somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একাত্তরের উত্তাল মার্চের ছাব্বিশটি দিন (শেষ পর্ব)

২৫ শে মার্চ, ২০১২ দুপুর ২:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২১ মার্চ ’৭১, রোববার
দেশব্যাপী চলমান অসহযোগ আন্দোলনের আজ ২১ তম দিন। সরকারি-বেসরকারি ভবনে কালো পতাকা। মিছিল প্রতিটি জেলাশহরে, শহরের প্রতিটি রাস্তায়। জয়দেবপুরে ১৯ মার্চ জারিকৃত সান্ধ্য-আইন ৬ ঘন্টার জন্য প্রত্যাহার করা হয়। বিকেলে আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য এ আইন বলবৎ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ ২৩ মার্চ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্য বর্জন সপ্তাহ পালনের কর্মসূচী ঘোষণা দেয়। মহিলা সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত মহিলা সমাবেশে সেনাবাহিনীর প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে প্যারামিলিটারি গঠনের আহ্বান। নারায়নগঞ্জে মহিলাদের মৌন মিছিল। বিক্ষুব্ধ লেখক-শিল্পীরা শহীদমিনারে বিপ্লবী সাহিত্য ও গণসঙ্গীতের আয়োজন করেন। শত শত মিছিল শহীদমিসার হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে। বঙ্গবন্ধু মিছিলকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন- জনতার জয় অবধারিত।’ চট্টগ্রামে মজলম জননেতা মওলানা ভাসানী বলেন, জেনারেল ইয়াহিয়ার উচিত মুজিবের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে সরে পড়া। তিনি আরও বলেন, মুজিব যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে তাহলে বিশ্বের সমস্ত স্বাধীনতাপ্রিয় জাতি স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে।’
বঙ্গবন্ধু পেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেড় ঘন্টা ব্যাপী এক অনির্ধারিত বৈঠকে মিলিত হন। নিজ বাসভবনে মিলিত হন বিশিষ্ট আইনজীবী এ. কে ব্রোহির সঙ্গে। বিকেলে ইয়াহিয়ার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে মিলিত হওয়ার জন্য ভুট্টো অত্যন্ত কড়া প্রহরায় তাঁর দলীয় ১২ জন নেতা নিয়ে ঢাকায় আসেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এ তখন কালো পতাকা উত্তোলিত। হোটেলের যাত্রাপথে জনতার ভুট্টোবিরোধী বিক্ষোভ স্লোগান। সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া-ভুট্টো ২ ঘন্টা ব্যাপী রূদ্ধদ্বার বৈঠক। রাতে হোটেলে দলীয় শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক। পরে কাউন্সিল মুসলীগ লীগ নেতার কক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের মধ্যে মত-বিনিময় সভা।
অন্যদিকে, প্রতিদিন ৬টি থেকে ১৭টি পিআইএ ফ্লাইট, বোয়িং ৭০৭ বিমান ও জাহাজযোগে সেনা ও যুদ্ধরসদ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি থেকে শ্রীলঙ্কার কলম্বো হয়ে ঢাকা আসতে থাকে। জেনারেল ইয়াহিয়া তাঁর সামরিক উপদেষ্টা জেনালের হামিদ খান, জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা প্রমুখদের নিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে (ইস্টার্ন হেডকোয়ার্টারস) সামরিক প্রস্তুতিতে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে প্রয়াস পান।

২২ মার্চ ’৭১, সোমবার
২২তম দিনে গড়িয়ে যাচ্ছে অসহযোগ আন্দোলন; মিছিলে মিছিলে সয়লাব দিন থেকে রাত রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের রাজপথ। প্লটন ময়দানে সশস্ত্র বাহিনীর প্রাক্তন সদস্যদের সমাবেশ ও কুচকাওয়াজ। বায়তুল মোকাররমে কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানী সৈনিকদের সমাবেশ মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ধানমন্ডিতে মার্কিন কনসাল জেনারেলের বাড়িতে বোমা ছোড়া হয়। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে আহমদ শরীফের সভাপতিত্ব ও আহসান হাবীব, শামসর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসল হক প্রমুখের অংশগ্রহণে কবিতাপাঠের আসর।
পূর্বনিধারিতভাবে ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক থাকলেও আকস্মিকভাবে ইয়াহিয়া-বঙ্গবন্ধু-ভুট্টো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার কয়েকটি সংবাদপত্রে বাংলার স্বাধীকার শিরোনামে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। প্রথম পাতায় স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র-খচিত পতাকা। এ ক্রোড়পত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত একটি বাণী এবং অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, রেহমান সোবহান, এএইচএম কামারুজ্জামান প্রমুখের প্রবন্ধ ছাপা হয়।
রাতে ভুট্টো ছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা মমতাজ দৌলতানা, ওয়ালি খান, মুফতি মাহমুদ মীর, গাউস বক্স, সর্দার হায়াত খানের সঙ্গে ইয়াহিয়ার পৃথক পৃথক বৈঠক। ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে তিনি এক বাণীতে বলেন, পাকিস্তান এখন এক ক্রান্তিলগ্নে উপনীত। একইদিনে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা খান আব্দুল কাইয়ুম খান ও মাওলানা শাহ আহমেদ নূরানীকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানান।

২৩ মার্চ ’৭১, মঙ্গলবার
২৩তম অসহযোগ দিবসেও দেশের সর্বত্র প্রতিটি গৃহ ও যানবাহনে কালো পতাকা উত্তোলিত। পূর্ব ঘোষণা মোতাবেক আজ সারাদেশে প্রতিরোধ দিবস পালিত। এ প্রতিরোধ আন্দোলনের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাঁর নিজ বাসভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের মানচিত্র-খচিত পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় তিনি আওয়ামীলীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সালাম গ্রহণ করেন। তথাকথিত এ পাকিস্তান দিবসে প্রেসিডেন্টভবন, ক্যান্টনমেন্ট ও বিমানবন্দর ছাড়াও কোথাও পাকিস্তানী পতাকা দেখা যায়নি। ঢাকাস্থ ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশন এবং সোভিয়েত কনস্যুলেটে সকাল থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন থাকে। চীন, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল প্রথমে তাদের জাতীয় পতাকার সঙ্গে পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলন করলেও পরে জনতার রূদ্ররোষে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে নেয়। আর মার্কিন দূতাবাসে কোনো পতাকাই তোলা হয়নি। ঢাকা টেলিভিশনেও পাকিস্তানী পতাকা উড়েনি, উর্দু সঙ্গীত বাজেনি।
সকালে পল্টন ময়দানে পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দশ প্লাটুন গণবাহিনী কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করে। এ সময় তাঁরা স্বাধীন বাংলার পতাকাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সালাম ও মার্চপাস্ট করে সম্মান জানায়। এরপর তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাসভবনে গিয়ে গার্ড অব অনার প্রদান করে। বঙ্গবন্ধু তাঁদের সালাম গ্রহণ করেন। পল্টন ময়দানে ভাসানী ন্যাপ-এর উদ্যোগে সমাবেশ এবং শহীদমিনারে ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। বায়তুল মোকাররমে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যৌথ উদ্যোগে এক বিশাল জনসমাবেশ অনষ্ঠিত হয়। এ সভায় স্বাধীনতা রক্ষায় সশস্ত্র প্রস্তুতি গ্রহণের উদ্দেশ্যে জনসাধারনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। চট্টগ্রামে অধ্যাপক আজিজুর রহমান মল্লিক, অধ্যাপক সৈয়দ আহসান, ড. আনিসুজ্জামান প্রমুখের নেতৃত্বে বিক্ষোভ সমাবেশ ও প্রতিবাদ-মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। সৈয়দপুরে সেনাবাহিনী ও গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। সন্ধ্যায় সেখানে কারফিউ জারি করে অবাঙালি ও সেনাবাহিনী যুক্তভাবে স্থানীয় মানুষের জীবন ও সম্পত্তির উপর হামলা, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে। ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেতৃত্বে থাকা লে. জেনারেল মাসুদুল হককে ঢাকা সেনানিবাসে গৃহবন্দী করা হয়। তাঁর স্থলে জয়দেবপুরে পাঠানো হয় ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট কমান্ডার লে. জেনারেল রকিবকে।
প্রেসিডেন্টভবনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও ড. কামাল হোসেন ইয়াহিয়ার উপদেষ্টা এমএম আহমেদ, বিচারপতি কর্নেলিয়াস, লে. জে. পীরজাদা ও কর্নেল হাসানের সঙ্গে সকাল-বিকাল দুই দফা বৈঠক করেন। এতে আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ একটি খসড়া শাসনতন্ত্র পেশ করেন। লে. জে. পীরজাদা এ শাসন্তন্ত্রের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়গুলো মেনে নেওয়া হবে বলে আভাস দেন। পাকিস্তানী বিশিষ্ট আইনজ্ঞ এ.কে ব্রোহি সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং ক্ষমতা হস্তান্তরে আইনগত কোনো বাধা নেই।’ পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট ভবনের এক মুখপাত্র বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণের পদ্ধতি চলছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এক দিনের মধ্যে এ ব্যাপারে ঘোষণা দিচ্ছেন।
অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সেনাকর্মকর্তাদের সঙ্গে ইস্টার্ন কমান্ড সদর দপ্তরে আলোচনা বৈঠক এবং বৈঠক-পরবর্তী ভাষণ দান করেন। করাচিতে ভুট্টো-সমর্থকদের বাঙালি কলোনিতে হামলা, অগ্নিসংযোগ, গুলিবর্ষণ ও লুটতরাজ চলে, হতাহত হয় বেশ কয়েকজন।

২৪ মার্চ ’৭১, বুধবার
অসহযোগ আন্দোলনের ২৪ দিনের মাথায় একইররকম বিক্ষুব্ধ মিছিলে মিছিলে উত্তাল শহরের রাজপথগুলো বঙ্গবন্ধুর অভিমুখে গমন করে। বঙ্গবন্ধু তাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আমার মাথা কেনার শক্তি কারো নেই। বাংলার মানুষের সাথে, শহীদের রক্তের সাথে আমি বেঈমানি করতে পারব না। আমি কঠোরতর নির্দেশ দেয়ার জন্য বেঁচে থাকব কিনা জানিনা। দাবি আদায়ের জন্য আপনারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।’ যশোর পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস-এর হেডকোয়ার্টারসে জওয়ানরা জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান গেয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন এবং পতাকাকে অভিবাদন করে।
এদিন ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক বাতিল হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট-ভবনে প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের নব নতুন নাম নিয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে লে. জে. পীরজাদা টেলিফোনে পরবর্তী বৈঠকের সময় ধার্য এবং তখন নাম নিয়ে কথা বলা হবে বলে জানান। কিন্ত সে টেলিফোন আর আসেনি। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবকে বিদায় জানিয়ে করাচি ফিরে যান।
চট্টগ্রাম পোর্টের ১৭ নং জেটিতে এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে যুদ্ধাস্ত্র নামানো নিয়ে হাজার হাজার বাঙালি শ্রমিক, বাঙালি সৈনিক ও সাধারণ মানুষ চট্টগ্রামে ব্যারিকেড রচনা করে। এক জরুরি বৈঠকের কথা বলে লে. জে. টিক্কা খান দুপুরবেলা হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম থেকে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকায় সরিয়ে নিয়ে আসেন। সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী। তাঁদেরকে সেনানিবাসে বন্দী করে রাখা হয়। ঢাকার বাইরে হত্যালীলা শুরু করে দেয় পাকবাহিনীর এরিয়া কমান্ডাররা। সৈয়দপুরে পাকসেনা ও অবাঙালি বিহারীরা যৌথভাবে গণহত্যা শুরু করে। দিনের প্রথমভাগের মধ্যেই রংপুরে পাকসেনাদের কয়েকটি হেলিক্পটার অবতরণ করে। এখানে বিগ্রেড কমান্ডারের বাসভবনে গোপন শলাপরামর্শ করে মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান প্রমুখ। মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা এবং রাও ফরমান আলী দটি হেলিকপ্টারে চড়ে সবকটি সেনানিবাসে গিয়ে ব্রিগেডকমান্ডারদের নীলনকশা সম্পর্কে নির্দেশ প্রদান করেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমানপথে আরো দুই ডিভিশন সেনা ও যুদ্ধরসদ আসছে।
চট্টগ্রাম জেলা সংগ্রাম কমিটি রাত দশটায় জনাব এম আর সিদ্দিকীর বাসায় বৈঠককালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এক জরুরী রার্তা এসে পৌঁছে। বার্তার মূল বিষয়বস্তু ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন ও প্রতিরোধ গড়ে তোলো।

২৫ মার্চ ’৭১, বৃহস্পতিবার
ইতিহাসের এক তমসাক্লিষ্ট ভয়াল অশুভক্ষণ নামে এই বাংলায়, এই ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে। নিরস্ত্র দেশবাসীর ওপর হানাদার পাকসেনাদের অতর্কিত হামলায় নির্মমভাবে নিহত হয় পঞ্চাশ হাজারের বেশি ঘুমন্ত মানুষ।
দিনটি ছিল অসহযোগ আন্দোলনের ২৫তম দিন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। সর্বত্র শোকের কালো পতাকা আর পাশপাশি আশাদীপ্ত স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীন। সারাদিন সভা-সমাবেশ-শোভাযাত্র-মিছিল-মিটিং। সকালে প্রেসিডেন্টভবনে ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও উভয় দলের উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠক। বিকেলে পল্টন ময়দানে পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে বিশাল জনসভা। বিকেলেই সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু রংপুর, সৈয়দপুর, জয়দেবপুর ও চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যার প্রতিবাদে আগামী ২৭ মার্চ হরতাল আহ্বান করেন।
অন্যদিকে, রাতের অন্ধকারে শেষবারের মতো ঢাকা ত্যাগ করার সময় সেনাবাহিনীর ওপর এ কাপুরোষোচিত নির্দেশ জারি করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তিনি প্রেসিডেন্টভবন থেকে সেনানিবাসে যান। রাত ৮ টায় করাচি রওয়ানা দেন। রাত ৯ টার মধ্যে এ খবর ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর কাছে এ খবর আগেই পৌঁছে। রাত ৯টার পর তাঁর বাসভবনে উপস্থিত নেতা-কর্মী-সমর্থক-সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধানের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট অখন্ড পাকিস্তানের সমাপ্তি টানতে চলেছেন।’ তিনি আরও বলেন, আমাকে হয়তো ওরা হত্যা করতে পারে। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে আমার সমাধির ওপর একদিন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করবেই।’
রাত ১১ টায় পাকসেনারা তাদের পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক অপারেশন সার্চলাইটের’ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। রাত সাড়ে ১১ টায় সেনারা সেনাছাউনি থেকে বেরিয়ে আসে। মাইকযোগে সারা শহরে কারফিউ জারি করে। এরপর প্রথমইে তারা ফার্মগেট এলাকায় প্রেিতরাধের মুখোমুখি হয়। গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া হয়। অতপর গর্জে ওঠে পাকিস্তানী সেনাদের মেশিনগান। পাখির মত লুটিয়ে পড়তে থাকে স্বাধীনতাকামী মানুষ। এভাবেই খন্ডযুদ্ধ চলতে থাকে ঢাকার রাস্তায় রাস্তায়। ডিনামাইড ব্যবহৃত হয় ব্যারিকেড সরানোর জন্য। ইয়াহিয়ার সেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষক কলোনি, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক, নীলক্ষেতসহ ঢাকার নতুন ও পুরাতন আবাসিক এলাকা, এমনকি বস্তিবাসীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ করে গণহত্যা সংঘটিত করে।

পাকসরকারের সেনারা এদেশের জনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন : আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়েছে। চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। আমার এ ঘোষণা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিন। শত্র“র বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।” এ ঘোষণা লিখিত আকারে পিলখানা ইপিআর ব্যারাক ও অন্যান্য স্থান থেকে ওয়ারলেসের মাধ্যমে বার্তা আকারে সারাদেশে পাঠানো হয়।
একের পর এক প্রতিরোধব্যূহ ভেঙ্গে হানাদাররা রাত দেড়টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে আসে। ভেতরে প্রবেশ করে এলোপাথারিভাবে গুলিবর্ষণ করতে করতে। এরপর শত্র“সেনারা বন্দি বঙ্গবন্ধুকে সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তর শেরে বাংলায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে সেনানিবাস এবং এরপর আদমজী কলেজের একটি একটি কক্ষে সকাল পর্যন্ত বন্দি করে রাখে।

২৬ মার্চ ’৭১, শুক্রবার
পাকসেনারা দলে দলে রাস্তায় নেমে মেশিনগান আর কামানের গোলার আঘাতে জর্জরিত করতে থাকে নাগরিকদের আবাসস্থল, বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার অফিস, শহীদমিনার। তারা দুপুর থেকে মধ্যরাত অবধি ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। হানাদারদের সহায়তা করে অবাঙালি বিহারীরা। এদিন সকালে কড়া সামরিক প্রহরায় ঢাকা ত্যাগকারী পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে পৌঁছে ঢাকায় সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যাকে প্রশংসা করেন। রাত ৮ টার বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সরকারের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শেখ মুজিবর রহমান অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজ করেছেন। ... শেখ মুজিবর রহমান সবসময়ই গঠনমূলক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ব্যাপারে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।... লোকটি এবং তাঁর দল পাকিস্তানের শত্র“। ... এ অপরাধের জন্য তাঁকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।’
সমগ্র ঢাকাশহর পাকসেনাদের কাছে অবরুদ্ধ। সারাদেশে এখনো স্বাধীন পতাকা উড্ডীণ। গত রাতের গণহত্যার খবরে দেশের সর্বত্র সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু। এ সংগ্রামের অন্যতম স্থল বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। সেখানে বঙ্গবন্ধু-ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণা বাংলা ও ইংরেজিতে হ্যান্ডবিল আকারে ছাপিয়ে বিলি করা হয়। বিলি করা হয় রাজশাহী, খুলনা, সিলেটসহ বড় বড় শহরগুলোতে। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্বপাদক এম.এ হান্নান দুপুর ২ টা ১০ মিনিট এবং ২ টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশকে সাহায্যের জন্য বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ ও রাষ্ট্রসমূহের প্রতি আহ্বান জানান। এরপর রাত ৭টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রামস্থ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এ সময় চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপর্ণ স্থানগুলোতে ছাত্র-যুবক-কৃষক-শ্রমিক-পুলিশ-ইপিআর বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত বিপ্লবী বাহিনী স্থানীয় পাকসেনাদের প্রতিহত করার প্রয়াস পায় এবং অধিকাংশ স্থানেই প্রাথমিকভাবে সফলতা লাভ করে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১২ দুপুর ২:৪৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×