঝতে পারবেন যে হোটেলের প্রতিষ্ঠাকালে আমরা কেমন সময় অতিক্রান্ত করেছি।
 হোটেল লাইনে কাজ করেন না এমন পাঠকরা হোটেল পেশার কিছু খুটিনাটি ও বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাবেন।

এই লেখাটি কোন অবস্থাতেই কাউকে তিরস্কার, সমালোচনা অথবা তোষামোদ করার জন্য নয়।


হোটেল পেশার বাইরের মানুষদের জন্য কিছু কথাঃ কয়েকটি কারণে সোনারগাও হোটেল বাংলাদেশের জন্য মাইলফলক হয়ে আছে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে এটি একটি সেরা স্থাপত্য নিদর্শন যেখানে প্রায় ৬০০ দক্ষ ও অদক্ষ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। শুরু থেকেই হোটেলটি একটি লাভজনক ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। এই হোটেলে নিয়োগ লাভ করার পর আরব্য-উপসাগরীয় এবং পশ্চিমা দেশগুলিতে চাকুরীরত অনেকেই দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে এই হোটেল চালু হবার থেকেই বাংলাদেশের মানুষজন হসপিটালিটি সেক্টরকে (হোটেল, রেষ্টুরেন্ট, ফাস্ট ফুড, ক্যটারিং, ট্রাভেল এন্ড ট্যুরিজম ইত্যাদি) একটি পেশা হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন এবং হোটেল পেশাকে অন্তত কিছুটা হলেও নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শুরু করেছেন।

১৯৬৪ সালে ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল, ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ হোটেল অথবা ১৯৬৮তে ঢাকার পূর্বাণী হোটেলের সকল পূর্বসুরী কর্মচারীদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা এই শিল্পে আমাদের পথিকৃত হয়ে থাকবার জন্য। পূর্ববর্তী হোটেলগুলির সাথে একটা বড় তফাত এখানেই যে সোনারগাও হোটেলের কর্মচারীরা হোটেল চালু হবার আগে এবং চাকুরী চলাকালীন সময়েও অব্যাহত প্রশিক্ষণ পেয়ছে।

আমাদের দেশের খৃষ্টান সম্প্রদায়ও হসপিটালিটি শিল্পে তাদের পথিকৃত ভূমিকা ও বিশেষ অবদানের জন্য প্রশংসার দাবীদার। বিশেষ করে রন্ধনশিল্পে ইতোমধ্যে তারা বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। ইউরোপীয় শেফদের অনেকেই জানেন যে বাংলাদেশের গোমেজ অথবা রোজারিও রা ভাল রন্ধনশিল্পী। ৭০ দশকের মধ্যভাগ থেকে আরব্য-উপসাগরীয় এলাকার অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে সেখানকার প্রতিটি দেশেই উন্নয়ন কর্মকান্ডের জোয়ার নেমে আসে যার ফলশ্রুতিতে বিশ্বের প্রায় সব দেশের মানুষের জন্যই এই অঞ্চলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী লোক মধ্যপ্রাচ্যে চাকুরী পায়। প্রায় সকল আন্তর্জাতিক হোটেল চেইন পরিচালনাকারী কোম্পানীই মধ্যপ্রাচ্যের সকল দেশে, এমনকি কোন কোন দেশে তাদের একাধিক হোটেল চালু করে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের রেষ্টুরেন্ট ও ফাস্ট ফুড চেইনগুলি একই শহরে তাদের একাধিক শাখা খোলে। হাসপাতাল, কনষ্ট্রাকশন কোম্পানী বা অন্যান্য বড় বড় যে সকল প্রতিষ্ঠানে কয়েকশত বা হাজারেরও বেশী কর্মচারী নিয়োজিত, তাদের খাবার সরবরাহ অথবা সেখানকার ক্যাফেটেরিয়া চালানোর দায়িত্ব পায় বিভিন্ন ক্যাটারিং কোম্পানী। ফলে অন্যান্য চাকুরীর পাশাপাশি প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশী হোটেল, রেষ্টুরেন্ট, ফাস্ট ফুড চেইন, ক্যাটারিং কোম্পানী বা এই জাতীয় কোম্পানীগুলিতে চাকুরীর সুযোগ পায়।

বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য যারা ইউরোপ অথবা আমেরিকা / কানাডায় যান তাদের জন্য রেষ্টুরেন্ট, ফাস্ট ফুড চেইন অথবা সুপার মার্কেটের কাজ হচ্ছে সবচেয়ে সহজলভ্য। একটি মজার ব্যাপার হলো, যুক্তরাজ্যে ভারতীয় রেষ্টুরেন্ট ও টেক-এওয়ে বলে পরিচিত ব্যবসায়ের অন্তত ৯০%ই বাংলাদেশী মালিকানাধীন এবং তাদেরই দ্বারা পরিচালিত। যাই হোক, এ সকল ছাত্ররা রেষ্টুরেন্ট চাকুরীকে তাদের পেশা হিসেবে নেয়না, বরঞ্চ তাদের কাছে এটা নেহায়েৎই নিজেদের ভরণপোষনের একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা মাত্র। এই চাকুরীর কথা তারা তাদের পরিবার পরিজন বা বন্ধুবান্ধবদের কাছে কখনোই বলে না এমনকি তাদের জীবন-বৃত্তান্তেও উল্লেখ করে না। অন্যদিকে, পশ্চিমা দেশের ছেলেমেয়েরা তাদের ছুটির সময়ে পারিবারিক ব্যবসায়ে, সেটা রেষ্টুরেন্ট, বেকারী বা ছোট হোটেল যা ই হোক না কেন, কাজ করে টাকা উপার্জন করে তাদের পরবর্তী গ্রীস্মকালীন ছুটির সময় বেড়াতে যাওয়ার জন্য এবং এসব কাজের কথা জীবন-বৃত্তান্তে উল্লখ করতে তারা মোটেও কুন্ঠিত বোধ করে না।



একটি ভুল ধারণাঃ হোটেলে চাকুরী করেননা এমন অনেক মানুষই হোটেলের মহিলা কর্মীদের সমন্ধে একটি মারাত্মক ভুল ধারনা পোষণ করে থাকেন এবং তাদেরকে বাঁকা চোখে দেখেন এই ভেবে যে এরা হয়তোবা হোটেলে অবস্থান করা অতিথিদের মনোরঞ্জন অথবা অতিথিদের সাথে কোন অবৈধ কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকে বা সেরকম সুযোগ পায়। সম্পূর্ণ ভুল। এটা থাইল্যান্ড বা অন্য কোন দেশ না। মনে রাখবেন, অন্য যে কোন চাকুরীর মত হোটেলে মহিলাদের চাকুরীও সম্পূর্ণ নিরাপদ। শুধুমাত্র কোন মহিলা কর্মী নয়, অন্য যে কোনও হোটেল কর্মী যার কাজের পরিধি অতিথিদের রুমে এমনকি ফ্লোর পর্যন্ত যাওয়ার সাথেও সম্পর্কযুক্ত নয়, তারা কখনোই গেষ্টরুমে যাওয়াতো দুরের কথা, ফ্লোর পর্যন্তই যেতে পারে না। অননুমোদিতভাবে কেউ গেলে তার জন্য শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। রুমবয় বা চেম্বারমেইড যাদের কাজ অতিথিদের কামড়া পরিস্কার করা, যে কোন রুম পরিস্কার করার জন্য যতটুকু সময় দরকার সেই সম্পূর্ণ সময়ের জন্য রুমের দরজা খোলা রাখতে হবে, বন্ধ করা যাবে না। ফ্লোর সুপারভাইজার সারাক্ষণই চক্কর মারতে থাকে। তাছাড়া শিফটের শুরুতেই প্রত্যেককে তার কাজ বুঝিয়ে দেয়া হয়, কাজেই নিজের নির্দিষ্ট কাজের জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার সময় বা সুযোগ কোনটাই হয় না। দুপুরের শিফটের কাজ শেষ হলে মহিলা কর্মীদেরকে রাতের বেলায় হোটেলের গাড়ীতে আনসার পাহাড়ায় বাড়ীতে নামিয়ে দেয়া হয়।

হোটেলে চাকুরী করলেই কোন মহিলার চরিত্র খারাপ এমনটা ভাবার কোন অবকাশ নেই। কেউ খারাপ বা অশালীন কিছু করতে চাইলে সেটা অন্য যে কোন মহৎ পেশায় নিয়োজিত থেকেও যেমন করতে পারে আবার কেউ ভাল ও নৈতিক জীবনযাপন করতে চাইলে পেশার তারতম্য ব্যতিরেকে যে কোন প্রতিকুল পরিবেশেও সেটা করতে পারে। এটা সম্পূর্ণই নির্ভর করে একজন ব্যক্তির উপড়ে, তার পেশার উপড়ে না।


পর্যটন শিল্পের বিকাশ আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত ততোটা ঘটেনি যদিও বিশ্বব্যাপী কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে হসপিটালিটি ইন্ডাষ্ট্রীর অবস্থান সেরা দশটির ভিতরে। মানুষের সাথে মেলামেশাতে আন্তরিক আগ্রহ এবং বাড়তি কিছু করার জন্য নিজে থেকে প্রস্তুত থাকলে যে কারোর পক্ষেই হোটেল শিল্পে অন্য যে কোন পেশার তুলনায় আরো তাড়াতাড়ি পদোন্নতি ঘটার অফুরন্ত সুযোগ রয়েছে। চাকুরীরত অবস্থায় প্রদত্ত ট্রেনিংসমুহ যে শুধুমাত্র কারো পেশাগত দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে তা ই নয়, ব্যক্তিগত জীবন এমনকি সামাজিক জীবনের উন্নতিবিধানেও এই সব ট্রেনিং যথেষ্ট অবদান রাখে।
হোটেল পেশাতে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে, দরকার শুধুমাত্র খুজে বের করার।


সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১১ দুপুর ২:০৬
৯টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×