somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কীভাবে সৃষ্ট হলো বিশ্ব ও মহাবিশ্ব (বিবিধ মতবাদের নিরিখে)

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কয়েক হাজার বছর আগে সভ্যতার ইতিহাসে যখন মিশরীয়রা নিজেদের সবচেয়ে জ্ঞানী বলে দাবী করত, তখনও তারা ভাবত প্রতিদিন যে সূর্য দেখা যায় তাহলো এক স্বর্গীয় রাজহাঁসের ডিম। আধুনিক বিজ্ঞানের পূর্বকালে এমনকি এখনও বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও আদিবাসী জাতিগুলোর সৃষ্টিতত্ত্বে মহাবিশ্ব, পৃথিবী, গ্রহ-নক্ষত্রের উদ্ভব ও আবর্তন নিয়ে এমনিসব উদ্ভট কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। সেখানে পৃথিবী সৃষ্টির পেছনে ঈশ্বরের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, এবং এই সৃষ্টি সম্পন্ন হয়েছে নিকট অতীত কালে। যেমন- বুক অব জেনেসিসে বলা হয়েছে, পৃথিবী ও মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে পাঁচ হাজার বছর আগে। একইসাথে ধর্মমতানুসারে ঈশ্বর মহাবিশ্বকে সৃষ্টির সময়ে যে নিয়মকানুন দ্বারা পরিচালিত করেছেন সে নিয়মেই আজো তা পরিচালিত হচ্ছে। তথা পৃথিবীতে ঈশ্বরের সমগ্র সৃষ্টির কল্যানে সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্রমালা নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ধর্মমতে উল্লিখিত এই বিশ্বাসের বশবর্তী সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিখ্যাত জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ এমনকি মহাদার্শনিক এরিস্টোটলও এই বিশ্বাসে স্থির ছিলেন যে, পৃথিবী স্থির এবং চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র পৃথিবীর চারিদিকে বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান। খ্রিষ্টীয় ২য় শতকে টলেমি এই মতের উপর ভিত্তি করে বিশ্বব্রহ্মান্ডের একটি প্রতিরূপ তৈরি করেন যেখানে পৃথিবীর অবস্থান কেন্দ্রস্থলে এবং তাকে কেন্দ্র করে চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্রের আটটি গোলক।

কিন্তু সৃষ্টিতত্ত্বের এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি মানুষ। পৃথিবীকেন্দ্রিক এই সৃষ্টিতত্ত্বে প্রথম আঘাত হানেন নিকোলাস কোপার্নিকাস নামক একজন পোলিশ পুরোহিত। ১৫১৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সূর্যকে কেন্দ্র ধরে এবং পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহের তার চারিদিকে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় মহাবিশ্বের একটি প্রতিরূপ উপস্থিত করেন। যেহেতু এই নতুন মতবাদ তৎকালে প্রতিষ্ঠিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে যায় সেহেতু তিনি ছদ্মনামে তাঁর তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীতে প্রায় ১ শতক পরে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ জোহান কেপলার ও গ্যালিলিও কোপার্নিকাসের মতবাদকে পুনর্জীবিত করে তোলেন। এ পর্যন্ত সাধারণভাবে মেনে নেওয়া হয়েছিল যে মহাবিশ্ব চিরকাল অপরিবর্তিত অবস্থায় বর্তমান ছিল, এবং তেমনিটিই থাকবে। কিন্তু আইজ্যাক নিউটনের মহাকর্ষবল তত্ত্ব মহাবিশ্বের এই আপাত স্থিরদশায় ভিন্ন মতের অবতারণ ঘটায়। নিউটনের আবিষ্কৃত মহাকর্ষবল তত্ত্বমতে কোনোকিছুই অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকতে পারেনা। মহাবিশ্ব সম্পর্কিত এই যুগান্তকারী চিন্তাকে দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট কিছুটা এগিয়ে নিলেও এই মতের পক্ষে প্রথম শক্তিশালী প্রমাণ হাজির করেন বিজ্ঞানী এডউইন হাবল। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি কালজয়ী পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে দেখান, যে দিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করা হয় সেদিকেই দেখা যাবে নীহারিকাগুলো আমাদের থেকে দূরে দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ হাবলের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী পৃথিবী ও তার চারিপাশের গ্রহ-নক্ষত্রমালা অতীতে পরস্পরের নিকটে ছিল এবং তারা ক্রমপ্রসারমান। হাবল উদ্ভাবিত এই মতের পক্ষে পরবর্তীতে মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের অপেক্ষবাদ প্রবল ভূমিকা রাখে। প্রায় অবিতর্কিত অবস্থায় এই মত প্রতিষ্ঠা পায় যে মহাবিশ্বের স্থান ও কালের শুরু হয় এক বৃহৎ বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে এবং তার শেষ হবে এক বৃহৎ সংকোচনের মাধ্যমে। ঠিক কীভাবে পৃথিবী ও মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো একমত না হলেও পৃথিবী যে আজকের মতো সুজলা-সুফলা ছিল না সে ব্যাপারে সবাই একমত।

মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কিত জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের চিন্তাধারা বিভিন্ন তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত, যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- বিগব্যাং তত্ত্ব, পৃথিবী সৃষ্টি নিয়ে রয়েছে নীহারিকা তত্ত্ব, জোয়ার তত্ত্ব, যুগ্ম ও ত্রিনক্ষত্রবাদ, অদ্বৈতবাদ, নব নীহারিকাবাদ ইত্যাদি। এ পর্বে এই মতবাদগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল।

মহাবিশ্ব সৃষ্টির বিগব্যাং তত্ত্ব

বিগব্যাং তত্ত্ব অনুসারে, আজ থেকে প্রায় দু’হাজার কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের সকল পদার্থ, শক্তি, স্থান ও কাল অসীম ঘন অবস্থায় একটি বিন্দুতে কেন্দ্রিভূত ছিল। এক সময় এক অজ্ঞাত কারণে সেই কেন্দ্রবিন্দুতে মহাবিস্ফোরণ সংঘটিত হয় যা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এই সৌরজগতের যাবতীয় গ্রহ-নক্ষত্রের সৃষ্টি, আমাদের পৃথিবীর সূচনা। বিশাল বিস্ফোরণের সেই মহেন্দ্রক্ষণে অসীম উত্তাপ ছিল কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়া পিন্ড বা কণাগুলোর মধ্যে। সেই আদি পদার্থের পিন্ডগুলোর মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া হতে থাকে ও তা প্রচন্ড গতিতে প্রসারিত হয়ে দূরে সরে যেতে থাকে। বিগব্যাং তত্ত্বের অনুসারীরা মহাবিস্ফোরণ-পরবর্তী ১০ থেকে ৪৩ সেকেন্ড পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাবলী সম্পর্কে কিছুই ধারণা করতে পারেন না।

তবে তাঁরা জানিয়েছেন, এ সময় পর্যন্ত মহাকর্ষীয় বিদ্যুত চুম্বকীয় বল, দুর্বল নিউক্লিয় বল ও সবল নিউক্লিয় মিথস্ক্রিয়া ইত্যাদি প্রাকৃতিক বল ঐ আদি পদার্থ-পিন্ডের মধ্যে একীভূত অবস্থায় ছিল। তবে উল্লিখিত সময়ের পরবর্তী পর্বে ক্রমশ তাপমাত্রা কমতে থাকে। জানা যায়, মহাবিস্ফোরণের ১ সেকেন্ড পর তাপমাত্রা নেমে এসেছিল এক হাজার কোটি ডিগ্রি কেলভিন-এ, যা বর্তমান সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রার চেয়ে এক হাজার গুণ বেশি। ২৫ সেকেন্ড পর এই তাপমাত্রা নেমে আসে ৪০০ কোটি ডিগ্রি কেলভিন-এ। এ সময় নিউট্রন ও প্রোটন গঠন শুরু হয়ে যায়। এবং তাপমাত্রা কমে ১০০ কোটি ডিগ্রি কেলভিন-এ নেমে আসলে ভারি হাউড্রোজেন বা প্লেকুটন ও নিউট্রণ দ্বারা গঠিত ডিউটোরিয়াম নিউক্লিক তৈরি হতে থাকে। এগুলো পরবর্তীতে হিলিয়াম এবং অল্পসংখ্যক হিলিয়াম থেকে সিসিয়াম ও বেরিলিয়াম তৈরি হয়। মহাবিস্ফোরণ পরবর্তী কয়েক ঘন্টায় এই রাসায়নিক বিক্রয়াগুলো সাধিত হয়। এবং পরবর্তী দশ লক্ষ বছর কেবল মহাবিশ্বের স¤প্রসারণ ঘটেছে। এরপর ধীরে ধীরে তাপমাত্রা কমে কয়েক হাজারে নেমে এলে অতি সূক্ষ্ম কণাগুলোর মধ্যেকার পারষ্পরিক বিদ্যুত চুম্বকীয় আকর্ষণের কারণে অভঙ্গুর পরমাণু গঠিত হয়। রূপান্তরের এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই মহাবিশ্ব স¤প্রসারিত ও শীতলতর হতে থাকে। কিন্তু আদি পিন্ডের অন্তর্ভুক্ত যে সমস্ত অঞ্চলের ঘনত্ব গড় ঘনত্বের চেয়ে কিছুটা বেশি, সে সকল অঞ্চলের অতিরিক্ত মহাকর্ষীয় আকর্ষণ স¤প্রসারণকে ধীর করে দেয়, এবং কোনো অঞ্চলে স¤প্রসারন বন্ধ হয়ে চুপসে যায়। চুপসে যাওয়ার সময় বাইরের পদার্থের মহাকর্ষীয় আকর্ষণের ফলে ঘূর্ণন সৃষ্টি হয়। এবং চুপসে যেতে যেতে এই অঞ্চলগুলো যত ক্ষুদ্র হতে থাকে ততই তাদের ঘূর্ণনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এইভাবেই ঘূর্ণায়মান চাকতির মতো নীহারিকাগুলোর জন্ম হয়েছে। অন্যদিকে যেসকল অঞ্চল পর্যাপ্ত মহাকর্ষীয় আকর্ষণবলের অভাবে ঘূর্ণন শুরু করতে পারেনি সেগুলো ডিম্বাকার বস্তুপিন্ডে পরিণত হয়। একই কারণে এদের চুপসে যাওয়াও বন্ধ থাকে।


পৃথিবীর জন্মকথা : নীহারিকা প্রকল্প ও বলয় মতবাদ

সুইডিশ বিজ্ঞানী সুইযেনবার্গ ও দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট পৃথিবী সৃষ্টির এই নীহারিকা প্রকল্পের পুরোধা। পরবর্তীতে ফরাসি বিজ্ঞানী সাইমন দ্যা লাপ্লাস এই মতের সমর্থনে আরও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য সংযোজন করেন এবং বলয় মতবাদ নামক একটি সৃষ্টিতত্ত্ব উপস্থাপন করেন। প্রথমত নীহারিকা প্রকল্পের মত অনুযায়ী, কোনো এক সুদূর অতীতে সূর্য-নক্ষত্র ও গ্রহ-উপগ্রহগুলো একটি ঘূর্ণায়মান নীহারিকা ছিল। এই ঘুরতে থাকা নীহারিকার ভেতরে ছিল ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুণসম্পন্ন বস্তুরাশি। এক সময় এই অভ্যন্তরস্ত ভিন্ন ভিন্ন বস্তুগুলোর পৃথক পৃথক আকর্ষণী শক্তির কারণে সংঘর্ষ ঘটে, শীতল নীহারিকা কালক্রমে উত্তপ্ত নীহারিকায় পরিণত হয়। একইসাথে উত্তাপ বেড়ে যাওয়ার ফলে তার অয়তন ও ক্রমাগত সংঘর্ষ বৃদ্ধির কারণে তার ঘূর্ণন বেগও বাড়তে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় এক সময় ঘূর্ণনরত নীহারিকার নিরক্ষীয় এলাকাটি প্রসারিত হতে হতে কয়েকটি বস্তু স্তর অংটির আকারে মূল নীহারিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরস্পর থেকে দূরে সরে যায়। এই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আংটিসদৃশ বস্তুপিন্ডগুলোই পরবর্তীতে ভিন্ন ভিন্ন গ্রহে পরিণতি লাভ করে।

আর বলয় মতবাদ অনুসারে বাষ্পাকারে উত্তপ্ত এই বস্তুপিন্ডগুলো ক্রমশ তাপ বিকিরণ করতে করতে শীতল হতে থাকে, এবং আপন মহাকর্ষীয় শক্তির আওতায় ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে। সংকুচিত হওয়ার সাতে সাথে কৌণিক ভরবেগের সমতা রক্ষার জন্যে তাদের ঘূর্ণনবেগও বেড়ে যেতে থাকে। এরূপ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নীহারিকাটি ক্রমশ গাড়ির চাকার মত চ্যাপ্টা হয়ে যায়, এবং চ্যাপ্টা অংশ ক্রমশ বড় হতে থাকে। পাশাপাশি ঘূর্ণণবেগ বাড়তে বাড়তে এক সময় এর নিরক্ষীয় অঞ্চলে কেন্দ্রায়িত শক্তি সমান হয়ে যায়। এ অবস্থায় নীহারিকা থেকে বলয়ের মত ্কিেট অংশ ঞসে পড়ে যা আপন বেগে বলয় বা চাকাটির চারপাশে ঘুরতে থাকে। নীহাকিা থেকে এই খসে পড়া অংশগুলোই কালক্রমে বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহের সৃষ্টি করে। আমাদের পৃথিবী ও চন্দ্র তেমনি প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট একটি গ্রহ ও উপগ্রহ, আর মূল নীহারিকা সূর্য।

নব নীহারিকাবাদ

পূর্বতন নীহারিকাবাদের পরবর্তী পর্যায়ে একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানী নীহারিকা থেকেই গ্রহ-উপগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে এই তত্ত্বকে মেনে তার সাথে কিছু নতুন ধারণা সংযুক্ত করেন। এই ধারণা অনুযায়ী, মধ্যম শক্তির আবর্তনবেগস¤পন্ন একটি নীহারিকার মধ্যে সুষম বিন্যাসের কতগুলো গ্যাস ও ধূলির খনি সৃষ্টি হয়। এই ধূলির খনিগুলোই মূল নীহারিকা থেকে সরে গিয়ে কালক্রমে বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহের সৃষ্টি করে।

জোয়ার মতবাদ ও সংঘর্ষ তত্ত্ব

জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেম্স জিন্স জোয়র মতবাদের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। এই মতবাদ অনুযায়ী, এক সময় সূর্য অপেক্ষা কয়েকগুণ বড় একটি নক্ষত্র সূর্যের নিকটবর্তী হয়, এবং তাদের মধ্যেকার দূরত্ব কমতে কমতে এমন একটি সময় উপস্থিত হয় যখন বৃহৎ নক্ষত্রের প্রবল আকর্ষণে সূর্য পৃষ্ট জোয়ারের মতো উত্তোলিত হয়ে ওঠে। সূর্যপৃষ্টের এই উত্তোলিত কিছু অংশ এক সময় সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যা থেকে কালক্রমে বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহের সৃষ্টি হয়।

অন্যদিকে জোয়ার মতবাদের সমর্থনে তাত্ত্বিক সংযোজন রাখতে গিয়ে বিজ্ঞানী হ্যারল্ড জেফরি সংঘর্ষ তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তাঁর মতে, নক্ষত্রটি সূর্যের পাশ ঘেঁষে যায়নি, সূর্যের সঙ্গে এসে স্পশাকারে ঠোক্কর খেয়েছিল। ফলে নক্ষত্র বা সূর্য কারোই অভ্যন্তরভাগের গঠন বৈশিষ্ট্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, সংঘর্ষের পূর্বেই উভয়ের থেকে বেশ কিছু অংশ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। এরপর যখন সংঘর্ষ হয় তখন প্রচন্ড চাপে উভয়ের বাইরের স্তর মিশ্রিত হয়ে ও উত্তপ্ত হয়ে দ্রুতবেগে আবর্তিত হতে শুরু করে। মাত্র এক ঘন্টা সময়ের মধ্যে পুরো ঘটনাটি নিস্পন্ন হয়।

যুগ্ম ও ত্রিনক্ষত্রবাদ

যুগ্ম নক্ষত্রবাদের প্রধান উদ্গাতা বিজ্ঞানী রাসেল। তিনি মনে করেন, এক সময় সূর্যের একটি ক্ষুদ্র যুগ্ম নক্ষত্র ছিল যা বর্তমান গ্রহগুলোর সমান দূরত্বে থেকে সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করত। এরপর এক সময় এই যুগ্ম নক্ষত্রের সাথে একটি বহিরাগত নক্ষত্রের সংঘর্ষ ঘটে। সেই সংঘর্ষের ফলেই বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহের সৃষ্টি হয়।

অপরদিকে ত্রিনক্ষত্রবাদী বিজ্ঞানী লিটলটনের মতে, সূর্যের দুটি নক্ষত্রসঙ্গী এক সময় পরস্পরের বেশ নিকটবর্তী ছিল। কালক্রমে তাদের পারস্পরিক দূরত্ব আরও কমে যাওয়ায় এক সময় উভয়ের মধ্যে একটি ধীর সংঘর্ষ ঘটে। তবে সংঘর্ষ ধীর হওয়ায় তারা বিভাজিত হয়ে যায় না। আবার মিলিত নক্ষত্র দুটির কৌণিক ভরবেগ এত বেশি হয় যে তা স্থায়ী হতে পারে না। ফলে এক সময় তারা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে সূর্যের আকর্ষণ কাটিয়ে মহাশূণ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। আর পেছনে পড়ে থাকে তাদের আদি বস্তুদেহের একটি বিচ্ছিন্ন অংশ যা পরবর্তীতে বিভক্ত হয়ে গ্রহ-উপগ্রহের জন্ম দিয়েছে।

অদ্বৈতবাদ

অন্য কোনো নক্ষত্রের প্রভাব ছাড়া অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রভাবে একটিমাত্র নক্ষত্র থেকে সৌরজগতের সৃষ্টি হওয়ার মতবাদ অদ্বৈতবাদ নামে পরিচিত। এই মতবাদ অনুসারে নক্ষত্র-অভ্যন্তরে তড়িৎ শক্তির প্রভাব ছিল যা নক্ষত্রটিকে বিভিন্ন খন্ডে বিভক্ত করে। আবার এই মতবাদে বিশ্বাসী একদল বিজ্ঞানী মনে করেন, আপন বেগে চলতে চলতে সূর্য আন্তনাক্ষত্রিক মেঘের একটি অপেক্ষাকৃত ঘন অঞ্চলে উপস্থিত হলে সেই মেঘের একটি পুরো আবরণ তার প্রতি আকর্ষিত হয়ে পড়ে। এবং এই আবরণীয় বস্তুকণাগুলোর অভ্যন্তরীণ ঘর্ষণের ফলে এদের পরিভ্রমণের প্রকৃতি পরিবর্তিত হতে হতে এক সময় তারা বিভিন্ন গোলাকার পিন্ডে পরিণত হয়। সেই সব গোলাকার পিন্ডের পরিবর্তিত রূপই আজকের বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহ।

বিশ্ব ও মহাবিশ্ব সৃষ্টির আধুনিক তাত্ত্বিকদের উল্লিখিত মতবাদগুলোর মধ্যে দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের একটি নীহারিকা থেকে সূর্য, গ্রহ-উপগ্রহ, ধূমকেতু, উল্কাপিন্ড, গ্রহানুপুঞ্জ ইত্যাদি সবকিছু সৃষ্টির নীহারিকাবাদ তঃকালীন পন্ডিতমহলে তেমন গ্রহনযোগ্যতা লাভ করেনি। আবার ফরাসি বিজ্ঞানী লাপ্লাসের বলয় মতবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর অচিরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ পন্ডিতমহলে ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা লাভ করলেও পরবর্তীকালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাঁর মতবাদের বেশকিছু সীমাবদ্ধতার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। একইভাবে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিজ্ঞানী মৌল্টন ও চেম্বারলিনের সংঘর্ষ তত্ত্বের বিভিন্ন ত্রুটির দিকে নির্দেশ করে একটি মতবাদ প্রদান করেন যা সমসাময়িক সময়ে যথেষ্ট সমাদর লাভ করে। কিন্তু থেমে থাকার নাম বিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উত্তরোত্তর অগ্রগতির ফলে পৃথিবী ও মহাবিশ্ব সৃষ্টির গবেষণাও নিত্যনতুন মাত্রা পাচ্ছে।

তবে বৈজ্ঞিনিক ও জ্যোতির্বিদদের বিভিন্ন মতের মধ্যে বিবিধ সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ থাকলেও বর্তমানের এই সুজলা-সুফলা পৃথিবী মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহের সাথে পিন্ডাকার অবস্থায় ছিল এবিষয়ে তেমন মতদ্বৈততা নেই। একইসাথে বিভিন্ন পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে একথাও সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়েছে যে আদিপিন্ড থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা আমাদের গ্রহ তথা পৃথিবী প্রথম অবস্থায় একটি জলন্ত গ্যাসের পুঞ্জ ছিল, যেমনটি ছিল মঙ্গল- বুধ- বৃহস্পতির মতো অন্যান্য গ্রহগুলো। অন্যসব গ্রহ-গ্রহানুপুঞ্জের মত পৃথিবীও ক্রমশ তার অভ্যন্তরস্থ তাপ বিকীরণ করতে করতে শীতল হতে থাকল। গ্যাস ঠান্ডা হলে তরলে পরিণত হয়, , জলন্ত গ্যাসের পিন্ড থেকে তেমনিভাবে এক তরল পৃথিবীর সৃষ্টি হল। এই তরল অবস্থায় দুধের সর পড়ার মত পৃথিবীর উপরিভাগে স্তর পড়ে ক্রমশ শক্ত হয়ে এলো। তখনকার উষ্ণ আবহাওয়ায় উৎপন্ন বায়ুমন্ডল, মেঘমন্ডল পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে লাগল। এতে করে মাঝে মধ্যে পৃথিবীর বুকে বৃষ্টির ধারা ঝরে পড়ত। কিন্তু পৃথিবীর উপরের স্তর তখনও অনেক তপ্ত থাকায় ঝরে পড়া বৃষ্টি নিমিষেই বাষ্প হয়ে আবার উড়ে যেত, এবং কিছু জল তবুও পৃথিবীর স্তর শুষে নিত। মাঝেমধ্যে পৃথিবী থর থর করে কেঁপে উঠত যার ফলে পৃথিবীর উপরকার স্তর ভেঙ্গে-চুরে উঁচু-নিচু জমি ও খাদ তৈরি হয়। এরপর যখন পৃথিবীর তাপমাত্রা আরও কমে আসে তখন ঝরে পড়া বৃষ্টি ক্রমশ খাদগুলোতে জমতে থাকে, সৃষ্টি হয় পৃথিবীর আদি অগভীর সমুদ্র। পৃথিবীর উপরিভাগের স্তর ততদিনে তাপমাত্রা অনেকটা হারিয়ে ফেলায় বৃষ্টির পানি স্থলভাগের বিভিন্ন স্থান ধুয়ে নিয়ে সমুদ্রে এনে জমা করতে থাকে। সমুদ্রের মধ্যে জমতে থাকে একটার পর একটা স্তর, ক্রমশ নিচের স্তরের মাটি উপরের স্তরের চাপে কঠিন শিলায় পরিণত হয় যার অন্যনাম পাললিক শিলা। সমুদ্রের বুকের এই পাললিক শিলা পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর সৃষ্টিকালীন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে সক্ষম হয়েছেন।

পাশাপাশি একথাও উল্লেখ্য যে পৃথিবী তার জন্মকালীন সময়ে যে সকল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিজেকে রৃুপান্তরিত করেছে সেই রূপান্তর প্রক্রিয়া থেমে যায়নি, আজও চলছে। পৃথিবীর বাইরের অংশ কালক্রমে শক্ত হয়ে গেলেও তার অভ্যন্তরভাগের বিস্তৃত অংশ জুড়ে এখনো সেই আদি উত্তপ্ত পদার্থে পূর্ন যা মাঝে মধ্যেই আগ্নেয়গিরির মাধ্যমে বাইরে বেরিয়ে আসে। অবশ্য পৃথিবীর অধিকাংশ আগ্নেয়গিরি সমুদ্রের তলায়, কারণ এখনো পৃথিবীর অধিকাংশ সমুদ্রে ঢাকা। সমুদ্রের মধ্যে লুকোনো এইসব আগ্নেয়গিরির কারণে কোথাও কোথাও বিশালাকার পাহাড় জেগে ওঠে। বর্তমানের হিমালয় পবর্তও তেমনিভাবে সৃষ্ট। এর প্রমাণ এই পর্বতের ষোল হাজার ফুট উঁচুতে খুঁজে পাওয়া সামুদ্রিক জীবের ফসিল।

২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যমদূতের চিঠি তোমার চিঠি!!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:০৮

যমদূতের চিঠি আসে ধাপে ধাপে
চোখের আলো ঝাপসাতে
দাঁতের মাড়ি আলগাতে
মানুষের কী তা বুঝে আসে?
চিরকাল থাকার জায়গা
পৃথিবী নয়,
মৃত্যুর আলামত আসতে থাকে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে
স্বাভাবিক মৃত্যু যদি নসিব... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×