নিশীথিনী,
তোমাদের যান্ত্রিক নগরীতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। দোকান থেকে ঘুম কিনতে হয় প্রতিদিন। ঘুমেও ভেজাল দিচ্ছে মনে হয়, ঘুম খাই প্রতিরাতে, কিন্তু চোখের পাতা এক হয়না কখনো। শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে হাওয়া বদল করতে এলাম। সাত দিনের অবকাশ যাপন। প্রথমেই কক্সবাজার, সমুদ্রের কাছে। সাগরের কোলঘেষে বালুকাবেলায় হাঁটতে হাঁটতে আমার বিরক্তিই লেগেছে শুধু। অথচ চারপাশে কপোত-কপোতিদের দেখেছে দু-হাতে সুখ কুড়োতে। সবাই খুব সুখেই আছে মনে হয়! সাগরের পাশে দাঁড়িয়ে আমার কী মনে হয়েছে জানো? তোমাদের বাড়ির সামনের পুকুরটাই এরচেয়ে বেশি সুন্দর!! কী অদ্ভুত ভাবনা তাইনা?
বলাবাহুল্য, কক্সবাজারের আমার ভাল লাগেনি। তিন দিনের হোটেল বুকিং ছিল, ক্যান্সেল করে দিয়ে চলে গেলাম রাঙামাটি। কাপ্তাই লেকে ব্লু-মুন দেখলাম। চাঁদ তার লজ্জার শেষ আবরণটুকু উন্মোচন করেছে নির্লজ্জের মত! কাপ্তাই লেকের পানিতে রূপালী জ্যোছনা গলে গলে পড়ছিল। একটা সময় মাঝিকে বলে ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলাম। নিস্তব্ধ নিশুতি রাতের নীরবতা উপলব্ধি করেছি, ভয়ংকর অনুভূতি! খানিক বাদেই আমার মনে হয়েছে, ফালতু একটা রাত। কোন মানে হয় জ্যোছনা দেখার জন্য লেকের বুকে নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়ানোর? তারচেয়ে ঢের ভাল, তোমার হাত ধরে পিচগলা রোদ্দুরে উদ্দেশ্যহীন হেঁটে বেড়ানো। আমার সেই দিনগুলির কথা মনে পড়ছিল বারবার, হাফ লিটারের একটা কোকের বোতল হাতে আমি তোমার পাশে বাধ্য ছেলের মত হেঁটে বেড়াতাম বেইলী রোড, পলাশী, টিএসসি, শাহবাগ। প্রচন্ড গরমে ঘামতে ঘামতে আমি বারবার তোমাকে বলতাম রিকশা নেয়ার জন্য, তুমি কটমট চোখ করে আঙ্গুল তুলে বলতে, আমার সংগে থাকতে হলে আরও ত্রিশ মিনিট হাঁটতে হবে এভাবেই। আমি তাই করতাম। তারপর পাঁচ/সাত মিনিট যেতে না যেতেই তুমি বলতে, খুব কষ্ট হচ্ছে বাবু? আমি বলতাম, নাহ্। চলো হাঁটি, ভালই লাগছে। তুমি দাড়িয়ে যেতে তখনি, তারপর একটা রিকশা ডেকে আমরা উঠে পড়তাম। আনমনেই কখন যেন তোমার ওড়না দিয়ে ঘাম মুছতাম। তুমি আবারও কটমট করে তাকাতে, তারপর ফিক করে হেসে দিতে। রাস্তাটা একটু ফাঁকা পেলেই টুপ করে একটা চুমু গালে!!
তোমার ঈশ্বরের দিব্যি নিশীথিনী, কাপ্তাই লেকের টলটলে পানিতে গৃহত্যাগী জ্যোছনাস্নাত এই মায়াবী রাতটা কোনভাবেই সেই পিচগলা রোদ্দুরের তপ্ত দুপুরের চেয়ে সুন্দর নয়। কাপ্তাই লেকের জ্যোছনা আমার ভাল লাগেনি!
এখন আমি বসে আছি চট্টগ্রামের দামপাড়া বাসস্ট্যান্ডের কাউন্টারে। যাত্রাবিরতি। একটু পরেই আবার চলতে শুরু করবে আমাদের গাড়ি। আজও আকাশে চাঁদ আছে। যান্ত্রিক নগরীর জৌলুসহীন চাঁদ। হাওয়া বদল করতে এসে আমার কোন লাভ হয়নি। আমি ফিরে যাচ্ছি ইট-কাঠের নগরীতে, তোমার নগরীদে। সংগে নিয়ে যাচ্ছি দীর্ঘশ্বাস। আর কখনো সুন্দরের কাছে আসবোনা। ভ্রমণে শুধু অপরাধবোধই বাড়ে, তোমাকে হারিয়ে ফেলার ব্যর্থতা তাড়া করে । অতীতের দায়ভার থেকে মুক্তি মেলেনা। আমি তোমার শহরেই থেকে যাবো আরও অনেকগুলো বছর, পাশপাপাশি না থাকো, একই শহরে একই আকাশের নিচেই তো আছি-এই বা কম কী!! আমি আসছি নিশীথিনী... আমি তোমার নগরীতে ফিরে আসছি, আগের মত আকুলতা নিয়ে...

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




