ড. অতুল সুর, ভারতের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, নৃতাত্ত্বিক ও গবেষক তাঁর ‘বাাঙলি জীবনের নৃতাত্ত্বিক রূপ’ গ্রন্থে বলেছেন, “ভূতত্ত্ববিদদের হিসেব অনুযায়ী প্রায় দশ থেকে পঁচিশ লাখ বছর আগে আবির্ভূত হয়েছিল মানুষের পূর্বপুরুষ। তারপর বিবর্তনের পথে পাঁচ লাখ বছর আগে ঋজুভাবে চলাফেরা করতে পারে এমন মানুষের আবির্ভাব ঘটে। এর পরবর্তী পর্যায়ের মানুষের নাম দেওয়া হয়েছে নিয়ানডারথাল জাতির মানুষ। আনুমানিক চল্লিশ হাজার বছর আগে নিয়ানডারথাল জাতির মানুষ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তার স্থান অধিকার করে ক্রোম্যানিয়োন জাতির মানুষ। আর ক্রোম্যানিয়োন জাতি থেকেই পৃথিবীর বর্তমান জাতিসমূহের উদ্ভব। অর্থাৎ পৃথিবীতে বর্তমানে যত জাতি বিদ্যমান তারা সকলেই একই বর্গ ও প্রজাতি থেকে উদ্ভূত। তাদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত যে পার্থক্য রয়েছে তার জন্যে তাদের বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর লোক বলা হয়।” একইসাথে তিনি আরও বলেন, “বাংলার আদিম অধিবাসীরা ছিলেন প্রাক-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর লোক। নৃতত্ত্বের ভাষায় তাদের বলা হয় আদি-অষ্ট্রাল। আদি-অষ্ট্রাল বলার কারণ হলো, অষ্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের দৈহিক গঠনের মিল রয়েছে। দৈহিক গঠনের মিল ছাড়া অষ্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের রক্তের মিলও রয়েছে। এক সময় আদি-অষ্ট্রালদের বসতি উত্তর ভারত থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আনুমানিক ত্রিশ হাজার বছর আগে তারা ভারত থেকে অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশে গিয়ে প্রথম পৌঁছায়। বাঙলার আদিম অধিবাসীরা ওই গোষ্ঠীর লোক। এদের সঙ্গে মিশে গেছে আগন্তুক দ্রাবিড় ভাষাভাষী জাতি। দ্রাবিড় ভাষাভাষীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল আলপীয়রা আসার আগে। আর আদি-অষ্ট্রাল, দ্রাবিড় ভাষাভাষী ও আলপীয় নরগোষ্ঠীর লোকদের সংমিশ্রণেই বাঙলার নৃতাত্ত্বিক বনিয়াদ গঠিত হয়েছিল।”
উল্লিখিত এই মানববর্গই ভারত বাংলাদেশ, উপমহাদেশ এবং বৃহৎঅর্থে দক্ষিণ এশিয়া ভূখন্ডের আদি অধিবাসী। ইতিহাসের সূত্র ধরে বলা হয়ে থাকে, আনুমানিক ১৫০০ থেকে ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, বৈদিক যুগের শেষ দিকে বহিরাগত আর্যরা অনুপ্রবেশ করে ভারতীয় ভুখন্ডে। পশুপালন নির্ভর যাযাবর বৃত্তির আর্যরা ছিল এখানকার আদিবাসীদের চেয়ে শারীরিকভাবে শক্তিশালী ও যুদ্ধজ্ঞানে দক্ষ। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষী আর্যরা এই উপমহাদেশে পর পর বিভিন্ন দলে আসে, এবং কালক্রমে হিন্দু বর্ণব্যবস্থার উপরের স্তরে আসীন হয়। স্থানীয় নরগোষ্ঠীদের দিয়ে তৈরি হয় নীচের স্তর।
তবে বঙ্গের লোকদের সাথে বহিরাগত আর্যদের প্রচন্ড যুদ্ধও হয়েছিল। আর্যরা প্রথমদিকে তাতে বিশেষ কৃতিত্ব দেখাতে না পারায় বঙ্গের লোকদের ম্লেচ বলে উপহাস করত। এবং আর্য ও অন্যান্যদের আগমনের পূর্বেও ভারতবর্ষে সভ্য জাতির বসবাস ছিল। তাদের মধ্যে দ্রাবিড়রা সিন্ধু অঞ্চলে এবং অস্ট্রিকরা ভারতের পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলে বাস করত। অনেকের মতে, হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে উৎখননের মাধ্যমে প্রাপ্ত সভ্যতার নিদর্শন সভ্য দ্রাবিড়দের অবদানসাক্ষ্য। ঘোড়া ও যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহার জানা যাযাবর হিংস্র প্রকৃতির আর্যরা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ভারতে প্রবেশ করে দ্রাবিড়দের ধাওয়া করে। এবং স্বভাবতই দ্রাবিড়রা আর্যদের উন্নত কাছে পরাজিত অথবা আর্যদের আধিপত্য মেনে নিতে অস্বীকার করে। বেছে নেয় নির্ঝঞ্জাট অবস্থান। অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকা। সেই সময় কোল, ভিল, শবর, মুণ্ডা প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা পাহাড়ে বসবাস করত। ঘন বনে ঢাকা পাহাড়-পর্বত পার হতে না পেরে আর্যরা আর এগুতে পারেনি। আর অন্যদিকে দূরতিগম্য নিস্তরঙ্গ পাহাড়ের বুকে আশ্রয় নেয়া জনমানুষেরাও প্রগতিধর্মীতা ধরে রেখে সভ্যতার যথার্থ গতিতে এগিয়ে যেতে পারেনি। অনেক ইতিহাসতত্ত্ববিদ ও নৃবিজ্ঞানীর মতে, এই পাহাড়-পর্বত আর অরণ্যে পড়ে থাকা মানুষেরা-ই এই অঞ্চলের আদিবাসী বা পুর্বপুরুষ।
বর্তমান পাকিস্তানের হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো ছাড়াও প্রতœতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে এই জনপদের পূর্বপুরুষদের বিভিন্ন নির্দশন পাওয়া গিয়েছে বর্ধমান জেলার অজয় নদীর অববাহিকায়, যার সাথে মিল খুঁজে পাওয়া গিয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও ক্রীট দ্বীপে প্রাপ্ত প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শনাবলীর সাথে। এবং এতে নৃতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদদের ধারণা, দ্রাবিড় ও অষ্ট্রিকদের পাশাপাশি এই অঞ্চলে মঙ্গোলীয় জাতিরও বসবাস ছিল।
সভ্যতার আদিম অবস্থায় যখন সমাজ ব্যবস্থার সুস্পষ্ট বিকাশ ঘটেনি তখনো ব্যক্তি মানুষের আদর্শ ও লক্ষ্য ছিল। তার এই আদর্শের নির্মিতিতে ভূমিকা রেখেছে আবেগ-অনুভূতি। বুদ্ধি-বিবেচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ ক্ষমতা, একইসাথে যা তাকে দিয়েছে সৃষ্টির সর্বোৎকৃষ্টতার মহিমা। এরপর মানুষের আদর্শের সাথে তার একাত্মতায় জন্ম নেয় এক আবেগ মহাসমুদ্রের। আর তার সেই আবেগের ধ্বনিত রূপই ভাষা। “এই হল ভাষা যার সাথে মানুষের মনের ও মস্তিষ্কের গভীর সংযোগ। এক একটি পরিবেশে মন ও মস্তিস্কের কাঠামোগত বিভিন্নতার কারণে ভাষার মধ্যে বিভিন্নতা দেখা দিয়েছে। তাই দেখা দিয়েছে একই দেশে একাধিক ভাষা। কিন্তু এক দেশে একাধিক ভাষা সত্ত্বেও এক জাতি গড়ে ওঠে। এর দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় অসংখ্য। আমাদের পাশের দেশ ভারত এর বৃহত্তম দৃষ্টান্ত।”*
ভাষাগত দিক বিবেচনায় বাঙালি জাতি এই দেশের সবচেয়ে বড়ো জাতি। কিন্তু বাংলা ভাষাভাষীদের এক তৃতীয়াংশ ভারতের বাসিন্দা ; এবং তারা নিজেদেরকে ভারতীয় জাতিসত্ত্বার অঙ্গীভূত বলে গর্ববোধ করে থাকে, যদিও সেখানে ভাষাগত বিবেচনায় তাঁরা অপ্রধান। তেমনিভাবে এইদেশে বসবাসরত চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, গারো প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী ভিন্ন ভাষাভাষীর অধিকারী হলেও এই গোষ্ঠীয় জাতিসত্ত্বায় তাঁদের চেতনার অংশগ্রহণ রয়েছে।
কেবল ঐতিহাসিক নয়, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই সমৃদ্ধতর সুজলা-সুফলা এই দেশের প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন জাতির বিশেষ আকর্ষণ ছিল, যার পরিণতিতে নানাবিধ উপলক্ষে এখানে তাঁদের আগমন বা আগ্রাসন। ইতিহাসতত্ত্ববিদদের মতে এভাবেই আসীন ঘটে দ্রাবিড়, আর্য, শক, হুন, আরব, পাঠান, মোঘল ও ইয়োরোপীয়দের। তাঁদের মধ্যে দ্রাবিড়, আর্য, হুন, শক, মোঘল, পাঠান, আরব, তুর্কি, ইরানি প্রভৃতিরা এদেশবাসীদের সাথে না না সূত্রে এবং নানাভাবে মিশে গিয়েছে।
প্রভুত্বকারী প্রথাগত ইতিহাসে আর্যপূর্ব যুগের আদিবাসীরা ঢালাওভাবে অনার্য নামে পরিচিত। ঐতিহাসিকদের পাতায় যদিও অনার্যদের কোনো পরিচয় লেখা নেই, তাদের পরিচয় লুকিয়ে রয়েছে এদেশের প্রাচীন পড়োভূমি আর বিস্মৃতপ্রায় নৃতত্ত্ব, ভাষা ও সংস্কার সংস্কৃতিতে। অনার্য জাতি বলে পরিচিত আদিম জনগণ সম্পর্কে আমরা স্বভাবতঃ যে হীন ধারণা পোষণ করি তা মোটেই সঠিক নয়। কেননা, বিদেশাগত আর্য ও এদেশীয় অনার্যদের তৎকালীন ইতিহাসের পারষ্পরিক অবস্থার মধ্যে তথাকথিত ভ্রান্ত ধারণাদির বিরুদ্ধে নিগুঢ় তথ্য নিহিত রয়েছে। আর্যরা যখন আক্রমণকারী রুপে এদেশে আগমণ করে তখনো তারা ছিল যাযাবর জাতি এবং কাঁচা খাদ্য ভক্ষণ করত। পক্ষান্তরে এদেশে বসবাসকারী অনার্য নামক অধিবাসীরা ছিল পাকান্ন ভোজী ও ঘরবাড়ি নির্মাণ করে সামাজিক জীবনযাপনকারী স্থিতিশীল নাগরিক। তাদের নিজস্ব কৃষিভিত্তিক সভ্যতা ছিল। এই পরিস্থিতিতে আগ্রাসী আর্যরা এদেশের কৃষিভিত্তিক সমাজের শান্তিপ্রিয় মানুষদের উপরে চড়াও হয়ে, তাদের পরাভূত করে চাপিয়ে দেয় নিজেদের জীবন-যাপন পদ্ধতি।
তবুও যখন এদেশের মূলস্রোতের প্রকৃত ইতিহাসজ্ঞান অর্জনে অক্ষম সাধারণ মানুষদের মতো কোনো কোনো ইতিহাসবিদ, গবেষক, বুদ্ধিজীবী প্রকৃত আদিবাসীদের স্থলে মিশ্ররক্তজাত বাঙালিদের স্থান দেন এবং আদিবাসীদের অস্থানীয়, বহিরাগত ইত্যাদি বলে পাশ কাটিয়ে যেতে প্রচেষ্টা চালান। এর প্রতুত্তরে বিশিষ্ট আদিবাসী ব্যক্তিত্ব পল চারু তিগ্যা বলেন, “বাংলাদেশের কোনো কোনো সমাজতত্ত্ববিদ আদিবাসীদের এদেশের ভূমিজ সন্তান নয় বলে উল্লেখ করেন। অবশ্য ভৌগোলিক বিচারে নিশ্চয় তাদেরকে এদেশের ভূমিজ সন্তান বলা চলে না। তবে একথাও সত্যি যে, এই মানদন্ডের বিচারে আমাদের মধ্যে অনেক বাঙালিও এদেশের ভূমিজ সন্তান নয়। কারণ, তারা ভারত বা অন্যান্য স্থান থেকে হয় রাজনৈতিক চাপে পড়ে অথবা রেওয়াজ বদলের মাধ্যমে বাংলার মাটিতে প্রবেশ করেছেন। তাদের সম্পর্কে লিখতে গেলে নিশ্চয় ঐ সমস্ত সমাজবিদরা তাদেরকেও এদেশের ভূমিজ সন্তান নয় বলে আখ্যায়িত করবেন না। দ্বিতীয়তঃ যদি বলি রাজনৈতিক বিচারে তারা এদেশের ভূমিজ সন্তান না হন ত’হলে আমরা যারা ছয় বছরের উর্ধ্বে তারা কেউ এদেশের ভূমিজ সন্তান নই। কারণ, বাংলাদেশের বয়স মাত্র ছয় সাত বছর।” (‘দিনাজপুর জেলার আদিবাসী’ দৈনিক উত্তরা, ১২ ডিসেম্বর ১৯৭৭ খৃষ্টাব্দ)।
পরবর্তীতে এই বক্তব্যের সমর্থনে কয়েকজন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী মত প্রকাশ করেছেন ; বিশেষত আনু মহম্মদ বলেন, “বাংলাদেশ শুধুমাত্র বাঙালিদের আদি বাসভূমি নয়। এদেশে এমন মানুষ আছে যারা বাঙালি নয়, এবং যারা এখানে বহুবছর ধরে আছে, কিছু এলাকায় বাঙালিদের চেয়ে বেশিদিন ধরে তারা তাদের নিজস্ব সমাজ, সংগঠন, সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে এবং সর্বোপরি তারা বাংলাদেশকে তাদের বাসভূমি মনে করে। এদের মতো অনেক গোষ্ঠী আছে যারা বাঙালিদের তুলনায় কম গভীরভাবে এখানে প্রোথিত নেই। বাঙালিদের মতো তারাও বাংলাদেশের নাগরিক, কিন্তু এটি ভীষণ জরুরি যে, এরা বাঙালি নয় তা মনে রাখতে হয়। ... তাদের ইতিহাস আলাদা, তাদের সমাজ আলাদা, তাদের ভাষা আলাদা, কিন্তু আমরা সবাই অবিভক্ত রাষ্ট্রের পরিচিতি বহন করি।”
সর্বশেষ স্বীকৃত হিসেব অনুযায়ী পৃথিবীর ৭০টির বেশি দেশে প্রায় ৫০০০ টি জাতিগোষ্ঠীর ৩০ কোটির অধিক আদিবাসী রয়েছে। কিন্তু আদিবাসীদের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি বলে মনে করেন আদিবাসীসহ বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও প্রগতিশীল বৃদ্ধিজীবীরা। সংখ্যা বৈষম্যের ক্ষুদ্র নমুনা বাংলাদেশে আদিবাসীদের সংখ্যা নির্নয়ের বিভিন্ন পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করলেই ষ্পষ্ট হয়। ১৯৭৪ সালের আদমশুমারীতে ২৬ টি নৃগোষ্ঠীর ৮,১০,৬৪২ জনকে দেখানো হয়েছে। ১৯৯১’র হিসেবে ২৭টি জনগোষ্ঠীর ১২,০৫,৯৮৭ জন। কিন্তু জুন ২০০০ সালে জাতীয় সংসদে তৎকালীন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী জানান, দেশে বর্তমানে ৪৮টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে যাদের জনসংখ্যা ১৪,২৩,০৬৮ জন। অন্যদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক ফাদার ষ্টিফেন গোমেজ তাঁর গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বসবাসরত ৫৮টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উল্লেখ করেছেন। এবং আদিবাসী নেতৃবৃন্দ মনে করেন এদেশে বসবাসরত আদিবাসী জনসংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। আর রাজনৈতিকভাবে আদিবাসীদের কোনঠাসা করার নিমিত্তেই সরকারীভাবে আদিবাসী সংখ্যা কম উল্লেখ করা হয় বলে মনে করেন তাঁরা।
তবে ভৌগোলিক ও শারীরিকসহ কিছু কিছু ভিন্নতা থাকলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত আদিবাসীরাই সামঞ্জস্য তাদের প্রান্তিক অবস্থান, শোষণ, বঞ্চণা, দারিদ্র, অশিক্ষা, অসচেতনতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে। প্রতিটি দেশেই তারা মূলস্রোতের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষদের চাঁপিয়ে দেওয়া বিবিধ অন্যায় আচরণের শিকার। তথাকথিত সভ্যতার নামে, প্রচার সর্বস্ব উন্নয়নের নামে সারাবিশ্বে আদিবাসীদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ সহ চলছে আধুনিক মানুষদের অভিনব সব অত্যাচার, অবমাননা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আদিবাসীদের অসভ্য, জংলী ইত্যাদি নেতিবাচক বিশেষণে আখ্যায়িত করে চালানো হয়েছে নির্যাতনের খরগ। তাদের অকৃত্রিম সরলতার সুযোগ নিয়ে কথিত সভ্য মানুষেরা উদ্ভাবন করেছে অজস্র প্রতারণা-কৌশল। রাষ্ট্রীয় আইনের অন্যায় নিস্ক্রিয়তায় প্রকাশ্যে তাদের উপর চলে রাজনৈতিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক আধিপত্য, অর্থনৈতিক শোষণ।
কেবল বস্তুগত শোষণ নয়, আদিবাসীদের প্রতি বুদ্ধিবৃত্তিক সত্যতার অভাবও পরিলক্ষিত কমবেশি অধিকাংশ দেশের সমকালীন বিবরণে, যার জ্বলন্ত উদাহরণ এদেশের প্রচলিত ইতিহাস। বিশেষ করে এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর মহান অবদানের অদ্ভুত অনুপস্থিতিতি কেবল এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা নয়, বরং এটাকে এক ধরনের সুচিন্তিত বর্জন বলে মনে করেন কোনো কোনো সমাজবিজ্ঞানী। জাতি ভিত্তিক রাষ্ট্রের যথার্থতা নিরুপন এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন তাঁরা। এবং এক্ষেত্রে সংবিধানে বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর স্বীকৃতির অনুল্লেখ তাদের মতামতের প্রমাণ হিসেবে কার্যকর।
পৃথিবীর দুটি দেশের সংবিধানে সেদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংযোজিত হয়েছে, যার একটি বাংলাদেশের। এবং বাংলাদেশের সংবিধানই বিশ্বে একমাত্র সংবিধান যেখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা রয়েছে, “ধর্মকে অবলম্বন করে কোনো রাজনীতি করা যাবে না।” কিন্তু স্বাধীনতার তৎপরবর্তীকালীন জিয়া ও এরশাদ আমলে পঙ্গুকৃত সা¤প্রদায়িক সংবিধান বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকালীন সংবিধানের মহত্বকে কেবল নষ্টই করেনি, সংবিধানের তথাকথিত সংশোধনের কারণে আজ এক ধরনের অঘোষিত অধিকার নিয়ে দেশের সর্বত্র সৃষ্ট হচ্ছে অসংখ্য জঙ্গিবাদী সা¤প্রদায়িক সংগঠন, যারা দেশের আইন-কানুন ও মানবাধিকারকে তুচ্ছজ্ঞান করে মধ্যযুগীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ধর্মবাদী প্রকাশ্য রাজনৈতিক দলসমূহ ছাড়াও অর্ধশতাধিক জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠন সক্রিয় রয়েছে এদেশে যারা দেশব্যাপী ৬ হাজারের অধিক মাদ্রাসা ও প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার মসজিদকে কেন্দ্র করে তারা নানাবিধ প্রশিক্ষণ সহ অন্যান্য কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। (ভোরের কাগজ ১৮.০৮.০৫)। দেশের চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ হাজার প্রশিক্ষিত জঙ্গি রয়েছে (জনকন্ঠ ২২.০৮.০৫)। এসব জঙ্গীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে তিনটি বিদেশী সংস্থা (জনকণ্ঠ ২১.০৮.০৫)। এভাবেই বাঙালি ও বাঙালি মুসলিম সচেতনতাবোধের মিশ্রণে বিবর্তিত হতে থাকে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের প্রতিনিধিদের জাতীয়তাবাদ। আর জাতীয়তাবাদের এই দুটো মুখ্য উপাদানই পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দেয় এদেশের সংখ্যালঘু ভিন্নভাষী ও অমুসলিম জাতিসমূহের প্রতি বিবিধ অনাচারের। শিতাংশু গুহ’র গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে পরিচালিত স্লো জেনোসাইড ও এথনিক ক্লিনজিং’র কারণে মাত্র কয়েক বছরে (১৯৪৭ থেকে বর্তমান) সংখ্যালঘুর সংখ্যা ৩০% থেকে ১০% য়ে চলে এসেছে। এবং অত্যাচার ও অভিমানে দেশান্তরিত এই মানুষদের সংখ্যা সম্মিলিতভাবে বাহরাইন, আইসল্যান্ড, জর্ডান, লেবানন, লিবিয়া, নামিবিয়া, ওমান, পানামা ও কোষ্টারিকার জনসংখ্যার সমান।
দেশ বিদেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও অন্যান্য গণমাধ্যমসহ, জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর, বিভিন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এবং গবেষণা রিপোর্টে প্রতিনিয়ত প্রকাশিত এসকল অমানবিক ও বৈষম্যমূলক আচরণের বিবরণ প্রকাশে বিশ্বে বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে তা নিশ্চয়ই কোনো দেশের জন্যে সূখকর ও সুফলবাহী নয়।
আর এই পরিকল্পিত প্রান্তিকীকরণ ও নিপীড়নের প্রতিক্রিয়ায় এদেশে ক্রমহ্রাস ঘটছে সংখ্যালঘু সত্তার। ১৯৭৪ সালের জনগণনা অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ৮৫.৪% মুসলিম ও বাকীরা বিভিন্ন সংখ্যালঘূ স¤প্রদায়ের। ১৯৯১ সালের হিসাবনুযায়ী ৮৮.৩% মুসলিম ও বাকীরা বিভিন্ন সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের অধিবাসী। জানা যায়, রাষ্ট্র ও তার সংখ্যাগরিষ্ট জনসংখ্যার বহুমুখী চাপে প্রতিদিন গড়ে ৫৫০ জন সংখ্যালঘু মানুষ দেশান্তরী হচ্ছে।
অথচ ১৭৭১ সালে সংঘটিত ভারতীয় ইতিহাসের প্রথম উপনিবেশ বিরোধী গণবিদ্রোহ ও তৎপরবর্তী সকল স্বাধীকার আন্দোলনে অপরিসীম ত্যাগ ও বীরত্বের সাক্ষ্য রেখেছে আদিবাসী মানুষ। এবং কেবল ১৮৫৫ সালের বৃটিশ বিরোধী সাঁওতাল হুল বিদ্রোহে প্রাণ হারিয়েছেন ২৩ হাজার আদিবাসী সাঁওতাল। এমনিকরে ওঁরাও তানাভগৎ আন্দালন, পাগল বিদোহ, হাতিখেদা আন্দোলন, চাকমা বিদ্রোহ, গারো বিদ্রোহ, হাজংদের টংক বিরোধী আন্দোলন, মণিপুরী বিদ্রোহ, ভানুবিলের কৃষক-প্রজা বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, নাচোল বিদ্রোহ প্রভৃতিতে অকাতরে জীবন দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আজ অবধি উপমহাদেশের এ সকল বিদ্রোহ-সংগ্রাম ইতিহাসযোগ্য হয়ে স্থান নিতে পারেনি প্রথাগত ও প্রভাবশালী বিবরণে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের অবদান লিপিবদ্ধ খন্ড বিদ্রোহ বা স্থানীয় হাঙ্গামা হিসেবে। এরই ধারাবাহিকতায় আদিবাসীদের ত্যাগ ও অবদানের অদ্ভুত অনুপস্থিতি লক্ষ্যনীয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে।
পৃথিবীর ইতিহাসগ্রন্থে স্বর্ণের হরফে লেখা এক মহাকাব্যের নাম ১৯৭১’র মুক্তিযুদ্ধ। মহান সেই যুদ্ধে এদেশের মানুষ তাদের রক্তের নদী বেয়ে নিয়ে এসেছে স্বাধীনতার সাম্পান। আর এত অল্প সময়ে এত বড়ো অর্জন সম্ভব হয়েছিল সেই সংগ্রামে দেশের আপামর জনসাধারণের সম্পৃক্ততার কারণেই। সম্পৃক্ততা ছিল এদেশের বাঙালি ভিন্ন আরো অর্ধশতাধিক জনগোষ্ঠীর, যারা আমাদের মূলস্রোতেরই অংশ, এই দেশের আদিবাসী স¤প্রদায়। এক প্রাথমিক হিসেবে জানা যায়, একান্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী গারো ও সাঁওতাল আদিবাসীর সংখ্যা দুই হাজার দু’শ জন, যুদ্ধে শহীদ আদিবাসীর সংখ্যা কয়েকশত। রংপুরের উপকন্ঠে পাকসেনাদের হাতে নিহত আদিবাসী সাঁওতালদের সংখ্যা ২০০ জন উল্লেখ রয়েছে ১৫ খন্ডের স্বাধীনতার ইতিহাস গ্রন্থে। সংখ্যাহীন এমন অনেক আদিবাসী যোদ্ধা রয়েছেন যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ চলাচলে অসাধারণ বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্ব রেখে এদেশের বিজয়কে অনুকূলে এনে দিয়েছেন। অথচ স্বাধীন দেশের ক্রমাগত নিগ্রহ, বঞ্চনা ও অস্বীকৃতি তাঁদের অনেককে আজ দেশান্তরিত হতে বাধ্য করেছে, কুণ্ঠিত করছে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিতে। তেমনি এক অবহেলিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বীর মুক্তিযোদ্ধা, আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একমাত্র খেতাবপ্রাপ্ত বীরবিক্রম ইউ কোচিং মারমা। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কী পেয়েছেন জীবন বাজি রেখে যুদ্ধজয়ের বিনিময়ে? জবাবে তিনি বলেন, “ অনেক পেয়েছি। বাঙালির জন্যে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সুন্দর পতাকা, নিজের দেশের বড়ো বড়ো মন্ত্রি, এমপি, অফিসার, সবই তো পেয়েছি। এমনকি দেশ আমাকে বীরত্বের জন্য একটি উপাধিও দিয়েছে। আমার নাম এখন ইউ কে চিং বীরবিক্রম। বাহ্ কী সুন্দর নাম! আদিবাসী শত সহস্র মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে একমাত্র খেতাবপ্রাপ্ত ইউ কে চিং মারমা। অথচ তার পেটে এখন ইঁদুর দৌঁড়ায়, বাইরে বৃষ্টি নামার আগে ঘরে পানি পড়ে। তার কোনো জায়গা-জমি, ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। তার সন্তানদের কোনো চাকরি-বাকরি নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো তাদের কোনো আয়ের উৎসও নেই। তার সন্তানরা এখন দিনমজুর!” বান্দরবানের এক হতদরিদ্র পল্লী লাঙ্গিপাড়ায় বসবাসরত ইউকেচিং মারমা আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারেন না। স¤প্রতি ষাটোর্ধ এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মায়ের মৃত্যু হলে তিনি কয়েক দিনের জন্যে পার্শ্ববর্তী লাইটপোস্ট থেকে লাইন টেনে একটি বাতি জ্বালালে তাঁর কাছ থেকে স্থানীয় বিদ্যুৎ বিভাগ টাকা দাবি করে। এবং তিনি টাকা প্রদানে অসামর্থ্য হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে ১৫,৬১২.২৭ টাকার বিল অনাদায়ে মামলা দায়ের করা হয়। একাত্তরের যুদ্ধময়দানে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাক সেনাদের বন্দুক-কামানের মুখ থেকে না পালালেও স্বাধীন দেশে পুলিশি গ্রেফতারের ভয়ে পালাতে হয়েছে এদেশের একমাত্র খেতাবপ্রাপ্ত আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা বীরবিক্রম ইউকেচিং মারমাকে। সংক্ষেপে এই হল আমাদের স্বাধীন দেশের একজন খেতাবপ্রাপ্ত স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধার হাল-হকিকত। সেক্ষেত্রে এদেশের অন্যসকল জীবিত আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ আদিবাসীদের কেমনতর দিনগুজরান তা সহজেই অনুমেয়।
এমনিকরে অতিক্রান্ত সময়ের ঁিসড়ি বেয়ে এই ভূখন্ডের আধিপত্য থেকে বিদায় নিয়েছে বেনিয়া বৃটিশ, বিদায় নিয়েছে পাকিস্তানী শকুনের দল। এদেশ এখন স্বাধীন, স্বার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। কিন্তু দীর্ঘ তিন যুগের অধিককাল অতিবাহিত হলেও এদেশের সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ পায়নি। প্রতিষ্ঠিত হয়নি খাদ্য, চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তা, আইনের সমতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আত্মসংরক্ষণের অধিকার। তা এখনও দেশের মুষ্টিমেয় অভিজাতবর্গের আয়ত্বে, যারা তাদের চেয়ে নিচু শ্রেণীর মানুষদের কেবল দাবার গুটি হিসেবে গণ্য করতে অভ্যস্ত। এ যাবত তারা যেমন দেশের ৮০ ভাগ কৃষিসংশ্লিষ্ট মানুষের স্বার্থকে স্বভাবজাতভাবে অবহেলা করে এসেছে, তেমনি তাদের ইচ্ছেকৃত অবহেলার শিকার হয়েছে এদেশের অর্ধ শতাধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী। আর রাষ্ট্রের অবহেলা অপকর্মে ইন্দন যোগায় মূলস্রোতের সাধারণ মানুষদের। ফলে আদিবাসীরা আজ যুগপৎ উপেক্ষা, নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার।